রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

নারীর লড়াই, নিরাপত্তা ও বাস্তবতা

আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে গতকাল ইডব্লিউএমজিএল কনফারেন্স রুমে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজন করে ‘নারীর লড়াই, নিরাপত্তা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক। বৈঠকে অংশ নেন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষকসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে আমাদের সমাজের নারীদের বর্তমান অবস্থা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয়। ওই বৈঠকের চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন- গোলাম রাব্বানী, আকতারুজ্জামান, সাইফ ইমন ও আবদুল কাদের। ছবি : আবু তাহের খোকন ও রাফিয়া আহমেদ

 

 

রাতারাতি নারীদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যাওয়া কঠিন

মেহের আফরোজ চুমকি এমপি
সভাপতি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও নীতি-নির্ধারণী জায়গায় নারীরা যত বেশি আসবে তত বেশি আমরা আমাদের অধিকারগুলোকে বাস্তবায়িত করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী ইউপিতে মেম্বার পদে নারীদের নির্বাচনের সুযোগ করে দেওয়ায় হাজার হাজার নারী মাঠে আছে, আমরা তৃণমূলে তাদের দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সামাজিক কারণে দল-মত নির্বিশেষে এক প্লাটফর্মে আসতে হবে। নারী ছাড়া পৃথিবী কোনোভাবেই এগিয়ে যেতে পারে না। আমাদের প্রজন্মকে সমতার ভিত্তিতে তৈরি করতে হবে। আমরা যোগ্যতার ছাপ রাখতে পেরেছি। সুযোগ পেলে নারী কোনো অংশে কম নয়। সেই জায়গায় আমরা চলে গেছি। দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী অনেক কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।

 

নারীর লড়াই আছে, পুরুষের লড়াই থাকা উচিত

শামা ওবায়েদ
সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)

মানসিকতার পরিবর্তন ঘর থেকে শুরু হয়। নারীদের লড়াই ঘর থেকে শুরু হয়। আমি মনে করি সেই সব নারী অত্যন্ত ভাগ্যবান, যাদের পরিবার-পিতা-মাতা শতভাগ সহযোগিতা করেন তাদের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠায়। এটাই প্রমাণ করে যে, একজন নারী কীভাবে বেড়ে উঠবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সমতায় বিশ্বাস করি। সমতায় যখন আমরা বিশ্বাস করি তখন পুরুষের লড়াইটা কোথায়? আমরা পুরুষের লড়াই নিয়ে সেমিনার করি না কেন? আমাদের নারীর লড়াই আছে, পুরুষেরও লড়াই থাকা উচিত। এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষরাই শাসন করে যাচ্ছে। এটা রাজনীতি, করপোরেট- প্রতিটি সেক্টরে একই অবস্থা। নারীদেরকে নারীদের সাহায্য করতে হবে। এ দেশে আমরা সমতাভিত্তিক একটা সমাজ দেখতে চাই। যেখানে নারী-পুরুষ সবাই সবার জন্য কাজ করবে।

 

নারীর লড়াই শেষ হওয়ার জন্য পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া দরকার

নাসরিন ফাতিমা আউয়াল মিন্টু
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, উইমেন এন্টারপ্রিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব)

নারীর লড়াই শেষ হওয়ার জন্য পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন হওয়া দরকার। এসএমই নারীদের ফান্ড দেওয়া নিয়ে এত কথা হচ্ছে। আসলে কি এসএমই নারীরা সে রকম ফান্ড পাচ্ছেন? এখনো কিন্তু দেখা যায়, এ ফান্ডের জন্য ব্যাংকে ব্যাংকে ধরনা দিতে। শুধু ধরনা দিলেই হয় না, ব্যাংকে গেলে এতগুলো ফরম পূরণ করতে হয়! এটিও কিন্তু বিরাট বাধা নারীকে উঠে আসার জন্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য আমাদের অনেক নারীকে সন্ধ্যার পর বাইরে বের হতে দেওয়া হয় না। কিন্তু নারীকে উদ্যোক্তা হতে হলে, যদি পণ্যটি বিক্রি করতে চাই, মার্কেটিং করতে চাই তবে আধাবেলা কাজ করলে এটি সম্ভব নয়। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার। অর্ধেক জনসংখ্যাকে রেখে একটি দেশকে কি ঠিকভাবে গড়তে পারব?

