রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পূর্বাপর ঘটনা

ওয়াহিদা আক্তার

প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ (অতিরিক্ত সচিব)

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পূর্বাপর ঘটনা

মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিজয়ী বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাবসান হয়। বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় মানুষ উদ্বেগাকুল চিত্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকে। সমগ্র বাঙালি জাতির একটি প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন। কবে মুক্তি পাবেন, কবে দেশে ফিরবেন। সাধারণ মানুষ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের ভয়াবহতা, মানুষ হত্যা ও বিভীষিকার মধ্যে শেখ মুজিবকেই মনে করেছে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে, মুক্তি আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বঙ্গবন্ধুর ‘বজ্রকণ্ঠ’ নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচার করেছে অজস্র কথা ও গান।

অবশেষে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাঙালি বিজয়ের আনন্দাশ্রুতে ভাসে। মনে হয় সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জন সম্পূর্ণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি মুক্ত বাংলার মুক্ত আকাশে দেখা দিল। সেদিন মানুষ আবেগে অশ্রুসজল চোখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে এক নজর আগে দেখার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে। জয় বাংলা স্লোগানে আকাশ বাতাস চারদিক মুখরিত হয়। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণ করে নেয় লাখো লাখো জনতা। বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। ফুলে ফুলে ঢেকে গিয়ে আবেগে আপ্লুত বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বললেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। বিশ্বকবি তোমার সেই কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে।’ আরও বললেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় অত্যন্ত ভালোবাসি। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন আমার বাংলায় রাস্তা নেই, ঘাট নেই, খাবার নেই, আমার মানুষ গৃহহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি, তোমাদের সাহায্য চাই।’ তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ আজ স্বাধীন। সামনে আমাদের অনেক কাজ বাকি।’

বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে ফিরে আসেন তার প্রাণপ্রিয় বাংলার দুঃখী মানুষের কাছে। শুরু হয় বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বাংলাদেশ যেন একটি ধ্বংসস্তূপ।

১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, “জেল থেকে বের হয়ে দেখলাম, রেলওয়ে ভেঙে গেছে, চালের গুদাম নাই, দোকানে মাল নাই, ব্যাংকের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। আমার দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে। তাই আমার সহকর্মীরা বললেন, তোমাকেই সবকিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমার বাংলার স্বীকৃতি দরকার।” সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দায়িত্ব ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি মানুষের পুনর্বাসন করা; দেশের বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা; প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার; আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, আন্তর্জাতিক লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুনঃস্থাপন করা।

বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি অর্জন, আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা, ভূমি পুনরুদ্ধার, কৃষি উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পানি, জমি, বিদ্যুৎ সংযোগ। এ ছাড়া বিধ্বস্তপ্রায় পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ করা, চোরাচালানি বন্ধ করা, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, অভ্যন্তরীণ নাশকতামূলক কার্যক্রম রোধ করা।

পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও তখনো বহু এলাকায় রাজাকার-আলবদরদের দৌরাত্ম্য। বিহারি কলোনিগুলো তখনো পাকিস্তান রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যাওয়ার সময় রাজাকার-আলবদরদের হাতে অস্ত্র দিয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কোটি কোটি মানুষ ঘরছাড়া, স্বজনহারা, আহত নয় মাস যুদ্ধ চলায়। মাঠে ফসল নেই, রিজার্ভ নেই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে ভারতীয় ও পাকিস্তানি দুই ধরনের নোট চালু ছিল। তাই বাংলাদেশি মুদ্রা চালু করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সরকার যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের উদ্যোগ নেয়।

বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার আগেই বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসক ও এসপি নিয়োগ করে সর্বত্র দ্রুত সিভিল প্রশাসনের কমান্ডের আওতায় আনা হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর তাৎক্ষণিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে জাতীয় নেতৃবৃন্দ দেশে না এসে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ ঢাকায় আসেন ২৩ ডিসেম্বর। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর বিপর্যস্ত অবস্থা এবং পাকিস্তানভিত্তিক অর্থনৈতিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অর্থ ও সম্পদের চূড়ান্ত অভাব যথাযথ পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করা সম্ভব ছিল না। এ জন্য মন্ত্রিসভা ১ কোটি শরণার্থী ফেরতসহ অন্যান্য জরুরি বিষয় ভারতীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করে দেশে আসে এবং এ বিষয়টি এখন ভাবলে বিস্ময় সৃষ্টি করে। প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভা ও সচিববৃন্দ অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন নিঃসন্দেহে বলা যায়।

দেশের তৎকালীন বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সবকিছু সামাল দেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রকটতর হতে পারে সেই আশঙ্কা তাজউদ্দীন আহমদের ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বের সামনে সাময়িকভাবে দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এ জন্য বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন অপরিহার্য। এ ধরনের একটা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু দেশে এসে ‘আইনের ধারাবাহিকতা অধ্যাদেশ’ ও ‘প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার’ জারি করেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।

বাংলাদেশের প্রথম সরকার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের ধাঁচের হলেও বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর এটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের চরিত্র ধারণ করে। কারণ তিনি আজীবন সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষেই লড়েছেন। অনেকে মনে করেন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব না নিয়ে বরং মহাত্মা গান্ধীর মতো সবকিছু পরিচালনায় ভূমিকা রাখলে ভালো হতো। তারা হয়তো ভুলে যান অসাম্প্রদায়িক ও অহিংস নীতির প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীকেও জঙ্গিবাদীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে মুক্তি অর্জন করতে হয়েছে। দেশ স্বাধীন, সংকট পর্বত প্রমাণ। অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি আদায়, জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ সবকিছুর জন্য যুদ্ধকালীন সারা বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর আকাশচুম্বী ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তা ছিল সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্রের জন্য একমাত্র সম্পদ ও বিশ্বে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায়। তাঁর কোনো বিকল্প ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর উপরোক্ত সংকটের বাইরে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করা মানুষের মধ্যে দুটো ধারার সৃষ্টি হয়। তবে এ অবস্থা যে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হয় তা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সরকারের ভিতরের বিরোধ, বিশেষ করে খন্দকার মোশতাকের কর্মকান্ড ছিল প্রকাশ্য স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা। সে যে কোনো উপায়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন বা যে কোনো উপায়ে সংযোগ রক্ষায় বিশ্বাসী থেকে কর্মতৎপরতা চালালে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রকাশ্যে মতবিরোধ হতে থাকে। তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ ১৯৭০-এর নির্বাচনের ইশতেহার ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

যুদ্ধকালীন বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব এবং মুজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের বৈরিতা প্রকট হলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে। ছোট ছোট স্নায়ুগত ও ব্যক্তিগত মতবিরোধ ছিল স্বাধীনতাকামী এই নেতৃবৃন্দের মধ্যে। যা নিরসনের জন্য বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার নেতৃত্ব সবাই মেনে নেন। কিন্তু অন্য কারও নেতৃত্বে অন্তঃকলহ ও অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর এই দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে পড়ে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত আবেদনে মুক্ত এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্থানীয় জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বারবার আহ্বান জানানো হয়। রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সহায়তায় নির্যাতনের ঘৃণা, ক্রোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহা ক্ষমাহীন ক্ষোভে পরিণত হয়েছিল। এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ হলে দেশে আবার রক্তের প্লাবন বয়ে যাবে সরকার এ বিষয়ে সতর্ক ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর পরই একটি গ্রুপ ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা বের করে। ধীরে ধীরে এটি সরকারবিরোধী পত্রিকায় রূপান্তরিত হতে থাকে। সংবাদে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেও ‘নাই নাই’ খবর শুরু করে। ব্যাপারটা এমন যেন ‘নাই নাই’র সব দোষ বঙ্গবন্ধুর। তিলকে তাল করে সরকারের অসমর্থতাকে ব্যর্থতা বলে বিষয়গুলো জনগণের সামনে উপস্থাপিত হতে থাকে। বলতে গেলে হাজারো সংকটে ঘৃতে আগুন দেওয়ার কাজটি করতে থাকে ‘গণকণ্ঠ’। কেউ নিজেকে ‘বিপ্লবী কণ্ঠস্বর’, ‘বিপ্লবী যুবনেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে ধূলিসাৎ করতে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার উভয় গ্রুপের হাতে অস্ত্র থাকায় অস্ত্র উদ্ধার কঠিন হয়ে পড়ে। তারা অস্ত্র জমা দেওয়ার পরিবর্তে অস্ত্র হাতে স্বশাসিত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী হয়ে পড়ে। এতে স্বাধীনতাবিরোধীরা উৎফুল্ল হয়।

বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ফিরে এলে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা অরাজকতা শুরু করে। তাদের ক্ষমতার আকাক্সক্ষা হয়তো ছিল কিন্তু উল্লেখযোগ্য অবদান না থাকায় মুখ ফুটে না বলে দেশে অশান্তি সৃষ্টি করে, এতে স্বাধীনতাবিরোধীরা খুশি হয়। আর এ সুযোগ করে দিয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই তাদের অপচর্চা শুরু হয়ে যায়।

১৯৭২-এর মার্চ থেকে তারা বঙ্গবন্ধু সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেন, “এখন যারা সমালোচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাঁদের কাউকে যুদ্ধে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই, তাঁরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে সবাইকে একতাবদ্ধ করে যুদ্ধ শুরু করেন, সারা দুনিয়ায় লোক পাঠিয়ে বাংলাদেশের কথা জানিয়ে দেন। সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি লোক প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তারা স্ত্রী পুত্র কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। নদীতে লাশ, ঘরে ঘরে লাশ, মানুষের মা-বোনের আর্তনাদ, চারদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ তবু সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই। তারা ইয়াহিয়া খানের দালালি করেছে।” (৭ জুন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ১৯৭২)।

তাদের পত্রিকা সরকারকে তীব্রভাবে আক্রমণ করতে থাকে। তারা প্রত্যন্ত এলাকার অনুসারীদের অস্ত্র জমা না দেওয়ার নির্দেশও দেয়। গুপ্তহত্যা ও বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তহত্যায় বঙ্গবন্ধু মর্মাহত হন। তাদের ভাষা, ভঙ্গি, বক্তব্য ছিল জঙ্গি প্রকৃতির। ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল সংসদে শোক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ পর্যন্ত ১৩২ জন আওয়ামী লীগ কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’ তাদের বড় মিশনই ছিল বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করা। বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। তাই জামায়াত, রাজাকার, আলবদর সবাই বাম রাজনীতির ছদ্মাবরণে রং পরিবর্তন করে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে তৎপর থাকে। এভাবে সারা দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিরাপদ প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাম রাজনীতির ধারা। বাংলাদেশবিরোধীরা এই বিষবৃক্ষ ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

মেজর জলিল ‘গণকণ্ঠে’ একটি লেখা ছাপেন যার মূল বক্তব্য ছিল খুলনার মিল-কারখানার যন্ত্রপাতি ভারতীয় সৈন্যরা নিয়ে গেছে। ভারতবিরোধী এই মিথ্যাচার করে তিনি প্রচার করেন যে, এই বক্তব্য দেওয়ার জন্য সরকার তাকে জেলে দিয়েছে কিন্তু ১৯৭২-এর মার্চের মধ্যেই খুলনার মিল-কারখানা খুলে যায়। কোনো যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলে মিল চালু করা সম্ভব হতো না। প্রকৃত তথ্য হলো- তিনি ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর খুলনা অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রশাসন চালু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর কমান্ডের বাইরে গিয়ে অবাঙালি নারী ও শিশুদের হত্যা ও নির্যাতন করেন এ জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণ কাজে সরকারের কোনো অনুমোদন ছিল না।

বঙ্গবন্ধু আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর হন। বঙ্গবন্ধু অপরাধের সঙ্গে জড়িত দলীয় এমসিএদের ব্যাপারেও কঠোর হন। এক দিনে তিনি ১৯ জন এমসিএকে বহিষ্কার করেন। এরা পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে জায়গা পায়। ১৯৭১-এর পর মওলানা ভাসানীও দায়িত্বশীল ভূমিকায় ছিলেন না। তিনি দেশে ফিরে রাতারাতি সব সুশৃঙ্খল হয়ে যাবে আশা করেছিলেন কি না জানা যায় না। তিনি ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি ফিরে এসে একটা পত্রিকা চালু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন এবং সরকারের কাছে ‘হক কথা’ নামে একটি পত্রিকার জন্য আবেদন করেন। সরকার অনুমোদিত ‘হক কথা’ সম্পাদক হিসেবে একজন পাকিস্তানি দালালকে দিয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের বিরোধিতার আর একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করেন। এমনও হতে পারে তার ওপর সওয়ার হয়ে পাকিস্তানি স্বাধীনতাবিরোধী দালালরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। প্রথম দিনেই ‘হক কথা’য় ছাপা হয় ‘স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনচেতা সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি?’ নানা রকম উত্তেজনাকর শিরোনাম দিয়ে মানুষকে উসকে দেওয়া হয়। মানুষকে ভারতবিরোধী সংবাদ পরিবেশন করে ‘হক কথা’ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সৃষ্টি করতে থাকে। মাত্র এক মাস না যেতেই ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ‘প্রয়োজন হইলে ভুখা মিছিল বাহির হইবে’ শিরোনামে হেড নিউজ করে। তাঁর অপরিণামদর্শী বক্তব্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে এ ধরনের লাগামহীন সাংবাদিকতা চলতে পারে না। দেশের জন্য তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হলেও আদর্শিকভাবে যে কোনো উপায়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার সময় ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেন ‘আমরা একটি বন্ধনে টিকে থাকতে পারি কি না।’ এ জন্য বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লেখ করে নাকচ করে দেন। কিন্তু ভুট্টো তথা পাকিস্তান কখনই সেই আশা পরিত্যাগ করেনি। দেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির মাধ্যমে এই লক্ষ্যে তারা কাজ করতে থাকে।

আমার স্বাভাবিক কৌতূহল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লিখিত স্বনামধন্য লেখকের লেখা পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা স্বাধীনতা যুদ্ধে কি ভূমিকা রেখেছিল জানার অদম্য কৌতূহল থেকে কিছু জানতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে ইতিহাসের মহানায়কদের নিয়ে রচিত বহু গ্রন্থ তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি বিশ্লেষণ করে লেখকগণ লিখেছেন, কিন্তু ইতিহাসের খলনায়ক, বিশ্বাসঘাতক, মোনাফেক, মীরজাফর, খুনি মোনাফেক মোশতাকদের চরিত্রও বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। তাহলে আগামী প্রজন্মের নেতৃবৃন্দ উপকৃত হবেন। বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও খুনি মোশতাকদের এমন কিছু চরিত্রের বৈশিষ্ট্য থাকে যে, তারা বন্ধুরূপে মিশে যেতে পারে। ক্ষমতার কাছাকাছি দায়িত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যেতে পারে। পরে সুযোগমতো বিশ্বাসঘাতকতা করে। এদের চরিত্র নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করতে তারা ভারতবিরোধী ও ইসলাম ধর্মের অপব্যবহার করা শুরু করে।

সাধারণ মুসলমানদের এভাবে বোঝানো হতো যে পাকিস্তান হচ্ছে পবিত্র স্থান আর ভারত হচ্ছে হিন্দুস্তান। ভারত সহযোগিতা করা মানে দেশকে হিন্দুস্তান বানিয়ে ফেলা। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধারণার বিশ্বাস করা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মধ্যে অসুস্থ মানসিকতার পাকিস্তানপ্রীতি থাকা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে এই সংকট বঙ্গবন্ধু হত্যার পথকে প্রশস্ত করে দেয়। পাকিস্তানের প্রতি প্রীত ছিল মোশতাক। সে আওয়ামী লীগের অন্যতম নীতিনির্ধারকও ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় সে ২ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে বন্দী ছিলেন। মোশতাক তখন গোস্বা হয়েছিল বলে জানা যায়।

১৯৬৬’র ৬-দফার আগে মোশতাক আওয়ামী লীগে ছিল না। পরে আবার দলে সক্রিয় হতে দেখা যায়। একাত্তরে ১৬-২৬ মার্চ যখন মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা হয় তখন সে প্রতিনিধি দলে ছিল। মুজিবনগর সরকার গঠনের সময়ও সে মারাত্মক জটিলতা তৈরি করে। বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদ যখন এপ্রিলের ৪ তারিখ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখন আলোচনার এক পর্যায়ে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করেন। এ নিয়ে হাইকমান্ডের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। অনেকেই মনে করেন, মোশতাক প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১৬-২৪ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ভেঙে গেলে সাধারণ জনগণ জানতে পারেনি। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলে জানতে পারে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে ২৫ মার্চ সারা দিন নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ৩২ নম্বরে দেখা করতে আসেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চান। ২৫ মার্চ রাতের বিষয়ে স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাঁর এক ভাষণে বলেন, “আজ দেশের অবস্থা সম্পর্কে আপনাদের জানা দরকার। ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী আমার ওপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাতে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা আমিই জানি। আমি জানতাম ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম বের হয়ে যাও। যেখানে পার এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার! স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেও। রাতে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম, আগে যাকে ইপিআর বলা হতো তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রাম পিলখানা হেড কোয়ার্টার। তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ আমার ছিল আমি যখন পিলখানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করে বললাম, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়্যারলেসে খবর দিয়ে দাও।”

বঙ্গবন্ধু আন্দোলনে সক্রিয় থাকার পরামর্শ দেন ও যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার জন্য বলেন। ওই দিন সব সিনিয়র নেতা ৩২ নম্বরে এলেও মোশতাক আসেনি শোনা যায়। সে কি কাজে কোথায় ব্যস্ত ছিল তা জানা যায় না। তবে নেতা-কর্মীদের তার প্রতি আস্থা ছিল না। কারণ সে সরাসরি কথা বলার চেয়ে নেপথ্যে পারঙ্গম ছিল বেশি এবং মুখে এক ধরনের সাপের মতো হাসি থাকত শুনেছি। এটাও বিশ্বাসঘাতকদের একটা বৈশিষ্ট্য। প্রথম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি কলকাতার ৯৩ সার্কাস এভিনিউয়ে বসতেন। এ অফিসকে কেন্দ্র করে একটা আলাদা বলয় গড়ে ওঠে। মোশতাক ছাড়াও তাহের উদ্দীন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, মওদুদ আহমদ-সবাই এই বিল্ডিংয়ে বসত। এখানে বসে প্রবাসী সরকারের যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত দোষগুণ চর্চা হতো। এর মধ্যেই গোপনে মোশতাক কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সঙ্গে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে একটি কনফেডারেশনে রাখা যায় কি না সে বিষয়ে সচেষ্ট হয়ে অনেক দৌড়ঝাঁপ করে। মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে।

খুনি মোশতাক অত্যন্ত হিসেবী মানুষ ছিল। বাংলাদেশে থেকে গেলে যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা জয়ী হলে সে দালাল হিসেবে গণ্য হবে ভেবে সে সবার সঙ্গে দেশত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল, সৈয়দ নজরুল ইসলামের তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন কিন্তু মোশতাক তার দুই ছেলেকে যুদ্ধের সময় লন্ডনে পাঠিয়ে দেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে তার অবস্থান ছিল। এতে মনে করা যেতে পারে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও তাকে ভারত পাঠানো হতে পারে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। একজন গবেষক তার বইয়ে বলেছেন, মোশতাক কলকাতাস্থ মার্কিন কনসাল অফিসের রাজনৈতিক কর্মকর্তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করে এবং প্রস্তাব দেয় “যদি তোমরা শেখ মুজিবকে ছেড়ে আলোচনায় বসো এবং ৬-দফা মেনে নাও তাহলে তাঁর দল সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থেকে সরে আসবে।” কিন্তু বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মোশতাকের বহু কর্মকান্ডতে প্রমাণ হয় সে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশ সরকার কখনই লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার দৃপ্ত প্রত্যয় সবার ছিল। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন চুক্তি হয়। ভারত আক্রান্ত হলে রাশিয়া সাহায্য করবে এমন চুক্তি। ভারত পাকিস্তান দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল। তাই চুক্তিটি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তখন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, এই চুক্তিতে বাংলাদেশের কোনো লাভ নেই। এরপরই তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য তার নিজস্ব, কিন্তু সরকার মনে করে এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হবে।’

মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দীন ঠাকুর এরা সরকারে থেকে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানের পক্ষে শক্তি হিসেবে কাজ করে। এদের কোনো কমিটমেন্ট ছিল না মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে। মোশতাক যে মনেপ্রাণে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছে তার আরও নজির আছে। নোবেল বিজয়ী শন ম্যাকব্রাইড বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লিখে পরামর্শ দেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তোমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাও। তারা এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ চিঠিটি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মাধ্যমে নিয়ম অনুযায়ী মোশতাকের কাছে পাঠান। চিঠি পড়ে মোশতাক ক্ষেপে গিয়ে বলে যে তোমরা আসলে কি চাও? বাংলাদেশের স্বাধীনতা না শেখ মুজিবুরের মুক্তি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, দুটোই চাই। এসব কারণে ১৯৭১ সালে অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মোশতাকের যাওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধির নেতা করে জাতিসংঘে পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে মোশতাকের এ ধরনের কর্মকান্ড বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে জানার সুযোগ পেয়েছিলেন কি না তা জানা যায় না। 

তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যারা কেউ মনেপ্রাণে বাঙালি ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অতিমাত্রায় বেশি। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। কিন্তু এই ইতিহাস থেকে এখনো অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়ে গেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার দুঃখী মানুষের কাছে তার মনের কথা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে উড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি আমি বাঙালি। আজ আমি বলতে পারি বাঙালি একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি বাংলার মাটি আমার মাটি এর বেশি তো আমি চাই নাই। আপনারা আমাকে সব দিয়েছেন। আপনারা তো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তো আমার জন্য বড় জিনিস নয়। আপনারা যা দিয়েছেন তা হলো আপনাদের ভালোবাসা, আমাকে আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে মরতে পারি। এর বেশি কিছু আমি চাই না।”

তথ্যসূত্র : ১. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে-মেজর রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম; ২. মূলধারা ৭১’-মঈদুল হাসান; ৩. ভাষণসমগ্র-এ কে আবদুল মোমেন সম্পাদিত ও ৪. সাম্প্রদায়িকতা থেকে জঙ্গীবাদ-মো. ফায়েকুজ্জামান।

সর্বশেষ খবর