শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

শোকের মাস শেষে

জাফর ওয়াজেদ

শোকের মাস শেষে

শেষ হলো শোকের মাস। আজ ৫ সেপ্টেম্বর। হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তোলা মাসটির বিদায়ের সঙ্গে ক্রন্দনমাখা এক দুঃসহ যন্ত্রণার কাঁপা কাঁপা সুর বেজে ওঠে। এই শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রেরণা বারবার জাগরূক হয়ে ওঠে জাতির জীবনের প্রণোদনায়। বাঙালির জীবনের শোকের মাসটি অতীতকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হয়। কেন এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ? কেন, কার স্বার্থে, কারা এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে সংশ্লিষ্ট, তারও হদিস মেলে। কিন্তু পূর্ণচিত্র মেলে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। খুনিরা শাস্তিদন্ড পেয়েছে। তবে হত্যার নেপথ্যে যে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র ছিল, সে বিষয়গুলো চাপা পড়ে আছে। সেসব সত্য উদ্ঘাটিত হবেই। কারণ, এই নির্মম পাপ চাপা থাকবে না। পাপিষ্ঠদের মুখোশ উন্মোচিত হবেই। চল্লিশ বছর আগে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাই বাঙালির জাতীয় শোক দিবস। আর পুরো আগস্ট মাসই শোকের মাস। যে হত্যাকান্ডে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল জাতি। শোকে পাথরপ্রায়। সেদিন দেশব্যাপী মানুষকে অজানা আশঙ্কায় গ্রাস করেছিল। পুরো জাতি যখন নতুন সমাজ ব্যবস্থা ও নতুন সরকার পদ্ধতি প্রচলনের পথে ব্যস্ত, ঠিক তখনই আঘাত হানা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে বাংলাদেশে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। যার রেশ এখনো বহমান। ঘাতকরা এখনো উদ্যত। তারা মুছে দিতে চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার সৃষ্ট বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় নানা চক্রান্ত, সন্ত্রাস ও পারস্পরিক হানাহানির মধ্যে জাতির স্থপতির হত্যাকান্ডে সমগ্র রাষ্ট্রীয় কাঠামো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটিকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যে ধারার করাল গ্রাস থেকে জাতি এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।

কবি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর এক নাটকে চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘দুর্ভাগ্য সে দেশের নয়, যে দেশের বীর মরে, দুর্ভাগ্য সে দেশের যে দেশের বীর মরে না।’ শোকের মাস এলেই কথাটা ঘুরে ঘুরে মনে আসে। দেশে দেশে গৌরবের ইতিহাস রচিত হয়েছে রক্তের অক্ষরে বীরপুরুষদের আত্মত্যাগের কাহিনি দিয়ে। ডিএল রায়ের কথায়ও এসেছে- দেশরক্ষা, দেশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রসঙ্গ। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রই বীরত্ব প্রকাশের একমাত্র ক্ষেত্র নয়। বীরের মৃত্যু প্রতিদিন প্রতিক্ষণ ঘরে-বাইরে যে কোনো স্থানে, যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। যোদ্ধা নন, যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ নন, এমন অনেক মানুষ লোকহিতায় মৃত্যুবরণ করেছেন প্রকৃত বীরের মতো। যুদ্ধক্ষেত্রে যারা প্রাণ দেন, তারা বীরপুরুষ নন, নাটকে এমন কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে তারাও বীরপুরুষ। তবে দেশরক্ষী সৈনিক হিসেবে প্রয়োজন হলে তারা প্রাণ বিসর্জন দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তদুপরি তারা বেতনভুক। এই বেতনভুকদের একটি বিপথগামী দল রাজনীতির সম্পৃক্ততার রাষ্ট্রনায়ক শুধু নয়, বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল। জাতির পিতাকে হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সবকিছুকেই ভূলুণ্ঠিত করার প্রক্রিয়া চালু করেছিল। যার মূল্য জাতিকে ৪০ বছর ধরে দিতে হয়েছে। আমরা তো জানি আপন স্বার্থে নয়, দেশ আর দশের স্বার্থে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যিনি দেশসেবায় ব্রতী তিনিই প্রকৃত বীর। মানুষ ইতিহাসের মহত্তম অধ্যায় এরূপ মানুষের আত্মবিসর্জনের মহিমা নিয়ে রচিত। বঙ্গবন্ধু জনপ্রিয়তাকে লেশমাত্র মূল্য না দিয়ে জেনেশুনেই বিপদের পথে অগ্রসর হয়েছেন, আর সে কারণেই জীবন দিতে হয়েছে- এমনটা বলা হয়। জীবনদান আর জনপ্রিয়তা বিসর্জন সমান বীরত্বের দাবিদার হতে পারে।

আজকের সংকীর্ণ দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাকে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা বললে তাদের ছোট করে দেখা হয়। তাঁরা সমগ্র বাংলাদেশের। সমগ্র জাতির নেতা। তাই এটা বলা সঙ্গত হবে যে, আওয়ামী লীগ যে সম্মানের অধিকারী, দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলই সে সম্মান দাবি করতে পারে না। আরও দুঃখের বিষয় যে, দেশের এত সব দল এবং এত সব নেতার মধ্যে এখনো তেমন কোনো বীরের আবির্ভাব ঘটেনি, কাউকে সেভাবে প্রাণ দিতে হয়নি। সবাই বুঝি অক্ষত দেহে নিরাপদে বসবাস করছেন। এটা প্রমাণিত যে, আওয়ামী লীগের বাইরে কোনো নেতাকেই দেশবাসী বীরের মর্যাদা দিতে রাজি নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, দল বিরোধের ফলে দলীয় কর্মীরা প্রায়শই তো ঘায়েল হচ্ছে; কোথাও নিহত হচ্ছে। মরছে বটে, কিন্তু এ জাতীয় মৃত্যুর মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই।

বাংলাদেশে একালে যা হচ্ছে তা নিছক হাঙ্গামা বলা যায়। মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনিকে কেউ সম্মানের চোখে দেখে না। ছুরি মেরে, গুলি ছুড়ে, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচার গুপ্তহত্যা, ব্লগার হত্যার মতো নির্মম ঘটনাও কাপুরুষতার চূড়ান্ত। এর মধ্যে বীরত্ব নেই। রাজনৈতিক দলগুলো যতদিন বোমাবাজি এবং খুন-খারাবিতে লিপ্ত থাকবে, ততদিন কেউ তাদের সম্মানের আসন দেয় না। দেবে না। নেতৃবৃন্দ যদি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সাহস করে অনুগামীকে নিবৃত্ত করতে পারেন, তা হলে বরং কদাচিৎ বীরত্বের দাবি করতে পারবেন। এ যাবৎ বীরত্বের দাবি একমাত্র আওয়ামী লীগের। প্রাণ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। শুরুটা হয়েছিল ষাট দশক থেকে এবং আজও তা চলছে। তাই আওয়ামী লীগই বলতে পারে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘তুমি মোর জীবনের মাঝে মিশায়েছ মৃত্যুর মাধুরী।’ আজকের আওয়ামী লীগ যেন ভুলে না যায় সে বাঙালির মুখপাত্র, দেশোন্নয়ন, জাতির অগ্রগতির চাবিকাঠি তার হাতে। এই বাংলার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন যে বঙ্গবন্ধু, তাঁর নীতি ও আদর্শের মধ্যে রয়েছে বাঙালির বেঁচে থাকার, জেগে ওঠার প্রাণভোমরাটি। কিন্তু আওয়ামী লীগের আচরণ বা বাক্যবাণ যদি হয় অন্যান্য দলের মতো, তবে তাকেও মনে হবে অনুরূপ দল। অন্যসব দলও বুঝি তাকে তাদেরই সমান মাপের একটি দল হিসেবে দেখছে। আওয়ামী লীগ যেন ভুলে না যায় তার সর্বজনীন অবস্থান। যেন ভুলে না যায় সে হচ্ছে চধৎবহঃ ইড়ফু বা পিতৃতুল্য। অন্যান্য দল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য শক্তিগুলো তারই স্বজন। একদিন সবাইকে নিয়ে সে দেশজোড়া এক আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, যার পরিণতিতে যুদ্ধ এবং স্বাধীনতা, সে সময় সুবৃহৎ এক একান্নবর্তী পরিবারের সৃষ্টি করেছিল। ক্রমে সুপুত্রেরা স্বজনরা পিতৃগৃহ ছেড়ে এসে আলাদা হেঁশেল করে ছোট ছোট সংসার পেতে বসেছিল। সংসার পাতা সহজ, কিন্তু বনেদি হতে সময় লাগে। সেটা জীবনচর্যা সাপেক্ষ। সম্ভ্রান্ত জীবনচর্চার অভাবে প্রত্যেকটি দলেরই অবস্থা অনেকটা এরকম- হঠাৎ গজানো ভদ্দরনোকের মতো- চেঁচাচ্ছে, হাত-পা ছুড়ছে। আস্ফালনটাই বেশি- শোভন সুন্দর মার্জিত রুচির অভাব। আওয়ামী লীগেরও ছিল বনেদি স্বভাব। সে বারবার মার খেয়েছে, কিন্তু ফিরে বারবার মারেনি। একবারই জবাব দিয়েছে একাত্তরে। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেনই, ‘শান্ত যে, অজেয় তার বল।’ বঙ্গবন্ধু যুগে আওয়ামী লীগের মূলে ছিল এই ব্রত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অহিংস নিরস্ত্র জনগণের প্রচ- তেজ যখন প্রবল পরাক্রান্ত পাকিস্তানি হানাদারের সশস্ত্র দখলদারিত্ব টলিয়ে দিয়েছিল। আজকের আওয়ামী লীগকে আবার সেই শক্তির চর্চা করতে হবে অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার রথে আসীন হতে। তাকে বুঝতে হবে, অন্যান্য দল যা করে, যা বলে, যেমনভাবে চলে, আওয়ামী লীগকে তা মানায় না। তাকে জনগণের ভাষায় কথা বলতে হবে। আওয়ামী লীগকে লোকে যখন একটি দল হিসেবে দেখে এবং আওয়ামী লীগাররাও যখন নিজেদের একটি দল হিসেবে ভাবে এবং সেভাবেই ব্যবহার করে, তখন রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের একটি উক্তি চলে আসে। গোরা বলেছিল, ‘হিন্দু কি একটা দল? হিন্দু একটা জাতি। ঢেউ যেমন সমুদ্র নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।’ আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগ একটা দল নয়। আওয়ামী লীগ সমগ্র দেশ, আওয়ামী লীগই সমগ্র বাঙালি জাতি।

বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিমান নেতা হয়তো আছেন অনেক। কিন্তু আশঙ্কা করি তারা বোধকরি ভুলে যাচ্ছেন যে, দলটি যদি ছোট হয় সে পুরো দেশের কথা ভাবতে পারবে না। ফলে তার দাবি-দাওয়া হবে ছোট। এসব ক্ষেত্রে দলীয় নেতা যতই বিদ্বান-বুদ্ধিমান হোন, দলের খাতিরেই নিজেকে ছেঁটে-কেটে ছোট করে নিতে হয়। একদিন এই দলে আমরা যেসব বড় বড় নেতৃত্ব দেখেছি, আজ সারা দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া সে প্রজ্ঞার নেতা একজনও নেই। ফলে দু-চারজন ছাড়া বাকি নেতা ক্রমেই হাস্যকর হয়ে উঠছেন। এখন থেকে সাবধান না হলে একদিন তারাও হাস্যরসের উপকরণ জোগাবেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মুখে শোভা পায় না। মনে রাখা প্রয়োজন, উদ্দেশ্য সাধু হলেও কর্মপন্থায় যদি ভুল থাকে তা হলে হিতেবিপরীত হয়। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, সে দেশের, যে দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা মুখ ফুটে কিছু বলে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাদের মুখ বন্ধ ছিল বিচারের দাবিতে। বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধু যা রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয়।  বঙ্গবন্ধুর ঋণ পরিশোধ করা কঠিন। কিন্তু আমরা যেন বঙ্গবন্ধুর ঋণ স্বীকার করি।

লেখক : মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর