বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম বা মেডিকেল ডিভাইস খাত দ্রুত বর্ধনশীল ও অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। কিন্তু এই খাত এখনো কাক্সিক্ষত নীতিসহায়তা ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। সরকারের স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মেডিকেল ডিভাইস শিল্পকে একটি স্বতন্ত্র শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি, যাতে স্বাস্থ্যসেবায় কার্যকর অবদান রাখা সম্ভব হয়। বর্তমানে দেশের মেডিকেল ডিভাইস বাজারের আকার প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকা, যা প্রতিবছর গড়ে ১৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই খাতের বাজার ৪০,০০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশের চাহিদার প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। দেশীয় উৎপাদন সীমিত, মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে। তবুও কিছু আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি ঘটেছে। ১৯৯৫ সালে অপসো স্যালাইন বাংলাদেশের মেডিকেল ডিভাইস শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ শুরু করে। পরে জেএমআই সিরিঞ্জেস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসেস লিমিটেড, নিপ্রো জেএমআই, ইনসেপ্টা হসপিকেয়ার, প্রোমিক্সকোসহ অনেক প্রতিষ্ঠান দেশীয়ভাবে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই শিল্পে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের সার্টিফিকেশন- যেমন সিই মার্কিং, আইএসও ১৩৪৮৫, জিএমপি কমপ্লায়েন্স অর্জিত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এখন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার ৪০টিরও বেশি দেশে সিরিঞ্জ, আইভি সেট, পিপিই ইত্যাদি রপ্তানি করছে। তবে এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে শিল্প খাতটির সামনে থাকা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জরুরি। প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে- কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতা, তথ্য ও পরিকল্পনার অভাব, গবেষণা ও উদ্ভাবনে সীমিত বিনিয়োগ এবং বাজারে সমন্বয়ের ঘাটতি। নীতিগত সহায়তা ছাড়া এই শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর সহযোগিতায় করমুক্ত সুবিধা প্রদান, রপ্তানি প্রণোদনা ৬ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে অন্তত ২০ শতাংশ করা এবং তা ন্যূনতম ১০ বছর বহাল রাখার দাবি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বুয়েট, কুয়েট ও এমআইএসটির মতো প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেডিকেল ডিভাইস ইঞ্জিনিয়ারিং ও উৎপাদন সম্পর্কিত বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিজিডিএ)-এর নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে শক্তিশালী করা, আমদানিতে শুল্ক জালিয়াতি রোধ করা এবং সরকারি হাসপাতাল ও প্রকল্পে দেশীয় পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক ক্রয় চালু করা দরকার। তৈরি পোশাক ও ওষুধশিল্পের মতো চিকিৎসা সরঞ্জাম শিল্পকেও রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে প্রণোদনা দিতে হবে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই উৎপাদিত পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য দ্রুত সমন্বয় করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে প্রতিবছর হাজার হাজার বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার স্নাতক হচ্ছেন, কিন্তু তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। মেডিকেল ডিভাইস শিল্প বিকশিত হলে শুধু কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তই উন্মোচিত হবে না; বরং নিরাপদ ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা সরঞ্জাম দেশজুড়ে সহজলভ্য হবে। এতে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। সবশেষে বলা যায়, উপযুক্ত নীতি, পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে মেডিকেল ডিভাইস শিল্পকে জাতীয় অগ্রাধিকারে আনলে এটি দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
-সি