 

বর্তমান রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে নারীদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে

ফরিদা ইয়াসমিন
সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব

রাজনৈতিক সদিচ্ছা একটি অনেক বড় বিষয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারী-পুরুষ সমঅধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। কিন্তু সেই সমঅধিকার আমরা এখনো পাচ্ছি না। বর্তমানে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এটা সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে। আমি যখন বিসিএস দিয়েছিলাম তখন আমার খুব ইচ্ছা ছিল পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেব। কিন্তু সে সময় কয়েক বছরের জন্য পুলিশ বাহিনীতে নারীদের নিয়োগ বন্ধ ছিল। অনেক রকম বাধা প্রতিবন্ধকতা ছিল যে নারীরা পারবে না। কিন্তু আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে নারীরা কাজ করছেন। তারা জেলা চালাচ্ছেন। নারীদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক সদিচ্ছার কারণে।

 

নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ দায়িত্ব রাষ্ট্রের

মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক

নারীদের অধিকার আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র ও রাষ্ট্রের মানসতন্ত্র যদি ঠিক হয় তবে এর প্রভাব সর্বস্তরে পড়ে। আর এই রাষ্ট্রের মানসতন্ত্র থেকেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটা আসে। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। ১৯৯৯ সালে নারীদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন র‌্যাংকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। তখন সামরিক বাহিনীর মতামত চাওয়া হলো। আমি সে সময় একটি সিলেকশন কমিটিতে ছিলাম। আমরা কিছুসংখ্যক অফিসার এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালাম। বললাম, এটি এখন সময়ের দাবি। তখন অনেকেই বলেছিলেন এখনো সময় আসেনি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন।

 

মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাসগুলোতে নারী প্রতিনিধি নেই

মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ পিএইচডি
নিরাপত্তা বিশ্লেষক

কাজের সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। যেমন কাতার, ওমান, মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে দূতাবাসগুলোতে কিন্তু কোনো নারী প্রতিনিধি নেই। অনেকে বলবেন এখানে হয়তো ধর্মীয় কোনো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু না, এখানে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই।

কারণ অন্যান্য দেশের অ্যাম্বাসিগুলোতে ঠিকই নারী কর্মী রয়েছেন, নারী অফিসার আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নেই। থাকলে সেসব দেশে নারী নির্যাতনের কথাগুলো উঠে আসত বেশি করে। আবার আমাদের দেশের অনেক সরকারি প্রতিনিধি সেখানে যাচ্ছেন, সংবর্ধনা নিচ্ছেন। কিন্তু তারা সেখানে কর্মরত আমাদের নারীরা কী অবস্থায় আছে সে খবর নিচ্ছেন না। আমি বিশ্বাস করি, নারীদের সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে।

 

শিক্ষা মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার একমাত্র অস্ত্র

ইমদাদুল হক মিলন       
সম্পাদক, কালের কণ্ঠ

নবাব ফয়জুন্নেসা এককভাবে নারী অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন। তিনি বুঝেছিলেন শিক্ষা একমাত্র অস্ত্র মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার জন্য। একাধারে যদি আমরা বেগম রোকেয়ার কথাও ভাবী। বাসায় চাচাতো  ভাই আসায় তিন দিন তাকে ছাদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রতিকূল অবস্থা থেকে বেরিয়ে তিনি অবরোধবাসিনী লিখলেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন, নারীর অগ্রযাত্রা নিয়ে কাজ করলেন। এই ক্ষেত্রে তাকে সবচেয়ে বড় সহযোগিতা করেছিলেন তার স্বামী সাখাওয়াত। এই পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সভ্যতা আসলে একটি সাইকেলের মতো। যাতে দুটি চাকাই লাগাতে হবে। সমাজের অগ্রগতির জন্য নারী-পুরুষের সমতা খুবই জরুরি। নারী দিবসে আমরা নারীদের নিয়ে অনেক কথা বলি, কিন্তু সারা বছর কি আমরা কথা বলি নাকি ভুলে থাকি?

 

সমাজের বলিষ্ঠ নারীরা অন্য নারীদের জাগ্রত এবং অনুপ্রাণিত করতে পারেন

নঈম নিজাম
সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন  

নারীর ক্ষমতায়ন বেশ পুরনো। আঠারোশ শতকের তেমনি এক নারী নবাব ফয়জুন্নেসা। তার বাবা জমিদার ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি সংসার জীবন শুরু করেছিলেন। তার স্বামী ছিলেন বড় জমিদার। কিন্তু তিনি সে সময় নারীর অধিকার নিয়ে বলেছিলেন ‘সতীনের ঘর করবেন না’। সাত দিনও থাকেননি স্বামীর বাড়ি। মহীয়সী এই নারী সামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।  সে সময় রানী ভিক্টোরিয়া তাকে নবাব খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। আঠারোশ শতকে একজন নারী সংগ্রাম করে যদি সম্মান অর্জন করে নিতে পারেন, তবে ২০২০ সালে এসে নারীর অধিকার বা সংগ্রামের জায়গাটুকু কোথায়? আমি বিশ্বাস করি সমাজের বলিষ্ঠ নারীরা যদি অন্য নারীদের জাগ্রত এবং অনুপ্রাণিত করতে পারেন তাহলে নারীর সংকট থাকবে না।

