রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ব্যাংক এগিয়ে এলে মোটরসাইকেল শিল্প হবে অর্থনীতির বড় খাত

বিপ্লব কুমার রায় :- সিইও, টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যাংক এগিয়ে এলে মোটরসাইকেল শিল্প হবে অর্থনীতির বড় খাত

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে মোটরসাইকেল শিল্পের বড় প্রতিষ্ঠান টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড তাদের বাজার সম্প্রসারণ করছে।  প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কথা হয় টিভিএস অটোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার রায়ের সঙ্গে। টিভিএস মোটরসাইকেলের বিশেষত্ব নিয়ে বিপ্লব কুমার রায় বলেন, টিভিএসের সাফল্যের একটি বড় নেপথ্য পটভূমি হচ্ছে গ্রাহক চাহিদার দৈনন্দিন পরিবর্তনশীল ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এর উৎপাদন ও নকশা-গবেষণার কৌশলপট বিন্যস্ত করা হয়। নতুন ডিজাইন, ডিজাইন নবায়ন, উদ্ভাবনা, মূল্য সংযোজনামূলক অগ্রগতি- এসব মিলিয়ে বাংলাদেশের অটোমোটিভ শিল্পের ইতিহাসে নজিরবিহীন রেকর্ড গড়েছে টিভিএস। বর্তমানে আমাদের গ্রাহকসেবা দেশব্যাপী ১১টি নিজস্ব শোরুম এবং ২৫০টির অধিক ডিলার নেটওয়ার্কে বিস্তৃত। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ‘থ্রি-এস’ সুবিধা অর্থাৎ সেলস, সার্ভিস এবং স্পেয়ার পার্টস। এছাড়া সারা দেশে টিভিএসের রয়েছে ১০০০-এরও বেশি সার্টিফাইড সার্ভিস পয়েন্টস (সিএসপি), ১৫০টির অধিক পার্টস ডিলার এবং হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষিত মেকানিকের এক অটুট নেটওয়ার্ক। সার্ভিসের এই পদ্ধতিটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা প্রতিনিয়ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী এর সংখ্যাও বৃদ্ধি হয়।

করোনার সময় মোটরসাইকেল শিল্পের সংকট সম্পর্কে শুরুতেই বিপ্লব কুমার রায় বলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে একটু  পেছনে ফিরে যেতে হবে। মূলত উৎপাদনের শর্ত দিয়ে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে সরকার মোটরসাইকেল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয়। ফলে আমরা মোটরসাইকেলের দাম কমানোর সুযোগ পাই। ২০১৫ সালে মোটরসাইকেলের মার্কেট ছিল ২ লাখের মতো। ২০১৯-এ এটি সাড়ে ৫ লাখে উঠে আসে। ২০২০ সালে আমরা আশা করছিলাম মোটরসাইকেলের মার্কেট সাড়ে ৬ লাখে পৌঁছাবে। কিন্তু করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেলের বিক্রি কমে ১১ শতাংশের মতো। আর ২০২১ সালে অবস্থা আরও খারাপ। প্রতি বছর মার্চ থেকে পবিত্র ঈদুল আজহা পর্যন্ত ভালো বেচাকেনার সময়। এ সময় কৃষকের প্রধান ফসলগুলোর একটি বোরো ধান ঘরে ওঠে। পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মিলিয়ে বাজার থাকে চাঙা। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই প্রধান সময়ে আমরা কোনো শোরুম ঠিক মতো খুলতেই পারিনি। এখন শোরুম খোলা কিন্তু করোনার ধাক্কায় মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ নেই যে তারা মোটরসাইকেল কিনবে। তবে সামনের মাসগুলোতে আমরা ভালো বিক্রির আশা করছি। আশা করছি খুব দ্রুতই মোটরসাইকেল খাত সংকটকাল কাটিয়ে উঠতে পারবে।

অন্যান্য শিল্পে যেভাবে আঘাত এসেছিল মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে সেই প্রভাব নিয়ে টিভিএস অটোর সিইও বলেন, অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে এটি মাঝামাঝি পর্যায়ে আছে। আমার এই বক্তব্যটির মানে হচ্ছে মোটরসাইকেল শিল্পটি কোনো শিল্পের তুলনায় খারাপ ছিল আবার অনেক শিল্পের তুলনায় ভালো অবস্থানেও ছিল। করোনা পরবর্তীতে বর্তমানে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে খরচ বেড়ে  গেছে অনেক। এর কারণ বিশ্বব্যাপী কনটেইনার ভাড়া ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সেই ধাক্কা সামলে সারা দেশে মোটরসাইকেলের আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে টিভিএস।

সরকারের কাছে কিছু ব্যাপার উত্থাপন করে বিপ্লব কুমার রায় বলেন, এই শিল্পে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যেগুলোর নিরসন দরকার। আমাদের দেশে মোটরসাইকেলের দাম পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় এখনো বেশি। আরোপিত শুল্কের কারণে দাম বেশি পড়ছে। মোটরসাইকেলের দামের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য খরচ যুক্ত করলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পণ্যটির দাম সবচেয়ে বেশি। এ দেশে প্রতি ৯৭ জনে একজন মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। ভারতে প্রতি ২০ জনে একজন, আর পাকিস্তানে প্রতি ১৭ জনে একজনের মোটরসাইকেল রয়েছে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে মোটরসাইকেলের ব্যবহার আরও বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশে যে জনসংখ্যা, এর ব্যাপক সম্মুখ বৃদ্ধির কথা হিসাবে না ধরলেও, গড়ে বছরে অন্তত ১০ লাখ বাইক বিক্রি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে চলতি মূলধন। এই বিষয়টি দুটি ক্ষেত্রে সহজলভ্য করতে হবে। প্রথমত, যারা এই শিল্প নিয়ে কাজ করে তাদের সহজ শর্তে স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়া ও দ্বিতীয়ত, এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ নিয়ে যারা কাজ করতে চায় তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান। চতুর্থ প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ সুবিধা। উপমহাদেশের প্রায় সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানই মোটরসাইকেল ক্রয়ের জন্য স্বল্পসুদে ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়। যা আমাদের দেশে এখনো দুরূহ। ভিয়েতনামের একটি ব্যাংকের মোটরসাইকেল পোর্টফোলিও আড়াই শ কোটি ডলারের। আমরা বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছি। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখনো পর্যাপ্ত অর্থায়নে বর্তমান ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে যেখানে এ শিল্পের বিকাশে রিটেইল ফাইন্যান্সের ভূমিকা সর্বাগ্রে বিরাজমান। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু ও বুনিয়াদি রিটেইল ফাইন্যান্স নীতিমালা যা এ শিল্পের বিকাশ ও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। তারা বাইকারদের অর্থায়নে আরও এগিয়ে এলে বাইক বিক্রি বাড়বে। তিনি আরও বলেন, এ বছরে মার্কেটের যে অবস্থা তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করছি মোটরসাইকেলের বিক্রি প্রায় ৫ লাখে পৌঁছবে। যদি একটি মোটরসাইকেলের মূল্য গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ধরি তাহলে এ শিল্পে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে যে মোটরসাইকেল কারখানা হতে পারে, দেশেও উৎপাদন হতে পারে, তা এখন প্রমাণিত। টিভিএস এখন দেশেই তৈরি হয়। মোটরসাইকেল তৈরিতে ইঞ্জিন থেকে শুরু করে চেইন, সিট কভার ও অন্য নানা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের প্রয়োজন পড়ে। এ প্রয়োজন মেটাতে ভেন্ডরনির্ভর ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

দেশে এ উপাদানগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে না উঠলে দেশীয় মোটরসাইকেল শিল্প বিকাশ করা দুরূহ ব্যাপার। এ বিষয়ে মূলত তিনটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা জরুরি বলে আমি মনে করি। প্রথমত, সহজ শর্তে ঋণ, দ্বিতীয়ত, কাঁচামাল আমদানি ক্ষেত্রে শুল্কে ছাড় ও তৃতীয়ত, কর সুবিধা। এই তিনটির সমন্বয় ঘটানো গেলে খুব সহজেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ট্রাস্ট, ভ্যালু, সার্ভিস ও এর মাধ্যমে ‘ক্রেতা সন্তুষ্টি’ অর্জনই আমাদের মূল লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। বিগত বছরগুলোতে আমরা যেমন তরুণদের কাক্সিক্ষত নতুন নতুন ফিচার সমৃদ্ধ বাইক বাজারে নিয়ে এসেছি, আগামী দিনগুলোতেও আমাদের একই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

সর্বশেষ খবর