রবিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবা মাননিয়ন্ত্রণ পরিমাপের জন্য কোনো সংস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। পাশের দেশ ভারত, মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশের নিজস্ব মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। এ বিষয়ে নজর দেওয়া সময়ের দাবি।

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে যাচ্ছে দেশ

কভিড-১৯ মহামারীর থাবায় আক্রান্ত দেশ। পরিস্থিতি সামলাতে দেশের সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। দেশে ৬৫ শতাংশের বেশি রোগী চিকিৎসাসেবা নেয় বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকে।  উন্নত, আধুনিক, বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবায় প্রায় ৬৫ ভাগ সেবা নিশ্চিত করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশেই শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সরকারকে সহযোগিতা করছে। করোনাকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশের মানুষের কল্যাণে যে সেবা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার দাবিদার।’ তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসার গুণগত মানোন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে তদারকি প্রয়োজন। সুষ্ঠু সেবা নিশ্চিতে এ পদক্ষেপ জরুরি। এ জন্য স্বাস্থ্যসেবা ঢেলে সাজাতে হবে। করোনার সময় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনবল সংকট প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিল। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে জনবল প্রয়োজন তা আমাদের নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি রয়েছে বেসরকারি পর্যায়েও। স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা নিরসনে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিকায়নের সঙ্গে গুণগত মান বাড়াতে নজর দেওয়া জরুরি।’   

স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. নুরুল আমিনের ‘রোগীর নিজ পকেট থেকে চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান’ শীর্ষক গবেষণায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেবা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে। তার গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম। কিন্তু মাত্র ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র (৫ দশমিক ২২ শতাংশ), উপজেলার নিচে (৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ), জেলা হাসপাতাল ও মাতৃসদন (৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ), মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল (১ দশমিক ৮৭ শতাংশ) এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান (০ দশমিক ০৯ শতাংশ)। ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। চিকিৎসাসেবায় বড় অবদান রেখে চলেছে বেসরকারি খাত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তিন ধরনের। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং দেশি বা বিদেশি এনজিওচালিত প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই বেশি। চিকিৎসার পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষাতেও তারা বড় ভূমিকা রাখছে। এখন সরকারি মেডিকেল কলেজ যত রয়েছে, তার দ্বিগুণ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, জনবলের অপ্রতুলতার কারণে মানুষের বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি উৎসাহ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, রোগীর সংখ্যা বাড়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু অনেকগুলোই মানসম্মত নয়। একদিকে যেমন পাঁচ তারকাবিশিষ্ট বিলাসবহুল হাসপাতাল রয়েছে, তেমনই রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ক্লিনিক। বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ১৮৩। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১ হাজার ১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২টি, ঢাকার বাইরে ১১০টি) আর বেসরকারি হাসপাতালে রয়েছে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরে ৪৯৪টি, ঢাকা জেলায় ২৬৭টি, অন্যান্য জেলায় ২৪৩টি)। তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের চিকিৎসার মান নিয়ে এখনো রয়েছে নানা অভিযোগ। কিডনি, লিভার ট্রান্সপ্লান্টের মতো জরুরি চিকিৎসায় রয়েছে আইনি জটিলতা। ক্যান্সার চিকিৎসায় এখনো রয়েছে প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনবলের সংকট। স্বাস্থ্যবীমা না থাকায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে অসহায় অবস্থায় পড়তে হচ্ছে মানুষকে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা এভারকেয়ার হসপিটালের হেড অব মেডিকেল সার্ভিসেস ডা. আরিফ মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবা মাননিয়ন্ত্রণ পরিমাপের জন্য কোনো সংস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। পাশের দেশ ভারত, মালয়েশিয়া এবং অন্যান্য দেশের নিজস্ব মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। এ বিষয়ে নজর দেওয়া সময়ের দাবি।’ ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম বলেছেন, ‘দেশে কিডনি এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে জটিলতা আছে। আমরা এ সেবা দিতে আগ্রহী। দক্ষ চিকিৎসক, উন্নত প্রযুক্তি সবই আছে। আইনি জটিলতার কারণে রোগীরা সেবা নিতে পারছে না, অন্য দেশে যাচ্ছে।’ ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল ও সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাকিফ শামীম বলেছেন, ‘ক্যান্সার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা এখন দেশেই রয়েছে। দেশে চিকিৎসা নিয়ে মানুষ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। প্রতিদিনই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে দেশে গড়ে উঠছে নতুন নতুন হাসপাতাল।’ ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব প্রাইভেট হসপিটালসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেছেন, ‘প্রায়শই বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সৃষ্ট ঝামেলার কথা শোনা যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিল। অথচ উন্নত দেশে এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে স্বাস্থ্যবীমা, যা রোগীদের বিলের বোঝা কমাতে পারে। তাই সরকারের কাছে আবেদন স্বাস্থ্যবীমা বাধ্যতামূলক করা হোক।’ উন্নত বিশ্বের প্রায় সব আধুনিক চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশে রয়েছে। হৃদরোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ এখন গর্ব করে। একসময় একটা এনজিওগ্রাম করার জন্য রোগীকে বিদেশে যেতে হতো। ভারতে গিয়ে এনজিওগ্রাম করাতে ভিড় করতেন বাংলাদেশের রোগীরা। বর্তমানে দেশে ৫০টির বেশি কার্ডিয়াক সেন্টার রয়েছে। প্রতিবছর কয়েক লাখ রোগী হৃদরোগের উন্নত ও সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেশেই পাচ্ছেন। গত এক যুগে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে। সরকারি হাসপাতাল স্থাপন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ, রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান ও আধুনিক হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যু হার হ্রাস পেয়েছে। সীমাবদ্ধ সম্পদ ও বিপুল জনগোষ্ঠী নিয়ে এ অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের এই অর্জনের জন্য তিনটি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ ১৬টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। এর মধ্যে এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব অর্জনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রেখেছে বলেই স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন ঘটেছে। এর প্রমাণ ডেঙ্গুকালীন এবং করোনা মহামারীর সময় সবাই পেয়েছে। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু করোনা নয়, স্বাভাবিক সময়েও রোগীদের সেবা দিয়ে চলছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি উন্নত সেবায় আস্থার জায়গা অর্জন করেছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে সরকারের পলিসি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধের ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে।  হাসপাতাল আধুনিকায়নে যন্ত্রপাতি আমদানি করলে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।  এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে আরোপিত ভ্যাট কমিয়ে আনায় এখাতে উদ্যোক্তারা আগ্রহী হচ্ছেন। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ইবনেসিনা হাসপাতাল, বিআরবি হসপিটালস, আজগর আলী হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ইমপালস হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন হাজারো রোগী।

 

লিন্যাক-ট্রুবিম

ট্রুবিম ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এক বোতাম ইমেজ গ্রহণ এবং সম্পূর্ণ অটোমেশনের সাহায্যে রেডিয়েশন ডেলিভারির মতো উচ্চতর ফিচার চিকিৎসা পদ্ধতিকে ৫০% দ্রুত এবং আরও কার্যকর করে তোলে। এটি টিউমার শনাক্তকরণে অত্যন্ত নির্ভুল এবং এতে ক্ষতিকর উপাদান নেই। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার পদ্ধতি যেমন হাইপারআর্ক এবং র‌্যাপিডআর্ক বিস্তৃত ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। অ্যাডভান্সড ইমেজিং রেসপিরেশন-সিঙ্গেক্রানাইজড এমভি/কেভি রেডিওগ্রাফ, ৪ডি সিবিসিটি, ইটারেটিভ সিবিসিটি, ট্রিগারড ইমেজিংসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার হয়ে থাকে। অত্যন্ত নির্ভুলতার সঙ্গে ডোজ নিয়ন্ত্রণ সাব-মিলিমিটার রেডিয়েশন থেরাপি ডেলিভারি নিশ্চিত করে থাকে।  নিরাপদ এবং নির্ভরযোগ্য অন্তর্নির্র্মিত রোগীর সুরক্ষা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা চিকিৎসকদের আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ক্যান্সারের চিকিৎসা দিতে সাহায্য করে।

সর্বশেষ খবর