শনিবার, ২৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাসুদ রানা থেকে শাকিব খান

মাসুদ রানা থেকে শাকিব খান

চলচ্চিত্রে পথচলা প্রায় ২৩ বছর হলেও জনপ্রিয়তার পারদ তার চেয়েও অনেক ঊর্ধ্বে লতিয়ে গেছে। ঢালিউডের শীর্ষনায়ক খেতাবটি তার জন্য কম বললে ভুল বলা হবে না। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভঙ্গুর চলচ্চিত্র জগৎকে ওয়ান ম্যান শো হিসেবেই টিকিয়ে রেখেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক শাকিব খান। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ক্যামেরার সামনে তার সিনসিয়ারিটি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। অসাধারণ অভিনয় গুণ রয়েছে তার মধ্যে। কলকাতার খ্যাতিমান অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘শাকিব সত্যিই অসাধারণ অভিনেতা, তার মধ্যে যে অভিনয় গুণ রয়েছে তা অভিনয়ের জাত চিনিয়েছে, সত্যিই গর্ব করার মতো অভিনেতা তিনি।’ বলিউডের শক্তিমান অভিনেতা আশীষ বিদ্যার্থীও একই প্রশংসার ফুলঝুরিতে ভাসিয়েছেন শাকিব খানকে।

শোবিজ আড্ডায় এবার শাকিব খানের মুখোমুখি হয়েছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ                            ছবি : রাফিয়া আহমেদ

 

যেভাবে মাসুদ রানা থেকে শাকিব খান

চলচ্চিত্রে অভিনয় করব ছোটবেলা থেকে এমনটি কখনো ভাবিনি। আমার এবং মা-বাবার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হব। ১৯৯৫ সালের কথা। ড্যান্স ডিরেক্টর আজিজ রেজার সঙ্গে এফডিসিতে বেড়াতে এলে আবুল খায়ের বুলবুল, আফতাব খান টুলু, সোহানুর রহমান সোহানসহ বেশ কজন নির্মাতা আমাকে সিনেমার নায়ক বানাতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তবে অভিনয়ে আসাটা আমার জন্য সহজ ছিল না। বাবা কথাটা শুনে একবাক্যে ‘না’ করে দেন। তবে মায়ের ইচ্ছা ছিল। বাবাকে শেষ পর্যন্ত মা অনেক বুঝিয়ে রাজি করালেন। ব্যস, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের পরিবর্তে আমি মাসুদ রানা হয়ে গেলাম চিত্রনায়ক শাকিব খান। এ নামটি সোহান সাহেব দিয়েছিলেন।

 

শোবিজ স্পেশাল আড্ডায় শাকিব খান

বিশ্ব বলবে ওয়াও, এটি বাংলাদেশের ছবি?

আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। যাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ছবি দেখে সবাই একবাক্যে বলবে ‘ওয়াও, এটি বাংলাদেশের ছবি?’ এখন আমার এটিই একমাত্র মিশন। ‘হিরো দ্য সুপারস্টার’ ও ‘পাসওয়ার্ড’ ছবি দুটি নির্মাণ করে বলতে পারেন প্রাইমারি টেস্ট করেছি এবং তাতে সফল হয়েছি। আসলে টেকনিক্যাল, মেকিং, অ্যাক্টিং, লোকেশন মানে সবই সময় উপযোগী, মানসম্মত ও যথাযথ বাজেটে নির্মাণ হলে দর্শক অবশ্যই ছবিটি দেখবে। এর প্রমাণ সাম্প্রতিক ‘পাসওয়ার্ড’। যেখানে এখন আমাদের দেশে মাত্র ১৫০টির মতো সিনেমা হল আছে, সেখানে সময় উপযোগী ছবি পেয়ে দর্শক চাহিদায় তৃতীয় সপ্তাহে এসে ছবিটি ২৫০টি সিনেমা হলে চলছে। মানে শতাধিক বন্ধ সিনেমা হল ছবিটি চালানোর জন্য নতুন করে খুলেছে। এতে আমার মধ্যে আবার এই আত্মবিশ্বাস জন্মেছে যে, সত্যিকারের ছবি নির্মাণ করতে পারলে শুধু দেশে নয়, বিশ্বের দর্শকও তা লুফে নেবে। এ কারণেই একসঙ্গে আবার চারটি ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছি। আমি শুধু দেশ নয়, বিশ্বকেও দেখিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশের ছবির সোনালি অধ্যায় শেষ হয়ে যায়নি।

 

