শনিবার, ২৫ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভালোবাসা ব্যাপারটা হচ্ছে ম্যাজিকের মতো

ভালোবাসা ব্যাপারটা হচ্ছে ম্যাজিকের মতো
দেশের প্রখ্যাত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ! জাদুকে যিনি বিনোদন থেকে শিল্পের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন। কেবল জাদুশিল্পীই নন; তিনি একাধারে অসাধারণ বংশীবাদক, চিত্রশিল্পী, সমাজসেবক, মডেল, উপস্থাপক ও অসংখ্য দেশি-বিদেশি বইয়ের সংগ্রাহক। এ ছাড়াও তার আরেকটি পরিচয় রয়েছেÑতিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ব্যক্তিগত জীবনে তার স্ত্রী বিপাশা আইচও একজন জাদুশিল্পী। এই দুজনের প্রিয়মুখ একমাত্র মেয়ে খেয়া আইচ। এবারের বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের আড্ডা আয়োজনের অতিথি তারা তিনজন। তাদের সঙ্গে এক সকালে জমে ওঠে জম্পেস আড্ডা। সেই প্রাণবন্ত আড্ডা পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন-  পান্থ আফজাল , ছবি-নেওয়াজ রাহুল

 

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ ‘ম্যাজিক মুনশি’ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে তার প্রিয় একজন মানুষকে নিয়ে কয়েকটি লাইন লিখেছিলেন। ‘জুয়েল আইচ, জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্ট জয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন’- কথাটি যথার্থই বলেছেন। জুয়েল আইচ! যিনি কথা বললে মনে হয় এটাই জাদু, বাঁশি বাজালে মনে হয় এটাও তো জাদু! সর্বদা মুখে লেগে থাকে জাদুময় হাসি। যিনি ছবিও আঁকেন জাদুর মতো। যার চমৎকার উপস্থাপনা ও ব্যক্তিত্ব আকর্ষণ করে মানুষকে। তার সম্মোহনী চোখের চাউনি যে কোনো ভক্তের হৃদয়ে কাঁপন জাগায়। ভক্তরা তার জাদুর মায়ায় মুহূর্তেই চলে যায় ফ্যান্টাসির জগতে। তার বিখ্যাত জাদু কাগজ থেকে ডলার বানানো, চোখ বেঁধে গাড়ি চালানো, কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জোড়া লাগানো, ফ্লাইং কার্পেট ইত্যাদি। তার কর্মজগৎও অনেক দ্যুতিময়! তাকে নিয়ে এসব কথা কিন্তু অলৌকিক নয়, লৌকিক। তার কথার জাদুময় আহ্বানে সাড়া দিতে শোবিজ টিম এবারে তার বাসায় হাজির। বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই গেটের বামপাশে চোখ আটকে গেল! একটি ফলকে খোদাই করে লেখা ‘ম্যাজিক ক্যাসেল’। এমন বিখ্যাত জাদুশিল্পীর বাড়ির নাম তো এমনই হওয়া উচিত;  তাই না? আগেভাগেই ফোনালাপে সময় ঠিক করা ছিল। তাই লিফট দিয়ে উপরে উঠে দরজার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বয়ং জুয়েল আইচ ভিতরে আমন্ত্রণ জানালেন। এরপরই শোবিজ ফটোগ্রাফার ফটোসেশনের পাঠ চুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফটোসেশনের মাঝ পর্যায়ে এলেন সহধর্মিণী বিপাশা আইচ ও একমাত্র আদরের মেয়ে খেয়া। পিছে পিছে আয়েশি চালে হাজির আদরের বিড়াল ‘মোটো’। ফটোসেশন শেষে আমরা আড্ডায় বসে গেলাম। পরিবারের তিনজনই খুবই আড্ডাপ্রিয় স্বভাবের বোঝা গেল! আড্ডার শুরুতেই জুয়েল আইচকে প্রশ্ন। ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন? একগাল হেসে সহজ উত্তর তার, ‘অনেক কিছুই তো হতে চেয়েছি। কখনো ঝোঁক ছিল ছবি আঁকার প্রতি, কখনো বাঁশি বাজানোর প্রতি আবার কখনো ম্যাজিশিয়ান।’ জাদুশিল্পের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার গল্প শুনতে চাই? তিনি মুখে ভুবন ভোলানো হাসির রেখা টেনে বলা শুরু করলেন। ‘একবার আমাদের গ্রামে বেদে বহর এসেছিল। বেদে দলের কাছ থেকেই আমি প্রথম জাদু দেখি। ঠিক কী জাদু দেখেছিলাম মনে নেই, তবে চমৎকৃত হয়েছিলাম! তবে জাদুর প্রতি আকর্ষণটা তৈরি হয় আরও অনেক পরে। বানারীপাড়া সার্কাস দলের এক জাদুকরের জাদু দেখে তো হতবাক আমি। ঠিক করলাম, আমিও জাদু শিখব। ছোটবেলায় রূপকথা পড়তে খুব পছন্দ করতাম। বন্দে আলী মিয়ার রূপকথা ছিল খুব প্রিয়। তবে, জাদুর প্রতি আকর্ষণটা উন্মাদনায় পরিণত হয় কলেজে ওঠার পর। সিরাজগঞ্জের জাদুকর আবদুর রশিদের জাদু দেখে সচেতনভাবে একজন জাদুশিল্পী হওয়ার স্বপ্নটা শুরু হয়। ম্যাজিক সম্পর্কিত রাজ্যের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে শুরু করলাম ম্যাজিক প্রাকটিস। এক্ষেত্রে পিসি সরকারের লেখা বই অনেক উৎসাহ জোগায়। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাকে সেই স্বপ্ন নিয়ে তখন বেশি দূর যেতে দেয়নি। একাত্তরে পাকিস্তানি  সৈন্যরা আমাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। জাদুর যেসব যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলাম সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।’ দ্বিতীয়বারও তো একই ঘটনা ঘটে। কেন সব জাদুর জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়? জুয়েল আইচ বললেন, ‘হ্যাঁ দুবার ঘটনাটি ঘটে। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরে ১৯৭৭ সালে বন্ধু নিটুল করের বাড়িতে। নিটুলের সঙ্গে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার দ্বন্দ্ব বাধে। এক পর্যায়ে রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।’ বিপাশা আইচের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা ও শেষে পরিণয়-পরিণতি কীভাবে হলো? জুয়েল আইচ একগাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘কথাটা ভালোই বলছ, পরিণতি...হাহাহা। পরিণতি তো হলোই শেষ পর্যন্ত।’ বিপাশা আইচ বলে চললেন, ‘বাবা বিভিন্ন কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করেছেন। তখন পিরোজপুরে ছিলাম। পিরোজপুরেও ছিল জুয়েলের বাড়ি। আব্বুর কলেজে পড়ার সুবাদে জুয়েলের সঙ্গে বাবার খাতির। আমার ভাইয়ের সঙ্গেও ওর পরিচয় ছিল। বাসায় মাঝে মাঝে আসত।’ কিন্তু বিয়ে হলো কীভাবে? ‘বাসায় এলে দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কথা হতো। তার কথা শুনতে ভালো লাগত। এভাবেই তো হয়েছে! এরপর বিয়ে হলো। অন্য কারণে ওরও আমাকে ভালো লেগেছিল। সেটি একসময় ও প্রকাশ করে।’ সোজাসাপ্টা কথাগুলো বলে চললেন বিপাশা। ‘একচুয়ালি ও না বলে প্রকাশ করেছে আর আমি বলে প্রকাশ করেছি, হাহাহা। আর চিঠি লেখা হয়েছে। ওই সময় তো সেলফোনের কোনো বালাই ছিল না। ওদের বাড়িতে তো ল্যান্ডফোনও ছিল না।’ জুয়েল আইচ মজা করে কথাগুলো বললেন। এরপর কথার পিঠে কথা টেনে স্ত্রীর ছোট্ট করে জবাব, ‘ও কখনো চিঠির রিপ্লাই দেয়নি।’ আগে কী ভেবেছিলেন একসঙ্গে স্টেজে জাদু প্রদর্শন করবেন? বিপাশাই আগে জবাব দিলেন, ‘না কখনই ভাবিনি।’ এবার খেয়াকে প্রশ্ন। বাবা-মায়ের জাদুশিল্প খেয়াকে কতটা টানে? ‘বাবা-মা তো আমার কাছে ম্যাজিকের মতো! স্বপ্নের মানুষ! তাদের ম্যাজিক খুবই ভালো লাগে। বাবা-মায়ের মধ্যে কোয়ালিটি আছে। বাবা তো অলরাউন্ডার! জানি না তাদের সেসব গুণ আমার মধ্যে কেমনভাবে আছে।’ কোন বয়সে তাদের সঙ্গে প্রথম শো করা? ‘নয় বছর বয়সে। কনফিডেন্স ডেভেলপ করতে ছোট ছোট ম্যাজিক দিয়ে শুরু।’ তুমি তো ভালো গানও গাও? ‘গান গাইতে ভালো লাগে। চেষ্টা করি।’ জুয়েল আইচ কথার সঙ্গে যোগ করে বললেন, ‘ও আমার সঙ্গে স্টেজে গান গায়। খুবই ভালো গান করে। অ্যাকটিং, কমেডি সে ভালো করে। কথা খুব সুন্দর করে বলে।’ বাবা-মায়ের কোন বিষয়টা আকৃষ্ট করে? ‘তাদের সঙ্গে থেকে আমি মোরাল-ভ্যালুজ শিখেছি। তাদের ব্যক্তিত্ব অসাধারণ! ভুল কিছু করলে তারা ভয় দেখায় না। আমার ওপর ছেড়ে দেয়, আমাকে সাপোর্ট দেয়।’

ঘরের একটি দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বিখ্যাত বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সঙ্গে জুয়েল আইচের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ছবিটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে জুয়েল আইচ নিজ থেকেই বললেন, ‘তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি রয়েছে। একটি অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর ছবিটি তোলা। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গেও বেশ সখ্য ছিল।’ বাঁশি বাজানোর সুবিধার জন্য নিজেই তো একটি বাঁশি  তৈরি করেছিলেন? ‘হ্যাঁ, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার দেওয়া নাম ‘জুয়েল বাঁশি’।’ জুয়েলের সপ্রতিভ উত্তর। তিন হুমায়ুনের সঙ্গে আপনার দারুণ সখ্য ছিল; তিনজনই আজ শুধুই স্মৃতি। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। অনেক অজানা বিষয় জেনেছেন। কিছু স্মৃতি শেয়ার করবেন কী? ‘তিনজনই ছিল অত্যন্ত কাছের, বন্ধুর মতো। সুযোগ পেলেই হুমায়ূন আহমেদের বাসায় চলে যেতাম। দুজনে আড্ডা দিতে দিতে সময় পার হয়ে যেত। যখন যা মনে চাইত তাই করতেন। তিনি আমাকে নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন। তার একটি নাটকে অভিনয়ও করেছিলাম। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন স্টেট ফরোয়ার্ড আর ঠোঁট কাটা স্বভাবের। আর হুমায়ুন ফরীদিকে ভালোবাসার মানুষ বলা যায়।’ জুয়েল আইচের কথাকে কেড়ে নিয়ে সহধর্মিণী বিপাশা আইচ বললেন, ‘ফরীদি ভাই মারা যাওয়ার এক থেকে দেড় মাস আগে আমার সামনের এই চেয়ারে বসে ছিলেন। নিয়মিত আড্ডা দিতাম হুমায়ূন আহমেদের ধানমন্ডির গুলতেকিন বাসা, আমাদের বাসা আর হুমায়ুন ফরীদির বাসায়।’ মেয়ে খেয়া যোগ করে বললেন, ‘তিনি সময় পেলেই চলে আসতেন।’ জুয়েল আইচ স্মৃতিকাতর হয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘তিন হুমায়ুন আমার জীবনের জন্য প্রচণ্ড একটা কষ্টের নাম। হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার কখনই ঝগড়া ছাড়া আড্ডা শেষ হতো না। হুমায়ূন আহমেদ তো একেবারে কলিজার লোক। বিচিত্র রকমের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয়, কাছে ডাকতেন, মজা করতেন। প্রতিদিন আড্ডার প্রোগ্রাম করতেন, তার লেখা স্ক্রিপ্টও থাকত সেখানে। তিনি কীভাবে মজা করবে, তার পরিকল্পনা করে রাখতেন।’ স্ত্রী বিপাশা কথার সঙ্গে যোগ করে বললেন, ‘হুমায়ূন ভাই শেষের সময় যখন চলে গেলেন আমেরিকাতে, মাঝখানে ফিরেও এসেছিলেন। সেই সময়ের আগের পর পর তিন রাত আমরা রাত ৩টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি।’ দেয়ালে ঝুলানো কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের আঁকা পেইন্টিং দেখে মনের অজান্তেই প্রশ্ন করতে আগ্রহ জন্মালো। আমার প্রশ্ন ধরতে পারলেন জুয়েল আইচ। বললেন, ‘এটি হুমায়ূন  আহমেদ দিয়েছেন। তিনি ভালো পেইন্টিংও করতেন। শেষবার যেদিন তিনি অসুস্থতার কারণে আমেরিকায় চলে যান, সেদিন এই কাঁচা ছবিটা উপহার হিসেবে দিয়ে যান। রং তখনো শুকায়নি।’ হুমায়ুন ফরীদির স্মৃতি রোমন্থন করে বললেন, ‘আর হুমায়ুন ফরীদি কেন যে আমাকে এত ভালোবাসত জানি না। ফরীদির তখনো পয়সাপাতি হয় নাই। একদিন আমাকে দাওয়াত করল। তখন সে থাকত ভিকারুন নেসা স্কুলের উল্টো দিকের একটি ছোট্ট বাসায়। বলল, বন্ধু ! তুমি আমার বাসায় আসবে, একসঙ্গে খাব। তুমি কী খেতে পছন্দ কর? বললাম, কী খাব! সবই তো খাই। সে বলল, তবুও বল। বললাম, মাছ আর ডাল হলে মহাখুশি। তারপর নির্দিষ্ট দিনে গেলাম, প্রচুর আড্ডা হলো। এরপর খাবারের জন্য ডাকল কাজের ছেলেটি। ওমা, গিয়ে তো চোখ উপরে ওঠার মতো অবস্থা! এমন কোনো মাছ নেই যে সে দুটো খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখেনি। এর মধ্যে এমন এমন মাছও আছে যেগুলো আমরা ছোটবেলাতে কাদার মধ্যে ধরতাম। বললাম, একি করছ পাগল? সে বলল, বন্ধু তুমি তো বলেছ মাছ খেতে পছন্দ কর, তাই এই আয়োজন। পরে জেনেছি, সে ভোর রাত্রীতে উঠে ঢাকা শহরে সব জায়গা ঘুরেছে। যত মাছ দেখেছে তা থেকে কিছু কিছু কিনেছে। ফরীদি ছিল এমনি দিলখোলা মানুষ।’ জুয়েল আইচ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ গুণীকে সমাদর করতেন। একবার কুদ্দুস বয়াতির দলকে বাসায় ডাকলেন গান শুনবেন বলে। তো তাদের রাতে শুতে দেওয়ার সময় ঘটল বিপত্তি। তারা তো এমন বিছানায় কখনো ঘুমায়নি। তাই ঘুমাচ্ছিল না, বসে ছিল। হুমায়ূন আহমেদ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ডেকে বললেন, এক কাজ কর, এস্ট্রের যে ছাই আছে সেগুলো হাতে-পায়ে মাখো। এরপর নিচে বিছানা পেতে শুয়ে পড়। ওমা! সত্যিই তারা তাই করল। সেদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে খুশি খুুশি মনে বললেন, স্যার কী যে বুদ্ধি দিলেন যে রাতে অনেক ভালো ঘুম হয়েছে। এই হলেন মজার মানুষ হূমায়ুন আহমেদ।’ আপনি একাত্তরের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কোন তাড়নায়? ‘মুক্তিযুদ্ধ করব, এরকম ভাবনা আমার আগে থেকে ছিল না। কারণ প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে কখনই যুক্ত ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মনে হলো, মরব যখন লড়াই করে মরব, যুদ্ধ করে মরব।’ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কিছু স্মৃতির কথা বলুন? ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই ৯ নম্বর সেক্টরের হয়ে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। ছোট বড় অনেক অপারেশনেই অংশ নেই। বড় অপারেশনটা করেছিলাম পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি থানায়। সেখানে বিশাল একটি পেয়ারাবাগানে কাঠের লঞ্চে করে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ব্যাটালিয়নরা মানুষ মারত; মানুষের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। একসময় তাদের সঙ্গে আমাদের গেরিলা যুদ্ধ হয়। আমরা অ্যামবুশ করে তাদের লঞ্চকে ডুবিয়ে দেই। ওদের চারজনকে আমি জ্যান্ত ধরে ফেলি।’ একটা সময় টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত জাদু প্রদর্শন করতে দেখা গেলেও গত কয়েকবছর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কী? ‘ঈদকে উপলক্ষ করে টিভিতে কিন্তু একসঙ্গে এখন তিনটি অনুষ্ঠান  করেছি। দীর্ঘদিন ধরেই তো জাদুশিল্পের সঙ্গে জড়িত। এখন যেটা হয়েছে, ম্যাজিকের ক্ষেত্রে আমি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করি। গত কয়েক বছর হলো বড় বড় ভেন্যু ছাড়া আমি শো করছি না। এটার কারণও সেই ইন্টারন্যাশনাল স্টান্ডার্ড বজায় রাখার চেষ্টা। এই স্টান্ডার্ড বজায় রাখতে গিয়ে শোর বাজেটও অনেক হয়ে যায়। কিন্তু ম্যাজিককে একটা স্টান্ডার্ড জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পর তা থেকে তো নেমে আসা যায় না। তবে, দেশের বাইরে কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেক পারফর্ম করেছি।’ পাশে বসে সহধর্মিণী একমনে সব শুনছিলেন। এবার তার দিকে একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।‘ অনেক শোতেই দেখা যায় জুয়েল আইচ বাঁশি বাজাচ্ছেন আর পাশে দাঁড়ানো আপনি বাঁশির সুরে তন্ময় হয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুজে ফেলেন। একসময় বাঁশির সুরে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ধীরে ধীরে শূন্যে ভাসেন। এটা কীভাবে সম্ভব? ‘এটিই তো ম্যাজিক...হা হা হা। সব কিছু বলে দিলে তো আর রহস্য থাকবে না। বহুবার এই ম্যাজিক মঞ্চস্থ হয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে।’ জাদুশিল্পের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওপর ঢাকাতে আর চলচ্চিত্র তৈরির ওপরে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড ফিল্ম স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন জুয়েল আইচ। ফিল্ম মেকিং নিয়ে পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করতেই আক্ষেপ করে উত্তর দিলেন, ‘ফিল্ম মেকিং যে করব, স্পন্সর কই? প্লান তো আছে। কিন্তু আর্থিক দিক চিন্তা করলে তা আর হয়ে ওঠে না।’ কথায় কথায় জানা গেল, তিনি ভালোবাসেন ঘুরতে আর আড্ডা দিতে। হাল প্রযুক্তির গ্যাজেটে তিনজনেরই রয়েছে আগ্রহ। তবে নিজেকে  ‘গ্যাজেটফ্রিক’ বলতে নারাজ জুয়েল আইচ। মেয়ে খেয়ার সঙ্গে দারুণ সখ্য বাবার। মেয়ের সঙ্গে নানান গল্প করে সময় কাটে জুয়েল আইচের। জুয়েল আইচ ইউনিসেফের পক্ষে গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে শিশুদের জন্য জনমত ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করছেন। পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করেন। নিজের জীবনের ওপর ‘অন্তরালের আমি’ ও জীবন জয়ের গল্প’ নামে দুটি আত্মজীবনীমূলক বই লিখেছেন। আগামী বইমেলায়তে বই বের করার প্লান আছে তার। তবে জুয়েল আইচকে নিয়ে কিছুটা আক্ষেপ ও দুঃখ থেকে যায় মনের অজান্তে। তিনি যে উচ্চতায় নিজেকে উন্মোচিত করেছেন, সেই উচ্চতার মূল্যায়ন কী আমরা সঠিকভাবে করতে পেরেছি? একুশে পদক কী তার এত অবদানের কাছে অমূল্য কিছু? জুয়েল আইচ একটা ব্র্যান্ড! চাই তার নামে গাড়ি, বাড়িসহ রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা থাকুক। গাড়ির নম্বর প্লেটে শোভা পাক অনলি ‘জুয়েল আইচ’! কারণ, বাঙালির গর্ব করার মতো একজন মানুষ জুয়েল আইচ, সুন্দর মানুষদের আইকন জুয়েল আইচ!

সর্বশেষ খবর