 

সব দলে কিছু পাপিয়া থাকে

নিলুফার চৌধুরী মনি
সাবেক সংসদ সদস্য, সহ-স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি

নারী-পুরুষ যখন সম্মিলিতভাবে কাজ করেছি তখন মনে হয় না যে, আমরা পুরুষের চেয়ে কম কাজ করেছি। আজকে নারী প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী। তারা সত্যি কি তাই? না শব্দগত। এখানে যদি উত্তরাধিকারসূত্রে হয়, আমার কিছু বলার নেই। সেখানে আমি নারী-পুরুষ চিন্তা করব না। আজকের যিনি প্রধানমন্ত্রী, কিংবা যিনি ছিলেন তাদের আমি ওভাবে মূল্যায়ন করি না। আমি মনে করি উত্তরাধিকারসূত্রে। সব দলে কিছু পাপিয়া থাকে। আমি শব্দগত এগিয়ে যেতে চাই না। মেন্টালি এগিয়ে যেতে চাই। মেন্টালি এগিয়ে যাওয়ার জন্য পুরুষদের ভীষণ ভীষণভাবে সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি যেটা দেখতে চাই, যেটা বলতে চাই, সেটা ঘরেও বলতে চাই, বাইরেও বলতে চাই। ঘরেও শুনতে চাই, বাইরেও শুনতে চাই।

 

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে রোল মডেল

অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

পুরুষই সুপিরিয়র হবে। পুরুষই কর্মক্ষেত্রে যাবে, পরিসংখ্যন কিন্তু এখনো এমনটাই বলছে। এই ভয়াবহ বাস্তবতার ভিতরে আমরা বলব, বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে আজকের বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে রোল মডেল। অমর্ত্য সেন নিজেই স্বীকার করেছেন ভারতের মেয়েদের থেকে আমরা অনেক এগিয়েছি। পুলিশ, সেনা অফিসার কিংবা পাইলট, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে মিডিয়া- সর্বক্ষেত্রে নারীর অবস্থান দেখছি। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়েও নারীরা রয়েছেন। তারপরও যে প্রশ্নগুলো আপনারা করছেন তা খুবই জটিল সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্ন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে যখন রাস্তায় একজন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা মাদকসেবী দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় তখন অনেক প্রশ্ন মনে জাগে।

 

নারীদের পরিবার, সমাজ এবং জীবনের সর্বস্তরে লড়াই করতে হচ্ছে

খুজিস্তা নূর-ই নাহারিন
সম্পাদক, পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজ

আমি প্রায়শই দেখি আমার লেখায় কিছু মৌলবাদী আমাকে নারীবাদী বলে মন্তব্য করে। তারা শব্দটিকে বকা হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। নারীবাদ বলতে আমি যেটা বুঝি তা হলো- পুরুষের বিরোধিতা করা নয়, পুরুষকে বাদ দিয়ে এগিয়ে চলা নয়। নিজের আত্মসম্মান এবং অধিকার আদায় করা। নারীর প্রতি সব প্রকার বৈষম্য, নিপীড়ন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সে হিসাবে সবাই নারীবাদী। বাংলাদেশের গার্মেন্টের নারী কর্মী থেকে শুরু করে সব নারী নারীবাদী। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে লড়ছে। বিশেষ দিনটি প্রমাণ করে নারীদের এখনো লড়াই করতে হচ্ছে। নারীদের পরিবার, সমাজ এবং জীবনের সর্বস্তরে লড়াই করে এগিয়ে আসতে হচ্ছে। প্রতিমুহূর্তে প্রমাণ করতে হচ্ছে তিনি যোগ্য।

 

যোগ্যতা থাকলে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না

সামিয়া রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের যুগে নারীর প্রতি অত্যাচার, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার নাকি আমাদের নৈতিক মানসিকতার অবক্ষয় ঘটেছে সেটি আসলে দেখার বিষয়। নীতিনির্ধারণে নারীর অবস্থান এত কম কেন? এখন নারীরা প্রচুর কর্মক্ষেত্রে আসছে। আমাদের প্রতিটি নারীর জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে আমরা অনেকে শেয়ার করতে পারি, অনেকে পারি না। বলা হয় শিক্ষিত, স্বনির্ভর হলে নারীর উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে শিক্ষিত, স্বনির্ভর নারীকে ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হতে দেখছি। তবে মেধা এবং যোগ্যতা থাকলে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে, নারী উন্নয়নের সঙ্গে ধর্ম সাংঘর্ষিক নয়। সাংঘর্ষিক আসলে মৌলবাদী শক্তি। প্রত্যাশা থাকবে, নারী-পুরুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচবে।

 

বর্তমানে নারীর অবস্থান ভালো

নারগিস আক্তার
চলচ্চিত্র নির্মাতা

চলচ্চিত্রে আগের অবস্থা থেকে বর্তমানে নারীর অবস্থান অনেক ভালো। নারীর সংগ্রামের কথা বলে হয়তো কখনই শেষ করা যাবে না। এফডিসি বা অন্য কোনো লোকেশনের কথা বলতে গেলে দেখা যাবে, সেখানে না আছে নারী কর্মীর স্বাস্থ্যগত যতœ, না আছে ন্যায্য পারিশ্রমিক, না আছে সামাজিক নিরাপত্তা এমনকি না আছে কাজের ভালো পরিবেশ। এসব বিষয় যদি চলচ্চিত্র নীতিমালায় আনা হয় তাহলে একটা শ্রেণি যারা চলচ্চিত্রকে পেশা হিসেবে নিয়েছে তারা অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে যেতে পারে।

 

 

নারীর সমস্যা পরিবার ও সমাজের

শাহ্নাজ মুন্নী
গল্পকার, সাংবাদিক

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীও যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবমুক্ত তেমনটা নয়। কারণ, নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে আমরা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে আক্রান্ত। যে নারীরা নারীর বিরুদ্ধে এগুলো করেন তারা তো পুরুষতান্ত্রিক আচরণের প্রতিফলন ঘটান। একজন নারী আরেকজন নারীর দুঃখ, কষ্ট বুঝতে পারেন। গণমাধ্যমে অনেক নারী কাজ করছেন। অফিসেরও কিছু ভূমিকা পালন করা উচিত। নারীর সমস্যা শুধু নারীর একার সমস্যা নয়। এটা পরিবারের সমস্যা, সমাজের সমস্যা এবং দেশের সমস্যা।

 

 

একজন নারীকে পদে পদে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়

শম্পা ইয়াসমিন,
এসপি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন

একজন নারীকে সংগ্রাম করতে হয় সমাজ, তথাকথিত নিয়মের বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে। প্রতি পদে পদে একজন নারীকে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। তার সফলতার পেছনে পুরুষের ভূমিকা থাকে। তার পরিবারের ভূমিকা থাকে। আমার বাবার পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার কারণে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। বিয়ের পর আমার স্বামীও আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমান ভূমিকা রাখতে হবে। পরিবার থেকেই এই সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পুলিশ সপ্তাহ ২০২০ এর স্লোগান ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার পুলিশ হবে জনতার’। এর সঙ্গে আমি সুর মিলিয়ে বলব, ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার সুরক্ষা করব নারীর অধিকার’। নারীকে সম্মান করতে হবে।

 

বাবাকেই তার মেয়েকে সাহস দিতে হবে

আঁখি আলমগীর
সংগীতশিল্পী

নারীর উন্নয়ন, মন মানসিকতার পরিবর্তন যাই বলেন এক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একজন মা একজন ছেলেকে শিশুকাল থেকে এটি বোঝাবেন যে, ছেলের মতোই মেয়েটিও গুরুত্বপূর্ণ। বাবাকেই তার মেয়েকে সাহস দিতে হবে। মেয়েদের সুরক্ষার দিককে গুরুত্ব দিতে হলে প্রতিটি ফুয়েল স্টেশনে পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুম নিশ্চিত করা দরকার। এর সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ধর্ষক, অ্যাসিড সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ শাস্তি বা মৃত্যুদন্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। সাইবার ক্রাইমে নারী হয়রানির বিরুদ্ধে জোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানাই।

 

রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে

আরিফা রহমান রুমা
শিক্ষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

নারীর এগিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে বড় উপাদান হচ্ছে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা। শিক্ষায় বর্তমান সরকারের সহযোগিতা আর উদ্যোগের ফলে নারীরা অনেকটা এগিয়ে গেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার কথা বলতে গেলে দুঃখজনকভাবে বলতে হবে রাষ্ট্রের বড় একটি বাধা রয়েছে। কারণ, এখন পর্যন্ত উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। উত্তরাধিকার আইন থাকার ফলে পুরুষরা লাভবান হচ্ছে। এর কারণে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এটি আমাদের সংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

সর্বশেষ খবর