বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

আইনের জগতে বঙ্গবন্ধুর বিস্ময়কর প্রজ্ঞা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আইনের জগতে বঙ্গবন্ধুর বিস্ময়কর প্রজ্ঞা

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে দেখার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে যেদিন তিনি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সেদিন কথা বলার সুযোগ হয়নি, সেই মহান নেতার কথাই শুনেছি দিনভর। ব্রিটিশ সংসদ সদস্যগণ এসেছিলেন দলে দলে, বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে এবং ব্রিটিশ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে ঢাকায় আসার পর ৭৩ সালের প্রথম দিকে এই মহান নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হলেও তেমন কথা বলার সুযোগ হয়নি। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু যখন চিকিৎসার জন্য লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন সুযোগ হয়েছিল। আমি তখন যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এবং খন্দকার মোশাররফ (বর্তমানে ড. খন্দকার মোশাররফ) ওই সংস্থার সভাপতি। তাছাড়া আমি তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যুক্তরাজ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমার বড় ভাই ব্যারিস্টার ওমর ফারুকের বাল্যবন্ধু প্রয়াত নুরুল ইসলাম অনু এবং তার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজন প্রয়াত রফিকুল্লা চৌধুরী, যারা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী। আমার সঙ্গে যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের আরও কয়েকজন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু, যার ছিল অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, তিনি সেই ১৯৭২ সালে ৮ জানুয়ারি জেনেছিলেন যে আমি আইনের ছাত্র, তা অবিশ্বাস্যভাবে মনে রেখে নিজ থেকেই বললেন আমার দেশের বেশ কিছু ছেলে এখন বিলেতে আইন পড়ছে জেনে আমি আনন্দিত। আইন শেখার শ্রেষ্ঠতম স্থান হচ্ছে এই দেশ, অতীতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ, চিত্তরঞ্জন দাশ, চুন্দ্রিগড় প্রমুখ ব্যারিস্টার বিলেত থেকে পাস করে এক সময় ভারতবর্ষের রাজনীতির চাকা ঘুরাতেন। এর পরই তিনি বললেন, ‘আমারও একটা শখ ছিল আইনজ্ঞ হওয়ার। দেশ বিভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম, বই-পুস্তকও কিনেছিলেন, কিন্তু সে সময়টাতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করলাম, এর কিছু সময় পরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু হলে আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করলাম ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। একই বছর ১১ মার্চকে বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা করলাম। সেদিন আমাদের ওপর লাঠিচার্জ হয়েছিল, আমাকেসহ বেশ কয়কজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলন শুরু হয়েছিল যার ধারাবাহিকতায় পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন, এতেই লেখাপড়ার ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল, আইন পড়া হলো না। বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, যখনই লেখাপড়ার সময় এসেছে তখনই একের পর এক ঘটনায় জড়িত হওয়ার কারণে তা বিঘিœত হয়েছে। বি এ পরীক্ষার প্রস্তুতিকালে দুর্ভিক্ষের কারণে লাখ লাখ লোক যখন মারা যাচ্ছিল, তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা না করে লেখাপড়ার কথা ভাবা কোনো মানবিক মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, তিনি আইনজীবী হওয়ার জন্য আইন পড়ার সিদ্ধান্ত নেননি। আইনের সাহায্য দিয়ে ভুক্তভোগী মানুষের দুর্গতি লাঘব করার জন্যই তিনি আইনজ্ঞ হতে চেয়েছিলেন, যেমনটি করতেন শহীদ সাহেব, নেহেরু, গান্ধী, দেশবন্ধু প্রমুখ।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন আলাপকালে জানতে পেরেছিলাম, তিনি আইনে পড়াশোনা শেষ না করলেও আইনে তার জ্ঞান ছিল অবাক হওয়ার মতো। আমাদের ধারণা হলো তিনি সে সময়ের অন্যতম শীর্ষ আইনজ্ঞ শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সহচার্যের কারণেই এই দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাছাড়া পাকিস্তানি সময়ে তার বিরুদ্ধে এতবার মামলা করা হয়েছে যে তার জন্য আইন জানার কিছু বাকি থাকেনি। আগরতলা মামলায় তার পক্ষে লড়ার জন্য লন্ডনের বিখ্যাত ব্যারিস্টার থমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপকালেও তার বেশ কিছু শেখার সুযোগ হয়েছিল।

আইনজ্ঞ না হয়েও সংবিধান সংক্রান্ত আইনে বঙ্গবন্ধুর পারদর্শিতার প্রকাশ পেয়েছে আমাদের ১৯৭২-এর সংবিধানে। বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এই সংবিধানকে অনন্যতা দিয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো মাত্র নয় মাসে সেই সংবিধান প্রণয়ন, যেখানে প্রথম সংবিধান রচনা করতেই পাকিস্তানের প্রয়োজন হয়েছিল ৯ বছর এবং প্রখ্যাত আইনজ্ঞ বি আর আমবেদকারের নেতৃত্বে ভারতের সংবিধান রচনায়ও সময় লেগেছিল দুই বছর তিন মাসের মতো। আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে পৃথিবীর বিখ্যাত আইন বিশারদগণ এটিকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং ত্রুটিহীন সংবিধান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেখানে পাকিস্তানি, ভারতীয় এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানকে বহুবার সংশোধন করতে হয়েছে ত্রুটি দূর করার জন্য, সেখানে আমাদের সংবিধানের সংশোধনের হিসাব খুবই নগণ্য। যে সব সংশোধন হয়েছে তার প্রধান কারণ ছিল সামরিক হস্তক্ষেপ। ভারতীয় সংবিধান ১০৩ বার সংশোধন করা হয়েছে। পাকিস্তানের সংবিধান শুধু সংশোধন নয়, নতুন করে প্রণয়ন করা হয়েছে তিন তিনবার, আর ১৯৭৩ সালে প্রণীত সংবিধানও ২৫ বার সংশোধন করা হয়েছে।

৭২-এর সংশোধনের খসড়া তৈরির জন্য বঙ্গবন্ধু ৩৪ জনের কমিটি গঠন করলেও, খসড়া প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকায় যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে, সে কথা ব্যারিস্টার আমীরুল, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্তসহ ৩৪ জনের অনেকেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধান আনয়ন করে ওই ৩৪ জনকে বলে দিতেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানের কোন কোন বিধানগুলো বাংলাদেশের সংবিধানে প্রাধান্য পাবে। তাছাড়াও ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ যে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করেছিল তার বিধানগুলোও আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট করতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব জনাব তোফায়েল আহমেদ থেকে জানা গেছে যে খসড়াটি গণপরিষদ উপস্থাপনের আগের দিন বঙ্গবন্ধু ওই ৩৪ সদস্যের সঙ্গে ভাওয়ালস্থ এক রেস্ট হাউসে দিনভর বৈঠক করে খসড়াটির বিভিন্ন দিক নিয়ে শুধু আলাপই করেননি, বরং তিনি নিজে অনেক সংযোজন এবং সংশোধনও করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন, তার অন্যতমটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা; বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত যার নতুন ব্যাখ্যা বিশ্ববাসী লুফে নিয়েছে। সংবিধানে তিনি পরিষ্কার করেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাজনীতি চলবে না। তাছাড়া তার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল সংবিধানে মানবাধিকার এবং আইনের শাসন নিশ্চয়তা, যা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ, যথা শাসন, বিচার এবং আইন প্রণয়ন অঙ্গের স্ব-স্ব এখতিয়ার তিনি স্পষ্টভাবে সংবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট করেছেন। পাকিস্তানে আমলে ১৯৫০ সালে জমিদারি উচ্ছেদের জন্য যে আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেটির মৌলিক রূপরেখাও পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বঙ্গবন্ধু এবং হাশিম সাহেব প্রস্তুত করেছিলেন।

বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর সময়ক্ষেপণ না করে ‘প্রেসিডেন্টস অর্ডার’ নাম দিয়ে অজস্র অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হয়েছিল, যার মধ্যে মুখ্য ছিল শিল্প রাষ্ট্রীয়করণ, পরিত্যজ্য সম্পত্তি সংক্রান্ত আইন, নাগরিকত্ব আইন, ভূমির সর্বোচ্চ মালিকানা সম্পর্কীয় বিধান, বাংলাদেশ বিমান ইত্যাদি। তাছাড়া পাকিস্তানি দালালদের বিচারের জন্য তিনি কোলাবোরেটর অধ্যাদেশ নামে যা জারি করেছিলেন, তার বিধানসমূহ  ছিল সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন। এসব অধ্যাদেশের কোনোটিই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অনুমোদন ছাড়া পার হতে পারেনি। সেই আইন দ্বারা ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল এবং ৩০ হাজারের অধিক পাকিস্তানি ক্রীড়নককে গ্রেফতার করা হয়েছিল, অনেকের সাজাও হয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়া সেই আইন বাতিল করে দেয়। বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার আগে সংবিধানকে এমনভাবে সংশোধন করতে হবে যাতে তারা হাই কোর্টে রিট করে বিচার বিলম্বিত বা এমনকি নস্যাতও করতে না পারে। তাই তিনি কালক্ষেপণ না করে নির্দেশ দিয়েছিলেন সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে ৪৭-ক সংযোজন করা যাতে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রিট করে তাদের বিরুদ্ধে বিচার নস্যাত করতে না পারে। আর সেই মতেই ১৯৭৩ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ক’ উপঅনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শোনার সময় মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছিলাম সেই সংশোধনীর অপরিহার্যতা। আইনের জগতে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দেখা যায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্টে। তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন শ্রী মনোরঞ্জন ধর। কিন্তু আইনটি করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা, তত্ত্বাবধান এবং পর্যালোচনা সাপেক্ষে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন ক্লিনিকে আমাদের জানিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নুরেমবার্গে সনদের আদলে হলেও তার থেকেও বেশি স্বচ্ছতা থাকবে। কার্যত তিনি তাই করেছেন। নুরেমবার্গ সনদের বেশ কিছু উপাদান আমাদের ৭৩ সালের আইনে থাকলেও আমাদের আইনটি আরও স্বচ্ছ, আরও উন্নত যে কথা মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিশেষ দূত স্টিফেন রেপসহ অনেক বিশেষজ্ঞই ঢাকায় এসে প্রকাশ্যে বলেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার দেশি আদালতে, দেশে প্রণীত আইন দ্বারা করার জন্য অভাবনীয় ভাষাশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে এই আইনে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো এই যে আমাদের আইনটিই প্রায় হুবহু অনুসরণ করে আন্তর্জাতিক আইন কমিশন রোম সনদ তৈরি করা হয়েছিল, যারই সৃষ্টি ১৯৯৮ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আমাদের আইনটি প্রণয়নের পর আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সদস্যগণ ঢাকা এসেছিলেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (তখন সংসদ সদস্য)সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ এবং খোদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করেছেন বলে ব্যারিস্টার আমীর-উল থেকে জেনেছি। এটি আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার যে আমাদের আইন অনুকরণ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। লন্ডন ক্লিনিকে নুরেমবার্গ এবং টোকিও ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে অবাক না হয়ে পারিনি। আমি তখন মাত্র আন্তর্জাতিক আইন পড়া শুরু করেছি। সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম আইন পড়া শেষ না করে তিনি কীভাবে এত আইন জানেন। মৃদু হেসে বলেছিলেন জানার ইচ্ছা থাকলে কি কেউ থামাতে পারে? আরও বলেছিলেন কবিগুরু, নজরুল, লালন ফকিরগণের তো তেমন পড়াশোনা ছিল না, তারপরও তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে কতলোক গবেষণা করছে, পিএইচডি ডিগ্রি পাচ্ছে। বাঙালি মহাকবিদের মধ্যে কেবল মাইকেল মধুসূধন দত্ত এবং ডি এল রায় ব্যারিস্টার ছিলেন, তারপরও শেষ জীবনে মাইকেল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দেওয়া অর্থের ওপর নির্ভর করে বেঁচেছিলেন। তিনি বলেছিলেন শহীদ সাহেব, চুন্দ্রিগড় সাহেব, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সবশেষে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ব্যারিস্টার থমাস উইলিয়ামস কিউ সির সঙ্গে চলাফেলা করলে আইন জানতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুধু আইনের জগতে নয়, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যে তার জ্ঞান ছিল সমুদ্রতুল্য, তাও সেদিন আঁচ করেছিলাম।

গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তা তিনি শুধু জানতেনই না, দৃঢ়তার সঙ্গে অনুসরণ করেছেন। লন্ডন ক্লিনিকে আলাপকালেই জানতে পেরেছিলাম বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক এ ভি ডাইসি, যিনি আইনের শাসনের প্রথম সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, তার তত্ত্বের কথা বিস্তারিতভাবে জানতেন। তিনি মন্টেস্কো এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের তত্ত্ব এবং সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট তত্ত্বের কথাও আমাদের বলেছিলেন।  বিচারপতি মোর্শেদ এবং কায়ানির লেখাও তিনি পড়েছেন। আইনের শাসনের প্রতি তার আনুগত্য এত প্রবল ছিল যে সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতা শফিউল আলম প্রধান কয়েকজনকে হত্যা করলে বঙ্গবন্ধু কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তার ঘনিষ্ঠজন গমির উদ্দিন প্রধানের ছেলে শফিউল আলম প্রধানকে বিচারে দিতে, যে বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল, তবে জিয়া তাকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে এক কদর্যপূর্ণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি সর্বদা বলতেন আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। লিঙ্গের ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে, নৃতত্ত্বের ভিত্তিতে বৈষম্যকে তিনি শুধু সাংবিধানিকভাবেই নিষিদ্ধ করেননি, লিঙ্গের ভিত্তিতে মুসলিম বা হিন্দু নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিধান পরিবর্তন করে বৈষম্যহীন নারী নীতি ও তার পরিকল্পনায় ছিল। এমনকি পাকিস্তানি কলাবোরেটরদের ব্যাপারেও তিনি বলতেন কাউকে নিরপেক্ষ বিচার ছাড়া সাজা দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি এবং বিচক্ষণতার বড় দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তিতে। সেখানে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে বলেছিল, অতীত ভুলে যেতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই মর্মে নিজে কোনো অঙ্গীকারে না গিয়ে বিষয়টি দেশের জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই চুক্তি দ্বারা বঙ্গবন্ধু আমাদের পাওনা অর্থ এবং সম্পদ ফেরত দেওয়ার আন্তর্জাতিক আইনি দায়িত্ব থেকে এবং পাকিস্তান যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার ক্ষতিপূরণ প্রদান থেকে এবং ক্ষমা চাওয়ার দায় থেকেও পাকিস্তানকে নিষ্কৃতি দেননি।

স্বাধীনতার পর ভারতের সঙ্গে তিনি ২৫ বছরের যে বন্ধুত্ব চুক্তি করেছিলেন, সেটি যে কত গভীর দূরদৃষ্টির পরিচায়ক তা এখন মর্মে মর্মে বোঝা যাচ্ছে। এই চুক্তির কারণেই এখন ছিটমহল সমস্যাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হয়েছে। অথচ ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির লোকেরা তখন এই অপরিহার্য চুক্তিকে গোলামির চুক্তি বলেছিল। সরকারি কর্মকর্তাগণ যেন স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে জনগণকে হয়রানি করতে না পারে সে জন্য তিনি সংবিধানে ন্যায়পালের বিধান রেখেছিলেন। তিনি স্থানীয় সরকারকে গণমুখী এবং জনপ্রতিনিধিত্বমূলক করার জন্য প্রতি জেলায় জেলা গভর্নরের পদ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা স্পষ্ট করে সংবিধানে উল্লেখ করেছিলেন বলেই মাজদার হোসেন মামলার রায় দ্বারা সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের বিচারকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পেরেছেন। 

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, যার মাধ্যমে তিনি কৃষক-শ্রমিকের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, সেটি দেখেও বঙ্গবন্ধুর আইন বিষয়ক পান্ডিত্ব প্রকাশ পায়। এটি মার্কস-লেনিনের আদলে ছিল না। যারা একে স্বৈরতান্ত্রিক বলে থাকে তারা হয় এটি পড়েননি, অথবা অনুধাবন করতে পারেননি। প্লোরেটারিয়েটের ডিকটেটারশিপ বলে যে তত্ত্ব প্রচলিত ছিল, এতে তারও প্রতিফলন ছিল না। এতে ছিল এক বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ঐক্যের প্রেক্ষাপট যাতে সংশ্লিষ্ট সব মানুষকে সংযুক্ত করা হয়েছিল, যাতে সবাই মিলে মেহনতি মানুষের ইচ্ছায় দেশ শাসন করতে পারেন। এই সংশোধনীতে তিনি জনগণতন্ত্রের যে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেটিও ছিল অভূতপূর্ব। লন্ডন ক্লিনিকে বঙ্গবন্ধুর কথা শোনার সময়  কবিগুরুর লেখা লাইনটি বারবার মনে পড়ছিল, ‘আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি, তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী।’ আজ বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে কবিগুরুর লেখার অনুসরণে মনে হচ্ছে কত বড় মাপের প্রজ্ঞাবান ছিলেন এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, যাকে বিশ্ব কাঁপানো নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো হিমালয়সম বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

 

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর