বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

গণহত্যার বিবরণ প্রকাশিত হোক

জাফর ওয়াজেদ

গণহত্যার বিবরণ প্রকাশিত হোক

ঢাকার ৫৪ মালিবাগের বাসিন্দা শহীদ রেজাউল করিমের ২৭ বছর বয়সী ছেলে আবদুল করিম একাত্তরের ২৬ মার্চ সকালে প্রাণে বেঁচে যান। চারজন পাকিস্তানি হানাদার সেনা সকাল ১০টায় তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। এর আগে গুলি চালায় বাড়ির ছাদে পতপত করে উড়তে থাকা বাংলাদেশের লাল সবুজ রঙের হলুদ মানচিত্রখচিত পতাকাটিকে লক্ষ্য করে। বাড়িতে ঢুকেই হানাদাররা তাঁর বাবাকে বাঙালি কি না জিজ্ঞাসা করলে তিনি হ্যাঁ বলে মাথা নাড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর তাঁর অগ্রজকে একই প্রশ্ন করলে সেও হ্যাঁ-সূচক জবাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে। এরপর আবদুল করিমকে জিজ্ঞাসা করে, তিনি বাঙালি কি না? কৌশল অবলম্বন করে উর্দু ভাষায় বলেন, তিনি একজন অতিথিমাত্র। এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি হিন্দু কি না। মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় তাঁর। জানান, তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা একজন মুসলমান অতিথি। শুনে সেনারা চলে যায়। করিম এরপর ঢাকা ছেড়ে আগরতলায় চলে যান। সেখান থেকে জুনে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর মাতৃভূমিতে দখলদার হানাদার পাকিস্তানিরা যে বর্বরতা চালাচ্ছে, তা তুলে ধরে প্রতিকার চেয়েছিলেন।

চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ইছাখালী গ্রামের মিয়া তাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। একাত্তরের ১৭ জুন মানবাধিকার কমিশনের কাছে লেখা পত্রে উল্লেখ করেছিলেন, ২৫ মার্চ কালরাত্রির ভয়াবহতার কথা। হানাদার সশস্ত্র পাকিস্তানিরা রাতে হলে প্রবেশ করে এবং নির্মম নির্যাতন চালিয়ে উপস্থিত ছাত্রদের হত্যা করে। সপ্তাহখানেক পর ডাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক রবীন্দ্রসংগীত ও গণসংগীতশিল্পী ইকবাল আহমদকে তাঁর অনুজসহ আটক করে। তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি (এখানে উল্লেখ্য, ইকবাল আহমদ পালাতে পেরেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন) ঢাকার মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির এফ-২/৩নং বাসার বাসিন্দা ছিলেন নুরুল আমিন। চাকরি করতেন মগবাজার ওয়্যারলেসে। একাত্তরের ২২ জুন মানবাধিকার কমিশনকে লেখা পত্রে উল্লেখ করেছেন, পঁচিশে মার্চ ও পরবর্তী দুই মাস হানাদারদের ঢাকা শহরে পরিচালিত বর্বরতার ঘটনা। উর্দুভাষী অবাঙালিরা অন্যান্য জেলা থেকে ঢাকায় এসে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট কীভাবে দখল করে নিয়েছে, এর বর্ণনাও দিয়েছিলেন। ঢাকার কালীগঞ্জের একুশ বছর বয়সী আবদুল কাদের মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন মালিবাগে। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে পাকিস্তানি হানাদারদের অপারেশন সার্চলাইট নামক পাশবিকতার ঘটনা তুলে ধরেছেন তিনি। ২৬ মার্চ তিনি ক্যাম্পাস ও হলে যান এবং পরিস্থিতি দেখতে পান। শহীদ মিনারের পাশের মসজিদসহ মিনার ভেঙে ফেলার দৃশ্য দেখে তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন, এরপর গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানেও হানাদারদের বর্বরতা চলে। সেসব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ২১ জুন মানবাধিকার কমিশনকে লেখা পত্রে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদনও ছিল।

ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির ৪/বি-এল নং বাসার অধিবাসী দীপালী রানী সরকার ২৪ জুলাই মানবাধিকার কমিশনকে লেখা চিঠিতে জানান, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হানাদাররা তার বাড়ি লুট করে। আশপাশের বাড়ি থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়। যারা আর ফেরেনি। দীপালী রানী প্রতিবেশীর সহায়তায় পালিয়ে চলে যান সীমান্তের ওপারে। তিনি সদরঘাট, ডেমরা এলাকায় পাকিস্তানিদের বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছেন তার পত্রে। একাত্তর সালের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত হানাদারদের নির্যাতনের মুখে কৌশলে পালাতে পারা বাঙালি নারী-পুরুষ জেনেভায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে কয়েক হাজার পত্র লিখেছিলেন। কমিশন সে সময় পাকিস্তানিদের মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে খুব যে সোচ্চার হতে পেরেছিল, তা নয়। শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তারা তেমনভাবে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল এবং নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে বাঙালি নিধনে মত্ত ছিল, তা অস্বীকার না করলেও এর প্রতিকারে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে তাদের দফতরে যেসব দলিলদস্তাবেজ রয়েছে, তা গণহত্যার বিবরণ তৈরিতে যথেষ্ট সহায়ক অবশ্যই। যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বিচারের দাবিতে এবং ধর্ষিতদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে কমিশন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য নানা দেশ ও সংগঠন তৎপর ছিল। মানবাধিকার কমিশন বিচারের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়নি। বাঙালিকে তার নিজস্ব শক্তিমত্তা, মানসিক সাহসে ভর করে হানাদার নিধনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল সেদিন।

পাকিস্তান ট্যাকসেশন সার্ভিসের কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান খন্দকার থাকতেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের ভাড়া বাড়িতে। অবাঙালি উর্দুভাষী বিহারি অধ্যুষিত মোহাম্মদপুরে বাঙালিরাও বসবাস করতেন। ১৭ মার্চের পর থেকে বিহারিরা কিরিচ, রাম দা, তলোয়ার হাতে এলাকায় রাতে মিছিল বের করত প্রায়শই। তারা বাঙালিদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দিত। মনিরুজ্জামান খন্দকার স্ত্রী ও দুই পুত্র-কন্যা নিয়ে ভয়ে ভীত ছিলেন। পড়শি এক অবাঙালি সরকারি কর্মকর্তা ২৫ মার্চ সকালে তাঁকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। নতুবা বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলেও জানান। অস্ত্রধারী বিহারিরাও ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় তাঁকে হুমকি দেয় জানে মেরে ফেলার। তিনি ২৫ মার্চ সকালে এলাকা ত্যাগ করে পুরান ঢাকার শরৎগুপ্ত রোডে আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে খোঁজ পান, মোহাম্মদপুরে তাঁর প্রতিবেশী বাঙালিদের কেউ বেঁচে নেই। নারী, শিশু, পুরুষ-নির্বিশেষে ঘরে ঘরে ঢুকে বিহারিরা বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। যেমন, জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় চড়াও হয়ে গায়ক সাদী মোহাম্মদের বাবা মোহাম্মদ সলিমুল্লাহকে আরও কয়েকজন বাঙালিসহ হত্যা করেছিল। মোহাম্মদপুর, মিরপুরসহ বিহারি অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের অধিকাংশই গণহত্যার শিকার হয়েছেন। খুব কমজনই বাঁচতে পেরেছিলেন। যারা বেঁচেছিলেন, তাঁরা স্বাধীনতার পর সেই দুঃসহ সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন সংবাদপত্রের কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডক্টর আজহার আলী ২৫ মার্চ রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের ১৪/এইচ ফ্ল্যাটে সপরিবারে থাকতেন। রাত ১২টার পর থেকে চারদিক থেকে অকস্মাৎ বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলিবর্ষণের বিভীষিকাময় শব্দে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ভোরে পাঞ্জাবি সেনারা ১১ ও ১২ নম্বর ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। তাঁর ফ্ল্যাটের নিচতলায় থাকতেন ডা. মুর্তজা। তাঁকেসহ আরও তিনজনকে ১২ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে লাশ তুলে বাইরে রাখার নির্দেশ দেয় সেনারা। ডা. মোকতাদিরসহ আরও অনেক ছাত্রের লাশ ঘর হতে বের করেন তারা। এরপর সেনারা ১১ নম্বর ফ্ল্যাটে ঢুকে ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেককে হত্যা করে। ২৭ মার্চ পর্যন্ত লাশটি পড়েছিল। সেনারা আজহারের বাসায় ঢুকতে গিয়েও ফিরে যায় বলে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।

 

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুবেদার খলিলুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে মিলব্যারাক পুলিশ লাইনে কর্তব্যরত থাকায় বেঁচে যান। ২৯ মার্চ তাঁকে কোতোয়ালি থানায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে দেখতে পান দেওয়ালে, মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে দেওয়াল। বুড়িগঙ্গার পাড়ে অসংখ্য মানুষের মৃতদেহ দেখেন, কনস্টেবল আবু তাহেরের (নম্বর ৭৯৮) পোশাক পরা লাশ ভাসছে। আরও বহু সিপাহির ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান। আরও দেখেন বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধা-যুবা, যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশুর অসংখ্য লাশ। বাদামতলী ঘাট থেকে শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অসংখ্য মানুষের বীভৎস পচা ও বিকৃত লাশ; অনেক উলঙ্গ নারীর লাশ দেখেন। এই পূতপবিত্র দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ করে গুলিতে ঝাঁজরা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। দেখেন তিনি প্রতিটি লাশে বেয়নেট ও বেটনের আঘাত। কারও মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আছে। পাকস্থলীসমেত হৃৎপি- বের করা হয়েছে, পায়ের গিঁট; হাতের কবজি ভাঙা, ফুলছে পানিতে। সুবেদার খলিলুর রহমান ১৯৭৪ সালে ২ জুন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানের যে বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, তা হানাদারদের নৃশংসতার এক দলিল বলা যায়। দেখেছেন তিনি পুরান ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় লাশ আর লাশ এবং বিহারিদের উল্লাস ও উন্মত্ত লাফঝাঁপ। হানাদারদের নির্বিচারে বাঙালি হত্যার খুশিতে বিহারিরা রাস্তায় পড়ে থাকা নিরীহ বাঙালিদের লাশের ওপর লাথি মারছে, কেউ প্রশ্রাব করছে। সরু বাঁশের মাথায় বাঙালি বালক ও শিশুর লাশ বিদ্ধ করে খাড়া করে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ লাশগুলোকে দা দিয়ে কুপিয়ে কুচি কুচি করে কেটে আনন্দ করছে। রাস্তার দুই পাশের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট শেষে বিহারিরা ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঠাটারীবাজারে বাঙালি তরুণের বীভৎস লাশের ওপর পেট চিরে বাঁশের লাঠি খাড়া করে লাঠির মাথায় স্বাধীন বাংলার একটি মলিন পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর বিহারিরা উল্লাস করছে। একটি লাশের গুহ্যদ্বার দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। রমনা থানার সাব-ইনসপেক্টের ছিলেন মতিউর রহমান, ২৫ মার্চ রাতেই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী গুলিবর্ষণ করতে করতে থানায় ঢুকে পড়ে। বাঙালি পুলিশও পাল্টা গুলি করতে থাকে। সারা রাত হানাদারদের প্রতিরোধ করতে পারলেও ভোরে থানার কলোনি ঘেরাও করে কাউকে হত্যা এবং কাউকে বন্দী করে। লাথি মারতে মারতে থানার পশ্চিম দিকের মাঠে নিয়ে গিয়ে ‘নজর নিচা দে কর মিট্টি মে শো যাও’ বলে উপুড় করে লাথি মেরে শুইয়ে দেয়। টানা তিন ঘণ্টা এলোপাতাড়ি পেটানো হয় তাদের। আর অকথ্য গালাগালি করতে থাকে এই বলে যে, ‘শালা মালাউন, শোয়ার কা বাচ্চা, আভি জয় বাংলা বলতা নেহি। শালা কাফের, হিন্দুকা লাড়কা, তোমহারা মুজিবর বাবা আভি কাহা হায়?’ পিটুনির চোটে অনেকে জ্ঞান হারায়, কারও হাত-পা ভেঙে যায়।

ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক ২৬ বছর বয়সী সাইমন ড্রিং ৩০ মার্চ যে প্রতিবেদন পাঠান, তাতে উল্লেখ করেছেন, ইকবাল হলে প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত। সেনারা ছাত্রাবাস ভবনে শেল বর্ষণের পাশাপাশি ছাত্রাবাসের কক্ষগুলোতে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে। ওইসব নিহতের লাশ হামলার দুই দিন পরও তাদের ভস্মীভূত রুমেই পড়েছিল। ছাত্রাবাসের বাইরেও অনেকের লাশ পড়ে আছে এবং সেখানকার একটি পুকুরে অনেকের লাশ ভেসে রয়েছে। চারুকলার একজন ছাত্রের লাশ হাত-পা ছড়ানো অবস্থায় তার ক্যানভাসের সামনেই পড়ে আছে। এরকম আরও বহু হত্যাযজ্ঞের বিবরণ দিয়েছেন তিনি ২৫ মার্চ ও পরবর্তী সময়ের।

লন্ডন অবজারভারের প্রতিনিধি স্মিথ ঢাকা ঘুরে শেষে কলকাতা থেকে ১৭ এপ্রিল পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, হত্যাযজ্ঞের পরের দিন, নোংরা মোটাতাজা, কালো কাকের সংখ্যা শহরে দ্বিগুণ কলে মনে হয়েছে। আর যদিও মৃতদেহগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তবুও ফাঁকা রাস্তাগুলোতে অসংখ্য কাক কা কা করতে করতে উড়ে বেড়াচ্ছে।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে যে গণহত্যা শুরু হয়, তা ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের পরাজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সেসব হত্যাযজ্ঞের বিবরণ লিখে শেষ করা যাবে না। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও নির্যাতনের ধরন সভ্যতা বিবর্জিত মানুষের নির্মমতা এবং নৃশংসতার চেয়েও জঘন্য ছিল। তাদের নির্যাতনের রূপ নির্যাতিতদের কাছ থেকে যা পাওয়া গেছে, তা বীভৎস ও ভয়াবহতারই নামান্তর। সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে দেখামাত্র গুলি করত। শক্তসমর্থ, তরুণ ও যুবকদের রাস্তা কিংবা বাড়িঘর থেকে বন্ধী করে এনে চোখ বেঁধে সমষ্টিগতভাবে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের পর শারীরিক নির্যাতন করা এবং পরিশেষে পেছনে হাত বেঁধে কখনো এককভাবে, কখনো কয়েকজনকে একসঙ্গে গুলি করে নদী, জলাশয় বা গর্তে ফেলে দিত। কখনো সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করত। কখনো নিকটজনের সামনেই বন্দীদের একেক করে গলা কেটে এবং দেহ টুকরো টুকরো করা হতো। প্রকাশ্যে বিভিন্ন অঙ্গচ্ছেদ করা অথবা বিভিন্ন অঙ্গে গুলি করে হত্যা করত। চোখ উপড়ে ফেলত। উলঙ্গ অবস্থায় উলটা করে ঝুলিয়ে রেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চামড়া ছিলে ফেলত। বস্তায় ঢুকিয়ে বস্তার মুখ বেঁধে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা বা বস্তাবন্দী অবস্থায় নদীতে ফেলে দিত। বাঁশ এবং রোলারের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ চেপে ধরে থেঁতলে দিত। বেয়নেট ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট এফোঁড়-ওফোঁড় করে, কখনো পেটের সব নাড়িভুঁড়ি বের করে কিংবা বুক চিরে হৃৎপি- উপড়ে ফেলত। দড়ি দিয়ে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারত। বয়লারে নিক্ষেপ করে হত্যা ছিল মামুলি ব্যাপার। মলদ্বার ও আশপাশের স্থানে বরফ ও উত্তপ্ত লোহা ঢুকানো হতো। গায়ে ও মলদ্বারে বৈদ্যুতিক শক প্রদান, আঙুলে সুঁচ ফোটানো, নখ ও চোখ উপড়ে ফেলা, যৌনাঙ্গে লাঠি, রাইফেলের নল, ধারালো বোতলজাতীয় জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। অ-কোষ থ্যাঁতলে মৃত্যুযন্ত্রণা প্রদান, বাঁশডলা, বরফের চাঙরে শোয়ায়ে পেটানো, সিগারেটের আগুনে ছেঁকা দেওয়া ইত্যাদি অজস্র পদ্ধতি ছিল নির্যাতনের।

একাত্তরে বাংলাদেশে বিশ্ব ইতিহাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা ঘটিয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। কেবল বাঙালি হয়ে জন্মানোর দায়ে পাকিস্তানি হানাদাররা নৃশংস গণহত্যার যে দৃষ্টান্ত এদেশে রেখে গেছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। অত্যাচারের যেসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া তারা উদ্ভাবন করেছিল। তার মধ্যে গুলিতে হত্যা করাই ছিল সবচেয়ে শান্তির মরণ। তাদের অপকর্ম চাপা দেওয়ার জন্য একাত্তরে দখলদার পাকিস্তানিরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের সংকট’ শিরোনামে। হাজার পৃষ্ঠার এই শ্বেতপত্রে শেখ মুজিব, আওয়ামী লীগ, নির্বাচন, ভারত সম্পর্কে পাকিস্তানি জান্তা শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মিথ্যাচার বিধৃত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ দিনগত রাতে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বিদ্রোহ সংঘটন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের অভ্যুত্থান বাস্তবায়িত করার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনীকে তাদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। পুরো শ্বেতপত্রে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অসত্য, কল্পিত বিষয়াদি তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত নিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর হলেও গৃহীত এই সিদ্ধান্ত বাঙালিকে আরও আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছে। কিন্তু নতুন প্রজন্ম অবহিত নয়, গণহত্যার সেই দুঃসহ রাত সম্পর্কে। তাই সেদিনের ঘটনাগুলো নিয়ে তরুণদের জানানো উচিত। উচিত শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। একই সঙ্গে গণহত্যার সাক্ষী যারা, তাদের বিবরণ তুলে ধরা। বীরের জাতির জন্য এই পদক্ষেপ জরুরি।

২৫ মার্চ যে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ চালিয়ে ছিল পাকিস্তানি হানাদাররা, সেই ইতিহাস সব শিক্ষার্থীর জানা সংগত। তাই সেসব তথ্য সন্নিবেশিত করার কাজটি মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীকালেও করা যায়। ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের দাবি বাঙালি করে আসছে। হয়তো তা স্মরণ হবে একদিন। আর সে জন্য প্রয়োজন গণহত্যার তথ্যাদি গ্রথিত করা।

 

লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

সর্বশেষ খবর