দর্শকদের আমরাই ঠকাচ্ছি

অনেকে বলেন, ‘এ দেশের ছবি এখন আর দর্শক দেখে না। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চলচ্চিত্র ব্যবসা আর নেই’- এসব কথার সঙ্গে আমি একমত নই। আসলে আমরাই দর্শকদের ঠকাচ্ছি, ছবির নামে মানহীন কনটেন্ট দিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছি। এ অবস্থায় শুধু ছবি নয়, কোনো পণ্যই কেউ গ্রহণ করবে না। আবারও বলব সত্যিকারের ছবি নির্মাণ হলে দর্শক তা গ্রহণ করবেই। ‘পাসওয়ার্ড’সহ আরও অনেক মানসম্মত ছবি এর প্রকৃত উদাহরণ। এখানে আগের একটি উদাহরণ টানতে চাই। কলকাতার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত আমার অভিনীত ‘শিকারি’ ছবিটি বিশ্বব্যাপী দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছে। ‘নবাব’ ছবিটি প্রথম কোনো বাংলা ছবি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে মুক্তি পেয়ে দর্শক চাহিদার কারণে সেখানকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে হলিউড আর বলিউডের ছবি নামিয়ে বেশি পরিমাণে স্ক্রিনে ‘নবাব’ প্রদর্শন করতে হয়েছে। এতে বিশ্বে বাংলাদেশের ছবির পরিচিত আবার তৈরি হয়েছে এবং ভাবমূর্তি বেড়েছে। তাই বলব বিশ্বায়নের এই যুগে এসে দর্শক ঠকানোর চেষ্টা করা মানে নিজেদেরই ঠকানো। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের বিপর্যয় ডেকে আনা। যা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাম্য হতে পারে না।

 

দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরি করতে পারিনি

চলচ্চিত্র নির্মাণে আমাদের আরেকটি বড় ব্যর্থতা হলো আমরা এখনো দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরি করতে পারিনি। এ কারণে বিদেশ থেকে টেকনিশিয়ান আনতে গিয়ে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়। এফডিসিতে ক্যামেরাসহ অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। কিন্তু টেকনিশিয়ানের অভাবে এগুলোর যথাযথ অপারেট সম্ভব হয় না। এফডিসি কর্তৃপক্ষের কাছে আমার প্রশ্ন, টেকনিশিয়ান তৈরিতে কেন বিদেশে পাঠিয়ে বা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষক এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। শুনেছি অদক্ষ টেনিশিয়ান দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি অপারেট করতে গিয়ে মূল্যবান ক্যামেরাসহ অনেক যন্ত্রপাতিই নষ্ট হয়েছে। এভাবে সরকারি অর্থের অপচয় আমরা কেন করছি? কেন চলচ্চিত্রশিল্পকে স্থবির করে ফেলছি। সঠিকভাবে কাজ করলে দেশের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যমটি থেকে তো সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব পেতে পারে।

 

বিশ্বায়নের যুগে অনুসরণ করা যেতেই পারে

অনেকে বলে আমাদের অমুক ছবি বিদেশি তমুক ছবির নকল। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া আমার ‘পাসওয়ার্ড’ ছবিটি নিয়েও অনেকে একই  অভিযোগ করেছে। আমি বলব বিশ্বায়নের এই যুগে নকল করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এক দেশ অন্য দেশের যে কোনো ভালো জিনিস অনুসরণ আর অনুকরণ করতেই পারে। এটি হলিউড, বলিউডসহ সারা বিশ্বেই হচ্ছে। সম্প্রতি সালমান খান অভিনীত ও মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের জনপ্রিয় ছবি ‘ভারত’ একটি তেলেগু ছবির অনুকরণে নির্মিত। সেখানে তো এ নিয়ে কোনো হৈচৈ হয়নি। আসলে আমরা এখনো বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। সব সময়ই হীন মানসিকতা আর দৃষ্টিভঙ্গির দৈন্যতায় ভুগছি বলেই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগুতে পারছি না। এসব পরিহার করা উচিত। শুধু এখন কেন, সত্তরের দশক থেকেই তো আমরা বিদেশি ছবির অনুকরণে ছবি নির্মাণ করে আসছি। যেমন বলিউডের বিখ্যাত ছবি ‘শোলে’র আদলে এখানে নির্মিত হয়েছিল ‘দোস্ত দুশমন’, ‘রুটি’ আর ‘দেওয়ার’-এর হুবহু কপি ছিল ‘একমুঠো ভাত’ আর ‘সেতু’। এমন অনেক উদাহরণ আছে। তখন এসব নিয়ে কেউ তো কিছু বলেনি। সেন্সর বোর্ডও এসব ছবি আটকায়নি। তাহলে এখন কি হলো?

 

এমন চলচ্চিত্রবান্ধব প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র ও এই জগতের মানুষের সুখে-দুঃখে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন তা সত্যিই অভূতপূর্ব। তিনি চলচ্চিত্র দিবস এবং একে শিল্প ঘোষণা, এফডিসির আধুনিকায়ন, বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি এবং ফিল্ম আর্কাইভ ভবন নির্মাণ এবং অসহায় চলচ্চিত্রকারদের পাশে যেভাবে ত্রাণকর্তার মতো এসে দাঁড়িয়েছেন অতীতে কখনো অন্য কোনো সরকারের ক্ষেত্রে তা দেখা যায়নি। চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের মানুষের প্রতি তার আন্তরিকতা ও মাতৃত্বসুলভ আচরণ সত্যিই অনুকরণীয়। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই শিল্পের উন্নয়নে আরও অনেক পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করেছেন। চলচ্চিত্রকাররা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে তার সহযোগিতা চান তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে আবারও এই শিল্পের সোনালি ঐতিহ্য আমরা ফিরে পাব ইনশাল্লাহ।

 

সরকারের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না

এখন সিনেপ্লেক্সের যুগ। সারা বিশ্বে সিনেপ্লেক্স কালচার চলছে। ছবির প্রতি দর্শক আগ্রহ বাড়াতে সিনেপ্লেক্স বাড়াতে হবে। মানসম্মত ছবির পাশাপাশি ছবি দেখার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশও চাই। সিনেমা হল মালিকরা যদি সিনেপ্লেক্সের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকেন তাহলে সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না। সরকার হয়তো এর জন্য লোন দিতে পারে। সিনেমা হল সংস্কার ও এতে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনেও সরকারি লোনের ব্যবস্থা হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ করে সমস্যার সমাধান করা কোনো ব্যাপার নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নির্মাতারা সিনেমা হল থেকে যে শেয়ার মানি পান তা সিনেমা হল মালিকদের নিশ্চিত করতে হবে। নির্মাতাদের যদি সিনেমা হল মালিকরা নানাভাবে ঠকান এবং ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করেন তা হলে লোকসান গুনতে কে আসবে এই শিল্পে।

 

সিনেমা হলের উন্নয়নসহ নানা পরিকল্পনা

চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে প্রাইভেট স্টুডিও ও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ, সিনেমা হলের প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নসহ নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা ব্যক্তিগতভাবে আমার রয়েছে। এতে দেশীয়ভাবে এই শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে চলচ্চিত্র রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে বাংলাদেশ। কারণ বিশ্বজুড়ে যে কোটি কোটি প্রবাসী বাঙালি রয়েছে এবং যারা নিজ দেশের ছবি দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন শুধু তাদের মাধ্যমেই এই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা।

 

মূল্যায়ন হওয়া দরকার

দর্শকদের ভালোবাসা একজন তারকাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখে। অনেক সময় দুঃখ হয় মৃত্যুর পর সরকারি তরফ এবং নিজ কর্মস্থল থেকে একজন তারকার মূল্যায়ন হয় না। এতে অন্যদের মনে হতাশা বাসা বাঁধে। যেমন নায়করাজ রাজ্জাক সাহেবের কথাই ধরি। তার মতো একজন কিংবদন্তির প্রয়াণের এক বছর পরও তার স্মৃতিকে অমর করে রাখতে সরকার বা চলচ্চিত্র অঙ্গনে আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই কলকাতায় তার নামে স্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তন করা হলো। আমাদের মানসিকতার এ কেমন দৈন্যতা। এর আগে নায়ক সালমান শাহর অকাল মৃত্যুর পর তার নামে এফডিসির একটি স্থাপনার দাবি করা হয়েছিল। যা আজও পর্যন্ত পূরণ হয়নি। কথায় আছে, যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মায় না। আমরা কি তাহলে সেই পথেই হাঁটছি?

 

ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন

দর্শকদের ভালোবাসা আজ আমাকে শাকিব খান বানিয়েছে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি তিনবার। ভারতের দর্শকরাও আমাকে তাদের অন্তরে ঠাঁই দিয়েছে। সেখানেও টেলিসিনে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। ‘সীমানার গ-ি বেঁধে রাখতে পারেনি আমাকে’- এটি আমার ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন। চলচ্চিত্রশিল্প আমাকে যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি সবই দিয়েছে। তাই এই শিল্পের দুর্দিন কাটিয়ে তোলা আমার একান্ত দায়িত্ব। জীবনে অন্য সবের আগে চলচ্চিত্রই আমার কাছে সবকিছু। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চলচ্চিত্রের কল্যাণেই কাজ করে যাব।

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর