শনিবার, ৪ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাট্য আন্দোলনের দুই পথিকৃৎ

নাট্য আন্দোলনের দুই পথিকৃৎ

নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিমুল ইউসুফ সংস্কৃতির অন্তপ্রাণ অনন্য বাঙালি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাংলাদেশের নিজস্ব নাট্যরীতি নির্মাণের অন্যতম পুরোধা। নানামাত্রিক কর্মকীর্তি তার। গত সপ্তাহে মুক্তি পেয়েছে তার নতুন চলচ্চিত্র ‘আলফা’।

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘গেরিলা’ নির্মাণের প্রায় আট বছর পর মুক্তি পেল এই গুণী নির্মাতার ছবি। আলফার মুক্তি নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল তার, তবুও বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্য ২৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় সময় দিয়েছিলেন। আমরা এই গুরুশিল্পীর বাড়িতে পৌঁছে দেখি মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফ অপেক্ষা করছেন। শোবিজ আড্ডায় তাদের আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন- শেখ মেহেদী হাসান ও আলী আফতাব

 

শিমুল ইউসুফ আমাদের মঞ্চনাটক ও সংগীতাঙ্গনে বিশিষ্ট মানুষ। নিপুণ অভিনয় দক্ষতার জন্য নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তাকে ‘মঞ্চকুসুম’ উপাধি দেন। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত। অভিনয়, নাট্যনির্দেশনা, সংগীতসহ শিল্পাঙ্গনের প্রায় সব বিষয়েই প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। শিমুল ইউসুফ বলেন, আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আছি। আমার ভাইবোন সবাই গান, নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি ইত্যাদি চর্চা করত। আমার বোন মীনু গান শিখত, আমি নাচ শিখতাম, ভাই দিনু বিল্লাহ গান শিখত। ওস্তাদ এসে আমাদের বাড়িতে শেখাতেন। আমি সবার ছোট। মীনুকে যখন গান শেখাতো তখন ওই রুমে আমার প্রবেশ নিষেধ ছিল। আমি বাইরে বসে গান শুনতাম। এক সময় দেখা গেল মীনু নাচ শিখল আর আমি গান। শহীদ আলতাফ মাহমুদ আমাকে তৈরি করেছেন। তার কাছে গানের নানা আঙ্গিক, শৈলী সম্পর্কে তালিম নিয়েছি। তিনি শহীদ মিনারসহ বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে গেলে আমাকে সঙ্গে নিতেন। আমাকে দিয়ে গান গাওয়াতেন। পরে তিনি আমার বড় বোন ঝিনু আপাকে বিয়ে করেছিলেন। আলতাফ ভাই ঝিনু আপার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। পরে কবি সুফিয়া কামালের মধ্যস্থতায় তাদের বিয়ে হয়েছিল।

শিমুল ইউসুফ পড়াশোনা করতেন আর্ট কলেজে (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ)। পরে ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে বড়দা মহারাজা সাহজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। তারপর দেশে ফিরে নিয়মিত মঞ্চনাটকে কাজ করছেন। তার ভাষায়, এখনো নিরলস এই অঙ্গনেই কাজ করে যাচ্ছি। অসংখ্য মানুষের ভালো লাগা, ভালোবাসার মধ্যে কেটে যাচ্ছে জীবন। এটাই আমার বড় পাওয়া। সারাক্ষণ কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে, স্মৃতিগুলো সব একাকার হয়ে যায়। আমি বসে নেই এখনো। প্রতিদিন থিয়েটারসহ অনেক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। আনন্দের মধ্যেই জীবন কাটাই। আসলে আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, এসব কাজের মধ্যে নিজেকে মগ্ন রাখতে পেরেছি। নাটকের মতো একটা বড় বিষয় নিয়ে কাজ করছি। নিজের মতো করে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেক বিষয় এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

শিমুল ইউসুফ ঢাকা থিয়েটারের অন্যতম নাট্যকর্মী। দেশের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীর সঙ্গে মঞ্চে অভিনয় করেছেন। ‘বিনোদিনী’ নাটকে তার একক অভিনয় মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। সেলিম আল দীনের লেখা অধিকাংশ নাটকে তিনি সফল অভিনয় করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালের নাট্যচর্চা সম্পর্কে তার মূল্যায়ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চার দশকের বেশি সময় নাট্যচর্চার সঙ্গে আছি। তখন ভাঙাচোরা মঞ্চকে ধুয়ে-মুছে সবাইকে এ চর্চা শুরু করতে হয়েছে। সে সময় এ জায়গাটা ছিল ভালো লাগা এবং শ্রদ্ধার। এখন সে জায়গা থেকে প্রায় সবাই দূরে সরে গিয়েছে। নাটকের প্রতি ভালোবাসা কমে গিয়েছে। নাটকের জন্য আমরা যে স্ট্রাগল করেছি এখনকার প্রজন্ম তা থেকে অনেক পিছিয়ে। এই অঙ্গনের প্রতি আমাদের যে গভীর ভালোবাসা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধও ছিল। এখন তা থেকে সরে এসেছে। থিয়েটার আমার দ্বিতীয় সংসার। এখন থিয়েটার অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সময় এতটা সহজ ছিল না। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আমাদের শিল্পচিন্তাকে সুদৃঢ় করেছেন। সেলিম উদ্যোগ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ চালু করেন। বাংলা নাটক এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করছে।

মঞ্চকুসুম শিমুল ইউসুফের সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে আমাদের আড্ডায় যোগ দেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। প্রথমেই তার সঙ্গে কথা হয়, সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘আলফা’ নিয়ে। যান্ত্রিক শহরের বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে বেঁচে থাকা একজন রিকশা পেইন্টারের জীবনকে ঘিরে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। যা দেখে মুগ্ধ চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। তৃতীয় বিশ্বের একজন শহুরে রিকশা পেইন্টারের কিছু বেদনার গল্প এতে উঠে এসেছে। বলা যায়, পুরো ছবিতে অব্যক্ত বেদনার চিত্র ফুটে উঠেছে। ‘আলফা’র মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলমগীর কবির। আরও আছেন দোয়েল ম্যাশ, এটিএম শামসুজ্জামান, হীরা চৌধুরী, ইশরাত নিশাত, মোস্তাফিজ নূর ইমরান, ভাস্কর রাসাসহ অনেকেই।

আমরা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে জানতে চাই আলফা ছবিটির প্রেক্ষাপট নিয়ে। তিনি বলেন, ২০১৪-১৫ সালের দিকে বাংলাদেশে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে সেটি আমাকে ভীষণ পীড়া দিয়েছিল। সে সময় অবরোধ, গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হয়েছে। তখন আমার মনে জেগেছিল এ স্বাধীন রাষ্ট্রটি এভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল কেন? আর যদি পোড়েও তাহলে একজন নাগরিক কী ভাবছে? সে নাগরিকটি হচ্ছে আলফা। তার জীবনযাপনের ভিতরে যে সংকট-সেটা অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক।

চট্টগ্রামের একজন চলচ্চিত্রকর্মী আলমগীর কবির। তিনিই ছবিতে আলফা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। একজন চলচ্চিত্রকর্মীকে কীভাবে অভিনেতা হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন তাও জানিয়েছেন নির্মাতা। তিনি বলেন, সে কখনো কোথাও অভিনয় করেনি। তার সঙ্গে আমার পরিচয় চট্টগ্রামের একটি চিত্র প্রদর্শনীতে। আমি তাকে বলেছি, তুমি আমার ছবিতে অভিনয় কর। সে আর আমার কথা মানা করল না। এরপর আমরা ওকে নিয়ে চরিত্রটি ধারণ করার জন্য ওয়ার্কশপ করেছি।

শোবিজ স্পেশাল আড্ডায় নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও শিমুল ইউসুফ দম্পতি

 

আমরা দেখেছি এ ছবিতে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। তাকে সিলেকশন করলেন কেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ছবির চিত্রনাট্য লেখার পর তিনি আমাকে বললেন, তাকে নিতে হবে। তখন একটি চরিত্র আমি চিত্রনাট্যে ঢুকিয়েছিলাম। তার খুব শখ তিনি আমার ছবিতে অভিনয় করবেন। তিনি আমার ছবিতে আমৃত্যু থাকতে চান।

একজন মানুষের সমসাময়িক জীবনযাপনের মধ্যে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে বাধাগুলো আছে সেগুলো ‘আলফা’র মধ্যে উপস্থিত আছে বলে মনে করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। তার মতে, আমার ভালো লাগছে অন্য জায়গায়, সংস্কৃতিটা কীভাবে একটা কসমোপলিটন সিটিতে অপভ্রংশ হয়ে একটা অদ্ভুত আকার ধারণ করে। আলফায় আমি গল্প বলার চেষ্টা করিনি। গল্পটা তৈরি হয়ে যেতে পারে। ঘটনাগুলো আছে, চিত্রগুলো আছে। মানুষের এ সময়ের যে অভিজ্ঞতা তার একটি প্রতিফলন পর্দায় দেখতে পাবেন। আর ভালো-মন্দ, এ নিয়ে কোনো কথা নেই।

ফরিদুর রেজা সাগর ও এশা ইউসুফ প্রযোজিত এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত এ সিনেমার কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। সম্পাদনায় ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ। অভিনেতা-অভিনেত্রীর বাইরে এ ছবিতে দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন একটি গাধা ও আরেকটি কুকুর। এ দুটি প্রাণী প্রসঙ্গে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, এ দুটি প্রাণীকে নিয়ে শুটিংয়ের সময় বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। কারণ গাধাটি ছিল অসম্ভব রাগী। আর যে কুকুরটি ছিল, সেটিও একই প্রকৃতির। এ দুটো প্রাণী নিয়ে আমার ভীষণ কঠিন সময় গেছে, শুটিংয়ের সময়। আমি জানি না কে কীভাবে নেবেন। আমার মনে হয়েছে ঢাকা শহরের মধ্য দিয়ে একট গাধা হাঁটিয়ে দিতে পারলে আমার খুব ভালো লাগবে। আমি সেটাই করেছি। কতটুকু গেল না গেল আমি জানি না, ছবির সঙ্গে, ইমেজের সঙ্গে। কিন্তু একটা গাধা ঢাকা শহরের ভিতর দিয়ে না হাঁটলে শান্তি পাচ্ছি না।

আপনি বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলনের একজন গুরুশিল্পী। থিয়েটারের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একদিন ম. হামিদ বলল, চলো একটা নাটকের দল করি। ম. হামিদ ডাকসুর কালচারাল সেক্রেটারি ছিল। এর আগে মাও সে তুং-এর বিপ্লবের ওপর পড়াশোনা করেছি, তো তার সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে জানি, মনে হয়েছে যে স্বাধীন দেশে থিয়েটার করব, এটা একটা কাজের কাজ হতে পারে। 

ম. হামিদই কিন্তু ‘নাট্যচক্র’ নামটা দিয়েছিল। সেলিম আল দীন ও আল মনসুরকে বলা হলো নাটক লিখতে। সেলিম আল দীন লিখল এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা আর আল মনসুর লিখল রোলার ও নিহত এল এম জি। ১৯৭২ সালের কথা। ১৯৭২ সালে আরেকটি ঘটনা ঘটল। আনোয়ার কবির ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটক করলেন। নাটকের নাম ‘জনে জনে জনতা’। এটার শো হয়েছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। পর পর চারটি শো করেছিল। ১৯৭২ সালে নাটক করেছে বহুবচন, সম্ভবত সাড়ে সাতশ সিংহ বা প্রজাপতির লীলা লাস্য। তারপর মামুনুর রশীদ আরণ্যক নাট্যদল নিয়ে প্রথম করল পশ্চিমের সিঁড়ি, ওটাতে আমাদের রাইসুল ইসলাম আসাদ অভিনয় করেছিল। ১৯৭২ সালেরই ২১ ফেব্রুয়ারিতে মামুনুর রশীদ কবর করল আর সেটাতে আলী যাকের, মোহাম্মদ জাকারিয়া দাদার অভিনয় করলেন।

আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় মুহসীন হলের নাটক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, হ্যাঁ, সেলিম আল দীনের নাটক জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন। এ প্রতিযোগিতা কিন্তু সারা বাংলাদেশে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এরপর বিজয়নগরের ভোগ ফ্যাশন বিল্ডিংয়ে বসে ২৯ জুলাই ১৯৭৩-এ একটি মিটিং করি। সেই মিটিংয়ে ম. হামিদই প্রস্তাব করে ‘ঢাকা থিয়েটার’ নামটা, এবং নামটা আমাদের সবারই পছন্দ হলো। প্রথম আহ্বায়ক আমি, ম. হামিদ আর সেলিম আল দীন এ তিনজন। তারপর শুরু হয় আমাদের নব নাট্য আন্দোলন। আসলে সেলিম আল দীনের বড় অবদান। এই যে দুইটা তিনটা নাটক করার পর আমরা খুব জনপ্রিয় হলাম। ‘সংবাদ কার্টুন’, ‘বিদায় মোনালিসা’। অনেক লোক আমাদের নাটক দেখল। কিন্তু সেলিম আর আমি বসে বসে ভাবছিলাম, আমি তো মুক্তিযুদ্ধ-ফেরা মানুষ। আমি একাত্তর সালে গ্রামে গিয়েছি। গ্রামের লোকের সঙ্গে মিশেছি। বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ ছিল না। জেলেদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছি। নৌকায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেছি। ছোটবেলায় বহুরূপী হয়ে চৈত্রসংক্রান্তিতে দেখতাম, সেগুলোর কথা মনে ছিল। কিন্তু অতটা সচেতন ছিলাম না। নাট্যচার্য সেলিম আল দীনের অনেক অভিজ্ঞতা। সেলিমের ‘শকুন্তলা’ নাটক মঞ্চে নিয়ে আসি। আমরা কিন্তু তখনো পৌঁছাইনি এখন যে জায়গায় বাংলা নাটক আছে। আমরা বলছি যে, জাতীয় নাট্য-আঙ্গিক নির্মাণের লক্ষ্যে জাতীয় নাট্য-আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে বাংলা নাটককে নতুন অভিব্যক্তি দেওয়ার জন্য আমরা আন্দোলনটা করছি। নাট্য-আন্দোলন। কিন্তু তখনো আমরা সে জায়গায় পৌঁছাইনি। আমরা ‘শকুন্তলা’য় কিন্তু খুবই ক্লাসিক্যাল, ধ্রুপদী একটি ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে গেছি। এটা নান্দনিক একটি কাজ।

১৯৭৯-৮০-৮১ এ তিনটি বছর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেলিম বলল, বাচ্চু, পালা অথবা যাত্রা যদি তুই ঘেঁটে দেখিস, এরপর বড়ু চ-ীদাশের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন যদি পড়ে দেখিস, তাহলে বুঝবি এটা হলো আমাদের থিয়েটার। এটা অনির্বাণ আর চৈতন্যদেবকে বাদ দিয়ে তো বাংলা থিয়েটার হয় না। তাহলে চৈতন্যদেবের থিয়েটারটা কোথায়! প্রশ্ন করা শুরু করল। ওদিকে ওয়েস্টার্ন থিয়েটার নিয়ে আমাদের বন্ধুরা নাটক করছিল, ঢাকারই। খুব ভালো করছিল তারা। তারা বলল যে এগুলো তো প্রাক্তন। চলে গেছে। এগুলো নিয়ে তোমরা আবার কথা বলছ কেন! আমরা তখন বললাম, একটা স্বাধীন দেশের কি স্বাধীন শিল্পরীতি থাকবে না! তার নিজস্ব শিল্পরীতি, যেটা সম্পূর্ণ তার নিজের! যেটা এ মাটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এ জল, এ কাদা, এ আবহাওয়া, এ বৃক্ষ-তৃণলতা ঘিরে তার স্বপ্ন বিস্তার করেছে এ ছোট ছোট শ্যামলা রঙের মানুষগুলো! অতীতের কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে শত শত বছর ধরে এ স্বপ্নগুলো দেখেছে! তখন আহমদ শরীফ সাহেবের সঙ্গে গিয়ে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং এদের পুঁথিগুলো পাঠ করা শুরু করলাম। আমাদের আঙ্গিকগুলো অন্যরকম। পুঁথির অসাধারণ আঙ্গিক আছে। চৈত্রসংক্রান্তি একটি বহুমাত্রিক পারফরম্যান্স। পালা, মনসামঙ্গল আমরা কেন এ জিনিসগুলোকে বাদ দেব! সুতরাং আঙ্গিকটা আপনি ভাঙুন। কিন্তু বিষয় নির্বাচনে সম্পূর্ণরূপে নিজের দেশের প্রকৃতি, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ভাষার জায়গাটা লক্ষণীয়। শুধু প্রমিত ভাষায় আবদ্ধ থাকলাম না। সুর-তাল-ছন্দে অর্থাৎ পাঁচালির দিকে ধাবিত হওয়া শুরু করলাম। সেই তখন থেকে আমরা বলছি ঔপনিবেশিক থিয়েটারের বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশের, স্বাধীন জনগণের অনেকগুলো নিজস্ব শিল্পরীতি, নাট্যরীতি, অভিনয়রীতি রয়েছে; যেগুলো নিয়ে আমরা আধুনিককালে এসে দাঁড়াতে পারি। এভাবে আমরা বাঙালির নিজস্ব নাট্যরীতি নির্মাণ করেছি। এ ক্ষেত্রে গ্রাম থিয়েটারও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের নাট্য আন্দোলন আগের চেয়ে গতিশীল।

 

সর্বশেষ খবর