শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো বন্ধুর বাঁশি বাজে কানে কানে

এখনো বন্ধুর বাঁশি বাজে কানে কানে

‘বন্ধুর বাঁশি বাজেরে আমার কানে কানে...’ এ গানটি শুনলে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে চলচ্চিত্রে একজোড়া উচ্ছ্বল কিশোর-কিশোরীর মায়াভরা মুখ। যাদের সাবলীল অভিনয়ে প্রাণবন্ত হয়ে

উঠেছিল সিনেমা হলের বড় পর্দা। আকাশছোঁয়া সফলতা পেয়েছিল ‘চাঁদনী’ শিরোনামের ছবিটি। সেদিনের সেই চাঁদনীখ্যাত জুটির নাম নাঈম-শাবনাজ। ১৯৯১ সালের কথা। প্রসিদ্ধ চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম নির্মাণ করেন রোমান্টিক গল্পের চলচ্চিত্র ‘চাঁদনী’।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘চাঁদনী’ হয়ে গেল ইতিহাস। আর শাবনাজ-নাঈম অপরিহার্য হয়ে পড়লেন এ জগতে। নাঈম ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান। তার পূর্বসূরি খাজা আজমলের হাত ধরে ১৯৩৮ সালে এদেশে নির্মিত হয় প্রথম চলচ্চিত্র ‘দ্য লাস্ট কিস’। আজ শোবিজ স্পেশাল আড্ডায় অতিথি চাঁদনীখ্যাত নাঈম-শাবনাজ জুটি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ -  ছবি : মারুফ

 

ফাল্গুনের বৃষ্টি ভেজা এক বিকেলে

১৪ ফাল্গুনের বৃষ্টি ভেজা বিকেলে রওনা দিলাম উত্তরার উদ্দেশে। গন্তব্য ‘আশিয়ান’ নামের একটি বাড়ি। এই বাড়িতেই চাঁদনী ছবির সেই কিশোর-কিশোরী নাঈম-শাবনাজের বসবাস। দুই কন্যা নামিরা আর মাহাদিয়ার গর্বিত পিতা-মাতা তারা। মূল ফটক গলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই সামনের দেয়ালে টাঙানো ছবিটির দিকে চোখ আটকালো। পিতা-পুত্রের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি। খাজা মুরাদের সঙ্গে নাঈম।

সুদর্শন পিতা-পুত্রের ছবিতে আলোকিত ‘আশিয়ান’ নিবাস। ড্রইংরুমে গিয়ে বসতেই টের পাওয়া গেল নবাববাড়ির আবেশ। নাঈম হলেন নবাব খাজা স্যার সলিমুল্লাহর প্রপৌত্র। ড্রইংরুমে ঝাড়বাতির আলো ভেদ করে এক সময় দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় জুটি নাঈম-শাবনাজ। বড় পর্দার পাশাপাশি বাস্তব জীবনেও জুটি বেঁধেছেন তারা সেই ১৯৯৪ সালে। তেমনিই সৌন্দর্য আর সুদর্শন ছাপ এখনো তাদের মাঝে অটুট। কুশলবিনিময়ের পর নাঈম-শাবনাজ তারকা দম্পতির সঙ্গে ছুটলাম উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে। সেখানেই শোনা হবে তাদের জীবনের আদ্যোপান্ত।

পড়ন্ত বিকেল। তার ওপর আকাশে মেঘের ভেলা। কিছু পরে প্রকৃতির আলো নিভে যাবে। তাই আগে ফটোসেশনের কাজটি সেরে নিতে হলো। এরপর কফির কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হলো তাদের জীবনের গল্প শোনা।

 

নাঈমের নায়ক হওয়ার গল্প

মেঘের আড়ালে মুখ ভার করা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুটা উদাস হয়ে পড়লেন নাঈম। ফেলে আসা দিনগুলোর ঝাঁপি খুলতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন তিনি। বলে চললেন, আমাদের নবাব পরিবারের সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। আমার বাবা খাজা মুরাদকে নায়ক করে ছবি নির্মাণের অবারিত ইচ্ছে ছিল এহতেশাম সাহেবের। এতে পারিবারিক বাধা না থাকলেও আমার মা আসিয়া পন্নীর আপত্তি ছিল। আর এই আপত্তির কারণেই বাবা আর রুপালি পর্দা আলোকিত করতে পারলেন না। এরপর সময় গড়িয়েছে অনেক। আমি তখন সদ্য কিশোর বলা যায়। পড়ালেখা নিয়ে আকাশ পাতাল ব্যস্ততা আমার। আমাকে নায়ক করার জন্য একদিন এহতেশাম সাহেব এসে বাবাকে ধরে বসলেন। বাবা কোনো আপত্তি করলেন না। আমাকে নায়ক করে শুরু হলো ‘চাঁদনী’ নির্মাণের মিশন। তারপরের গল্প সবারই জানা। বলতে বলতে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল নাঈমের ঠোঁটের কোণে।

 

নাঈমের অপছন্দ আর শাবনাজের জিদ

এতক্ষণ নীরবে বসে নাঈমের নায়ক হওয়ার গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন শাবনাজ। তার দিকে তাকাতেই সপ্রতিভ হয়ে উঠলেন তিনি। হাসতে হাসতে প্রথমেই অনেকটা অভিযোগের তীর ছুড়ে দিলেন নাঈমের দিকে। বললেন আমাকে দেখার পর তিনি নির্মাতা এহতেশাম সাহেবকে বলেছিলেন... না, না এই মেয়েকে কোনোভাবেই নায়িকা করা যাবে না। তার সঙ্গে আমি অভিনয় করব না। কী কারণে নাঈমের আপত্তি ছিল? জানতে চাইলে শাবনাজ বলেন, ও বলেছিল আমি নাকি শুকনো, মাথায় চিটচিটে তেল দেওয়া আর গোল চশমা পরা কি¤ভূতকিমাকার একটি মেয়ে। আমার মতো এমন মেয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই জুটি বাঁধবে না সে। এই কথা এহতেশাম সাহেবের কাছ থেকে শুনে আমার মধ্যে প্রচণ্ড জিদ চাপলো। আমি বললাম দেখি সে কীভাবে আমাকে নায়িকা হতে না দেয়। আমি নায়িকা হয়েই ছাড়ব। শেষ পর্যন্ত আমিই জয়ী হলাম। শাবনাজ অভিযোগের তীরে বিদ্ধ নাঈম হেসে কুটি কুটি।

 

যেভাবে এহতেশামের নজর কাড়লেন শাবনাজ

স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে শাবনাজ বললেন একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এহতেশাম সাহেব আমাকে দেখেন। তার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওই অনুষ্ঠানের ভিডিও এক সময় এহতেশাম সাহেবের কাছে পাঠানো হয়। ভিডিওতে আমাকে দেখে বাবাকে তিনি বললেন আমাকে ‘চাঁদনী’ ছবির নায়িকা করতে চান। বাবা যেহেতু মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই তিনি না করলেন না। যদিও দাদা-দাদি চাননি। কিন্তু বাবা বললেন, আমি যদি এই অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি আমার মেয়ে কেন নয়। ব্যস, বাবার উৎসাহে ‘চাঁদনী’ হয়ে গেলাম।

 

পর্দা জুটি থেকে জীবন জুটির গল্প

নাঈম স্মিত হেসে বললেন এরই মধ্যে আমরা জুটি বেঁধে অনেক ছবিতে কাজ করে ফেলেছি। ভাবলাম আমাদের জুটির রসায়ন পাকা করতে সম্পর্ক আরও উন্নত করা দরকার। ১৯৯৪ সাল। সিলেটে এহতেশাম সাহেবের ‘চোখে চোখে’ ছবির শুটিংয়ে গেছি। যে বাংলোতে আমরা উঠেছি সেই বাংলোর জিএম ছবির টিমকে নিমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে শাবনাজের বাবাসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। আয়োজনের এক ফাঁকে আমি শাবনাজকে ডেকে বাইরে নিয়ে যাই। নিঃসংকোচে তাকে মনের কথা খুলে বলি। শাবনাজের কাছে জানতে চাইলাম জবাবে আপনি কী বলেছিলেন, লজ্জা জড়ানো হাসিতে তার কথায় ওর কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পাওয়াটা আমার জন্য কোনো সারপ্রাইজ ছিল না। আমিও মনে মনে ওকে ফিল করতাম। একটানা একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্ক যদি দুজনের মধ্যে নিবিড় আর নির্ভরযোগ্য করা যায় তাতে ক্ষতি কি? তাই তার প্রস্তাবে সম্মত হতে কার্পণ্য করিনি। ১৯৯৪ সালেই গাঁটছড়া বাঁধলাম। তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। এখনো বন্ধুর বাঁশি বাজে আমাদের কানে কানে... ও হ্যাঁ, নাঈম কিন্তু ভালো বাঁশি বাজাতে পারে। সব বাদ্যযন্ত্রেই রয়েছে তার দক্ষতা। শাবনাজের এ কথার প্রমাণ পেলাম তাদের ড্রইংরুমে পরম যত্নে সাজিয়ে রাখা একগুচ্ছ বাঁশের বাঁশি দেখে।

শোবিজ স্পেশাল আড্ডায় নাঈম ও শাবনাজ

 

চলচ্চিত্র থেকে সরে দাঁড়ানো কেন?

দুজনের চোখে-মুখে বিষাদের ছায়া বহু দূর থেকে আঁচ করা যায়। উদাস হয়ে ওঠা নাঈম বলেন, ১৯৯৪ সালটা আমার জীবনের জন্য অনেক কষ্টের বছর। এ বছর প্রথম প্রযোজনায় এলাম। ‘আগুন জ্বলে’ শিরোনামের একটি ছবি নির্মাণ করলাম। ছবিটি সফলতার মুখ দেখল না। চরম আর্থিক ক্ষতির শিকার হলাম। এরপরই প্রিয় বাবাকে হারালাম। এ দুটি ঘটনা, বিশেষ করে বাবাকে হারানোর কষ্ট আমাকে চলচ্চিত্রবিমুখ করে দেয়...বলতে বলতে নাঈমের চোখের কোণে বেদনার অশ্রু জমে ওঠে।

 

বাবার ছায়া ছিলাম আমি

নিজেকে কিছুটা সামলে উদাস কণ্ঠে নাঈম বলে চললেন বাবাকে হারানোর যন্ত্রণাটা এখনো বুকে বড় বেশি বাজে। আমি ছিলাম বাবার ছায়া। আমাকে ছাড়া বাবা, বাবাকে ছাড়া আমি ছিলাম অকল্পনীয়। সেই প্রিয় বাবা যখন হঠাৎ আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন তখন নিজেই নিজের জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেললাম। হয়তো সেই শোকে আমিও মারা যেতাম। কিন্তু শাবনাজের অবর্ণনীয় সান্ত্বনা আমার বেঁচে

থাকার উপায় হয়ে দাঁড়াল। ওর সাপোর্টের কারণে আর বাবার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এখনো বেঁচে আছি আমি।

 

দুজনের পরিবারের গল্প

ভারী হয়ে ওঠা পরিবেশ হালকা করতে বিচক্ষণ শাবনাজ বলে উঠলেন, জানেন আমাদের দুজনার পরিবারের মধ্যে অনেক মিল আছে। যেমন ধরুন দুজনের নানার নাম প্রায় এক। ওর নানার নাম মেহেদী আলী খান পন্নী। আমার নানা খন্দকার আলী মেহেদী। নাঈমের বাবা খাজা মুরাদ। আমার বাবা স. ম হুমায়ন। আমার বাবা তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা ছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। আমাদের বাড়ি বিক্রমপুর। নাঈমের নানা বাড়ি টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। করটিয়ার বিখ্যাত পন্নী পরিবারের মেয়ে আসিয়া পন্নী নাঈমের আম্মা। আমার আম্মুর নাম আঞ্জুমান নাহার। আমরা তিন বোন। ছোট বোন তাহমিনা সুলতানা মৌ টিভি নাটকে অভিনয় করে আর ছোট বোন শাহনাজ সোনিয়া গৃহিণী।

নাঈমরা এক ভাই এক বোন। ওর বোন জেবা ইসলাম একজন ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফার। আমাদের দুই মেয়ে। নামিরা ও মাহাদিয়া। নামিরা টরেন্টোতে পরিবেশ বিপর্যয় প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা করছে। মাহাদিয়া এ লেভেলস শেষ করবে। বড় মেয়ে ভালো পেইন্টিং করে ও ফুটবল খেলে। বলতে পারেন আমরা নিখাদ একটি সুখী পরিবার।

 

অবশেষে বিদায়ের পালা

ফটোশুট আর আড্ডার নিমগ্নতায় কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা গাঢ় হলো টেরই পেলাম না। প্রাণবন্ত অতিথি হলে সময় নিজের গতি ভুলে যায়। এ কথাটি আবার প্রমাণ হলো জনপ্রিয় জুটি নাঈম-শাবনাজকে পেয়ে। এবার ফেরার পালা। সহাস্যে নেমে পড়লাম চিরচেনা যানজটের সড়কে। পথে যেতে যেতে কানে বেজে চলছে ‘বন্ধুর বাঁশি বাজেরে আমার কানে কানে’ আর চোখে ভেসে উঠল ‘চাঁদনী’ ছবির সেই নাঈম-শাবনাজকে...। এই ভালো লাগা কখনো ফুরাবার নয়।

সর্বশেষ খবর