শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা

৭ জুন ঐতিহাসিক ছয়দফা দিবস। ১৯৬৬ সালের এ দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। এ দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে তৎকালীন পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ ১০ বাঙালি শহীদ হন। এরপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আপসহীন সংগ্রামের ধারায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যায় পরাধীন বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি। 

প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। গেল বছর করোনা কভিড-১৯ ভাইরাসজনিত পরিস্থিতির কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জনসমাগম পরিহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। আওয়ামী লীগ ‘ঐতিহাসিক ছয়দফা দিবস’ যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করে। তবে এ বছর বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে সৃষ্ট সংকটে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে সব ধরনের জনসমাগমপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দেশবাসীকে ঐতিহাসিক ৭ জুনের সব বীর শহীদ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র ও প্রগতি প্রতিষ্ঠায় আত্মদানকারী শহীদ সন্তানদের আত্মার শান্তি কামনা করে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করা হয়। স্মরণ করা হয় ১৯৭১-এ সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের। ঐতিহাসিক ছয়দফা নিয়ে ২৬ আগস্ট ২০২০-এর এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব সময় (ছয়দফা দাবি সম্পর্কে) তাঁর চিন্তাভাবনার কথা লিখে রাখতেন এবং এগুলোও তিনি তাঁর সহকারী মোহাম্মদ হানিফকে টাইপ করে রাখতে বলেন। একমাত্র হানিফই জানতেন যে, ছয়দফা আর কারও নয়, একমাত্র বঙ্গবন্ধুর একান্ত চিন্তাধারার ফসল। আর কেউ এটা জানত না।’ এ কথার মধ্য দিয়ে প্রমাণ মেলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি রচনার ঐকান্তিক ও একান্ত সংকল্পগুলো জাতির জনক নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন। ছয়দফা আসলে কি-এ বিষয়ে বর্তমান প্রজন্ম তেমন অবগত নয়। এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনাও হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা জাতির সামনে তুলে ধরতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উৎসাহিত করার জন্য তাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে ছয়দফা দাবি উত্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু, তাঁকে তা করতে বাধা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন এবং বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের কাছে সংক্ষেপে ছয়দফা দাবি তুলে ধরেন। ছয়দফা দাবিতে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ও দলের জাতীয় সম্মেলনে ছয়দফা গৃহীত হয়েছিল। পরে দেশব্যাপী ছয়দফা দাবি প্রচারের পদক্ষেপ নেন এবং একের পর এক জনসভা করতে থাকেন।’ (শেখ হাসিনা, ২৬ আগস্ট ২০২০) আসলে ছয়দফা প্রস্তাবের ফলে পাকিস্তানি শাসকের ভীত কেঁপে ওঠে। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয়দফা উত্থাপন করেন এবং পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজক পক্ষ গুরুত্ব দেননি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে যোগ না দিয়ে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয়দফা উত্থাপন করেন। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেন,

‘ছয়দফা’ দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ১৯৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিতে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয়দফাকে ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলশ্রুতিতে ১১ দফা আন্দোলনের পক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণি গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করে। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে বলেছিলাম, ‘পূর্ব বাংলার মানুষ কোনো দিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারও পূর্ব বাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’ (৭ জুন ২০১৯, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম)

বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে যে দাগ লেপনের চেষ্টা করা হয় তা কালের বিচারে চূর্ণ হয়ে যায়। কারণ তিনি পাকিস্তানি শাসকদের হিম্মত নড়িয়ে দেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয়দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয়দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। মূলত ছয়দফা ছিল-

১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;

২. ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে;

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সংবলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;

৪. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;

৫. দুই অংশের মধ্যে দেশীয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।

৬. প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্ব^ী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পকিস্তান থেকে ঢাকায় ফিরে ১৩ মার্চ ১৯৬৬-তে ছয়দফা এবং এ ব্যাপারে দলের অন্যান্য বিস্তারিত কর্মসূচি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে পাস করিয়ে নেন। ওই অধিবেশনে তিনি দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। প্রথম দফার হাহাকারের জবাবে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন : “ইহাতে আপত্তির কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সব নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন (পাকিস্তানের পক্ষে ম্যান্ডেট) এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ এক বাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়াছিলেন এই প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি যে একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল, লাহোর-প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি।...কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনো নতুন দাবি তুলি নাই; পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবিরই পুনরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন, তাঁরা হয় পাকিস্তান-সংগ্রামে শরিক ছিলেন না, অথবা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি-দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমি স্বার্থীদের দালালি করিয়া পাকিস্তানের অনিষ্ট সাধন করিতে চান।”

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয়দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ছয়দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় উত্তর দেওয়া হবে। এদিকে ছয়দফা কর্মসূচি জনগণের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সমগ্র পূর্ববাংলা সফর করেন এবং ছয়দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন। ফলে শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য নেতাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। যশোর, ময়মনসিংহ ও সিলেটসহ অন্যান্য কয়েকটি স্থানে ছয়দফার পক্ষে প্রচারকালে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন।

ছয়দফার দুই নম্ব^র দফা সম্পর্কে জাতির জনক বলেছিলেন : “এই প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশি চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি।...আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে ‘প্রদেশ’ না বলিয়া ‘স্টেট’ বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকেরা জনগণকে এই বলিয়া ধোঁকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, ‘স্টেট’ অর্থে আমি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেট’ বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশনেই ‘প্রদেশ’ বা ‘প্রভিন্স’ না বলিয়া ‘স্টেটস’ বলা হইয়া থাকে। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকে ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মেনি, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাদের প্রদেশসমূহকে ‘স্টেট’ ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে।” জাতির জনকের এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের সংঘবদ্ধ ও ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক ছয়দফাভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। এ দাবির সপক্ষে বাঙালি জাতির সর্বাত্মক রায় ঘোষিত হয় ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বাঙালিরা বিজয়ী করে।

অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর দলকে জনগণ বিজয়ী করলেও স্বৈরাচারী পাক শাসকরা বিজয়ী দলকে সরকার গঠন করতে না দিলে আবারও বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। ছয়দফাই এনে দিয়েছে আমাদের তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এতই প্রখর ছিল যে, তিনি ছয়দফাকে এক দফার দাবিতে পরিণত করে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলনের ডাক দেন। ছয় দফার সময়ে এটা কেবল স্বায়ত্তশাসনের দাবি, অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি না-এমন বিতর্ক ছিল। তিনি বলেন, ’৭০-এর নির্বাচন ছিল ছয়দফার প্রশ্নে ম্যান্ডেট। বাংলার স্বাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর ছয়দফার সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করে এবং পরবর্তীতে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলা যেতে পারে, ছয়দফার মাধ্যমে আমাদের ন্যায্যতা সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়। আওয়ামী লীগের পরামর্শদাতা ও দলের মুখপত্র ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন : ‘ছয়দফার কোনো কোনো দফা আমি সমর্থন করি না সত্য, কিন্তু ছয়দফা ভালো কি মন্দ, সেই প্রশ্ন মুলতবি রাখিয়াও আমি বলিতে চাই যে, এই কর্মসূচি সাধারণ্যে প্রকাশ করিবার পূর্বে আমার সাথে কেহ কোন পরামর্শ করে নাই।’ (পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর, ঢাকা, ২০০৭)

ছয়দফা প্রণয়ণকালে আমি তখন শিক্ষার্থী। আমি ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম। আমরা অনুভব করতাম, ছয়দফা কর্মসূচির ফলেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। ৭ জুন ছিল এর সূচনাবিন্দু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয়দফা একটি অন্যতম মাইলফলক।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর