বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জেনারেল ওসমানী এবং পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

জেনারেল ওসমানী এবং পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান বাহিনীর লে. জেনারেল নিয়াজি মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরে জেনারেল) এমএজি ওসমানী পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। কেন, সে প্রশ্ন আমাকেও দীর্ঘদিন তাড়া করে আসছিল। আমি স্বচক্ষে দেখেছি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের কিছু আগে ওসমানী হেলিকপ্টারে চড়ে বসেছিলেন। তার সঙ্গে (মরহুম) শেখ কামাল ছিলেন। শেখ কামাল ছিলেন তার এডিসি। আমার সঙ্গে জেনারেল ওসমানীর তেমন কোনো ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল না। যুদ্ধের সময় কালেভদ্রে তার সঙ্গে দেখা হলেও আমাকে চিনে রাখা বা মনে রাখার মতো পরিচয় ছিল না। তবে কামালের সঙ্গে আমার শুধু পরিচয় নয়, ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি কামালের কাছে ছিলাম তার মান্নান ভাই।

কুমিল্লা সার্কিট হাউসে ১৬ ডিসেম্বর দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত এক মহাসমাবেশ দেখেছি। বাঘা বাঘা যোদ্ধারা সেখানে আসছেন। সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি গেরিলা যোদ্ধা এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেনেই আমাকে সার্কিট হাউসে আসতে দেওয়া হলো। এর আগে আমি আহমদ আলী সাহেবকে নিয়ে কুমিল্লায় গণপ্রশাসন ব্যবস্থা পুনর্জীবিত করেছিলাম। আত্মসমর্পণের দিন আমি দেখলাম, সার্কিট হাউসের কাছাকাছি জায়গায় জেনারেল ওসমানী ও কামাল হেলিকপ্টার থেকে অবতরণ করলেন। তারা এখানে বেশিক্ষণ ছিলেন না। কাছে গিয়ে আমি জেনারেল ওসমানীকে তার বাহিনীর অনেক সদস্যের মতো ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করলাম  এবং তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন কি না তা জানতে চাইলাম। তিনি এ প্রশ্নের কোনো সরাসরি জবাব দেননি বরং দ্রুত হেলিকপ্টারে উঠে যান। সেদিন থেকে অনেকের মতো আমিও একটি খুঁতখুঁতানি নিয়েছিলাম। সেদিন আমি এ কে খন্দকার সাহেবকে কুমিল্লার সার্কিট হাউসে দেখেছিলাম। কিন্তু খন্দকার সাহেব এক লেখাতে অন্য কিছু বলায় আমি একটি লেখা পত্রিকায় দিয়েছিলাম। তার প্রতিবাদ তিনি করেননি বলে ধরে নিতে পারি আমার বক্তব্যই সঠিক ছিল।

জেনারেল ওসমানী কেন ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে গেলেন না তা এক বড় প্রশ্ন হিসেবেই রয়ে গেল। এ নিয়ে প্রচার-অপপ্রচার, কাদা ছোড়াছুড়ি কম হয়নি। দীর্ঘদিন পরে ঘুরে ফিরে সে কথাটি আবার এলো। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দীর্ঘদিন সদস্য ছিলাম। সে সিনেটে কার্যবিবরণী এখনো সহজ প্রাপ্য। জেনারেল ওসমানী কেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এলেন না সে প্রসঙ্গটি একবার উত্থাপিত হলে আমিও আলোচনায় অংশ নিই। আমার বক্তব্যটি তুলে ধরার আগে যৌথ কমান্ড গঠনের শানেনজুল তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকেই ভারতীয় বাহিনী আমাদের বাংলাদেশের সবকটি বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছিল। কৌশলগত কারণে তা সোচ্চার প্রকাশের সুযোগ ছিল না।

 

 

আমাদের যে কোনো নামের মুক্তিযোদ্ধারা ভিয়েতনামের মতো আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু দিনে দিনে অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগল। পাকিস্তানিদের চাপ অত্যাচার হত্যা ধর্ষণ কিংবা কূটকৌশলে মুক্তিযোদ্ধারাসহ গণপ্রতিনিধিদের যুদ্ধের পক্ষ পরিবর্তনের একটা প্রবণতা লক্ষিত হলো। ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে যোদ্ধাদের সুদৃঢ় ঐক্যে কিছুটা হলেও ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছিল। সঙ্গে ছিল মোশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের পাকিস্তানিদের সঙ্গে একটি সমঝোতার উদগ্র কামনা ও প্রয়াস।

শরণার্থী ক্যাম্পাসগুলোতে খাদ্যবস্ত্র ও চিকিত্সা সংকট প্রবল হয়ে উঠেছিল। অসুখ-বিসুখও ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল। বৃষ্টি, রোগ, শোকে, অনাহারে, অর্ধাহারে সংকট দিনে দিনে প্রবলতর হচ্ছিল। শিবিরগুলোতে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হচ্ছিল, যোদ্ধাদের মধ্যে ব্যর্থতার গ্লানি প্রকট হচ্ছিল। মনোবল ভেঙে তারা ধৈর্যহারা হয়ে উঠছিল এবং ভারতের হস্তক্ষেপের দাবি বেশি বেশি উঠেছিল। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া ও ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের দাবিও সোচ্চার হচ্ছিল। দেশের অভ্যন্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশার আভাস মিলছিল। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষত আমাদের অধৈর্যশীলতার কথা জেনেই তাজউদ্দীন সাহেব ভিয়েতনাম কায়দায় দেশ স্বাধীনের ভাবনা ছেড়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে দেশ স্বাধীনে উদগ্রীব হয়ে উঠেন। যৌথবাহিনী গঠিত হলে উভয় পক্ষের দুই সেনাপতির পদমর্যাদা এক হতে হয়। তাই আগে থেকেই কর্নেল ওসমানীকে জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ভারতের পুরো বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যৌথ কমান্ড গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল ওসমানীর সমকক্ষ অর্থাত্ কাউন্টার পার্ট ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর শ্যাম মানেকশ। প্রটোকল অনুসারে শ্যামের সঙ্গে ওসমানী বসতে পারেন কিন্তু জগজিত্ সিংহ অরোরার উপস্থিতিতে কেবল আমাদের উপ-প্রধান এ কে খন্দকারই বসতে পারেন। ওসমানীর উপস্থিতিটা হতো আমাদের জন্য চরম অবমাননাকর ও সামরিক প্রটোকল বহির্ভূত। তাই উপ-প্রধানের সঙ্গে উপ-প্রধানের সমতা বিধানের জন্যই ওসমানী সাহেব পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না, ছিলেন খন্দকার সাহেব। আমার এই ব্যাখ্যাটি বিনা বাক্যব্যয়ে সিনেট অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল। আমি দিন-তারিখটি বলতে পারব না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশনের কার্যবিবরণী অনুসন্ধানে তা পাওয়া যাবে। আমি এ ব্যাখ্যাটি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে একাধিকবার দিয়েছি এবং সবাই আমার ব্যাখাটি গ্রহণ করেছেন বলে আমার মনে হয়েছিল।

জেনারেল ওসমানীর কাছে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের চেষ্টা যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পাকিস্তানিদের চরম অবজ্ঞা ও ঘৃণা ছিল বলে পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনী অপেক্ষা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত ছিল। তদুপরি জগজিত্ সিংহ অরোরা ও জেনারেল নিয়াজি ছিল কোর্সমেট এবং ব্যক্তিগত বা সমষ্টি নিরাপত্তা ও অহমবোধ বাঁচিয়ে রাখতে অরোরার কাছে নিয়াজি আত্মসমর্পণে রাজি হলো। বাংলাদেশ বাহিনী জেনেভা কনভেনশনে কোনো পক্ষ ছিল না। পাকিস্তানিরা জানত যে বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। যৌথবাহিনী চাচ্ছিল যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি কেননা তখন সপ্তম নৌবহর আসে আসে অবস্থা। তাই অনেকটা পাকিস্তানিদের চাপে পড়েই অরোরার কাছেই আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা পাকা হয় এবং পাকিস্তানি পক্ষে নিয়াজি স্বাক্ষর দান করেন।

তবে আমার ব্যাখ্যার বাইরে অন্যদের ব্যাখ্যা নেওয়া যেতে পারে। এই অমীমাংসিত বিষয়টি ইতিহাস ও বন্ধুত্বের প্রয়োজনে সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। ইতিমধ্যে জেনারেল ওসমানী চলে গেছেন, অরোরাও নেই, আর যারা সাক্ষী হিসেবে থাকতে পারেন তারাও দিনে দিনে নিঃশেষ হয়ে যাবেন। তার আগেই এই বিতর্কের যবনিকাপাত কাম্য।

বিঃদ্রঃ ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, তারা জেনারেল ওসমানীর নামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক পদবিটি ব্যবহার না করে প্রধান সেনাপতি পদবিটি ব্যবহার করেন। এটাই যথার্থ ইতিহাস ও ঐতিহ্যবোধের পরিচায়ক।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর