শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

লন্ডনে ১৫ আগস্ট ’৭৫

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

লন্ডনে ১৫ আগস্ট ’৭৫

আমি সস্ত্রীক কেন্দ্রীয় লন্ডনের কাছাকাছি একটি বাড়িতে বাস করতাম। একই বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটে ছিল আমার বন্ধু ফিদা কামাল (পরবর্তীতে অ্যাটর্নি জেনারেল)। আমরা দুজনই বারের ছাত্র। কিছু দিন আগে বিবিসিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন ম. মোহাদ্দেস, যিনি তখন বাংলাদেশ বেতারের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন। তিনি সেই বাড়িতেই আরেক ফ্ল্যাটে উঠলেন। আমার প্রয়াত স্ত্রী লায়লা চৌধুরী হাসি তখন বিবিসি বাংলা বিভাগে চাকরি করছিল। ১৪ তারিখ রাতে আমি এবং ফিদা পড়াশোনার বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ১৫ তারিখ শেষ রাতের দিকে চতুর্দিকে চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙতেই যে খবরটি শোনলাম আমাদের জন্য তা ছিল আকস্মিক বজ্রাঘাতের মতো। আমরা বাকহীন, হতভম্ব এবং বিশাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম। শোনলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে কয়েকজন মেজর, কর্নেল হত্যা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিবিসির সেরাজুর রহমান সাহেবকে ফোন করলে তিনি এ চরম বিষাদগ্রস্ত খবরটি নিশ্চিত করে বললেন, খন্দকার মোশতাক দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি এবং জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে। এ খবর থেকে আঁচ করতে দেরি হলো না যে, মোশতাক এবং জিয়াই এ হত্যাকান্ডের মূল চাবিকাঠি। আমি, ফিদা এবং মোহাদ্দেস সবাই বিষাদঘন অবস্থায় থমকে গেলাম। আমি রাষ্ট্রদূত সুলতান সাহেবকে ফোন করলেও তিনি আমার ফোন ধরলেন না। টেলিভিশন খুলে জানলাম বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে এবং পাকিস্তান তাৎক্ষণিকভাবে মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। পাকিস্তান যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত তাও বুঝতে বাকি রইল না। এর পরপরই এক অচিন্তনীয় ঘটনা দেখাল বিবিসি টেলিভিশন। দেখতে পেলাম ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, আবদুল্লাহ ফারুক নামক এক আইনের ছাত্র এবং নুরুল হক নামক আর এক আইনের ছাত্র, যারা কখনো পড়াশোনার দরজা অতিক্রম করতে পারেননি তারা বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে কনস্যুলার বিভাগের প্রধান নুরুল মোমেন খান মিহিরকে দোতলা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে মারধর করছে, বঙ্গবন্ধুর ছবি ভেঙে ফেলছে। এম আর আখতার মুকুলের দেয়াল টপকে বেরিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষার ছবিও বিবিসি টেলিভিশন দেখাল। সে সময় ক্যাপ্টেন ওকবা নামে এক অফিসারও লন্ডনে। তিনি ব্যারিস্টার রফিক মিয়া, আবদুল্লাহ ফারুক এবং নুরুল হকের সঙ্গে দূতাবাসে গেলে রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আবদুস সুলতান জামাই আদরের মতোই তাদের দূতাবাসে আপ্যায়ন করেন। ক্যাপ্টেন ওকবা পরবর্তীতে বিমানের এক কর্মকর্তা ছিলেন। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দূতাবাসের দায়িত্ব নিতে এসেছেন বলে দাবি করলেন। একটু পরে দেখলাম টেলিভিশনে রাষ্ট্রদূত সুলতান সাহেব বলছেন শেখ সাহেব (তখন আর তিনি বঙ্গবন্ধু শব্দ উচ্চারণ করেননি) নানা ধরনের অন্যায় করেছেন বলেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভাবলাম হায়রে নিয়তি। এ সুলতান সাহেব আগাগোড়াই পাকিস্তানপন্থি লোক ছিলেন, তিনি ‘তরুণের জিন্না’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। সুলতান শরিফ লন্ডনে ছিলেন না। যোগাযোগ করলাম গাফ্ফার ভাই, মতিন ভাই, তোসাদ্দক ভাই, সৈয়দ শামসুল হক, মিনহাজ ভাই, গাউস খান, হাসেম ভাই, মুজাম্মেল, নিখিলেশ চক্রবর্তী, রউফ, ডা. নুরুল আলম, জোয়ারদার, আতাউর রহমান খান, রমজান আলী প্রমুখ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। কিন্তু সবাই তখন গভীরভাবে মর্মাহত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। দুপুরে কবি সৈয়দ শামসুল হকের বাসায় আমরা কজনা গেলাম। এখানে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ আবদুস সুলতান খুনিদের পক্ষে এতকিছু করার পরও রাষ্ট্রদূতের চাকরিটি রক্ষা করতে পারেননি। সৈয়দ শামসুল হক তখন বিবিসি বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন বিধায় আমার প্রয়াত স্ত্রী লায়লা চৌধুরী হাসির ঊধ্বর্তন সহকর্মী ছিলেন। সেই সুবাদেই তার সঙ্গে পরিচয় এবং সখ্য। যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দর সঙ্গে বৈঠকে বসলাম। যোগাযোগ করলাম মিহির এবং এম আর আখতার মুকুলের সঙ্গে। সবাই বিধ্বস্ত, সবাই পিতৃহারা অনাথের মতো। সৈয়দ হক ভগ্নমনে। তারপরও আমাদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, খুনিদের বিচার একদিন হবে, তারা দেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। কিন্তু তা তারা করতে পারবে না। এর মধ্যে অক্সফোর্ডে অবস্থানরত ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি। দুই দিন পরে কেন্দ্রীয় লন্ডনের কনওয়ে হলে ছাত্রলীগ ন্যাপ এবং রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির সভা ডাকলাম হত্যার নিন্দার জন্য। ব্যারিস্টারি ছাত্র আকবর আমিন বাবুল, (যার পিতা আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন), ব্যারিস্টার রফিক মিয়া, আবদুল্লাহ ফারুক, নুরুল হক এবং চীন ও পাকিস্তানপন্থিদের নেতৃত্বে একদল এসে আমাদের দৈহিকভাবে আক্রমণ করে। অধ্যাপক আবুল হাসেম তখন যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের সভাপতি, সৈয়দ মোজাম্মেল আলী, যিনি প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, এনামুল হক, নিখিলেশ চক্রবর্তী, রউফ, ডা. নুরুল আলম, ব্যারিস্টার সাইদুর রহমান মিয়া প্রমুখ মিলে পাকিস্তানপন্থি ও চীনপন্থিদের আক্রমণ প্রতিহত করে সভা চালাতে পেরেছিলাম। পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতা পিটার শোর, স্যার থমাস উইলিয়ামস কিউসি, আইরিশ নোবেল বিজয়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শোন ম্যাক ব্রাইড, মাইকেল বার্নস প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভাবনীয় সাড়া পাই। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন খুনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। তিনি আমাদের সহায়তা চাইলে আমার প্রয়াত স্ত্রী হাসি, যিনি বাংলা টাইপ করতে পারতেন, টাইপ করার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। প্রকাশিত হলো সারা বিশ্বে প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাবিরোধী পত্রিকা ‘বাংলার ডাক’, আমাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সঙ্গিন। গাফ্ফার ভাই এখনো সব জায়গায় বলে থাকেন আমার প্রয়াত স্ত্রী হাসির সহায়তা ছাড়া তিনি ‘বাংলার ডাক’ প্রকাশ করতে পারতেন না। লন্ডনে অধ্যয়ন এবং প্রশিক্ষণগ্রহণরত ডাক্তার সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর উপস্থিতিও আমাদের আন্দোলনের পক্ষে ছিল এক বিরাট সহায়ক শক্তি। তিনি চিকিৎসক জগতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। আমার অগ্রজ ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, যিনি শহীদ শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীতে গাউস খানের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তিনিও ব্রিটিশ মূলধারার পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে এবং হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের মধ্যে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমরা রাস্তায় বের হলে পাকিস্তান ও চীনপন্থিদের ভর্ৎসনা শুনতে হতো। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে জিয়ে রাখতে হয়েছে প্রচারণার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ দর্শনে বিশ্বাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বহুদিন তারা চুপ করেছিল। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে সবাই সরব হয়ে ওঠেন। এ সময়গুলোতে আমরা বহু সভা-সমিতি করেছি বিভিন্ন জায়গায়। এক সময় বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী এবং তার ছেলে কায়সারসহ অনেকে লন্ডনে ফিরে এলেন এবং বক্তৃতা দিলেন, বিভিন্ন সভায় খুনিদের এবং তাদের মদদদাতা জিয়া-মোশতাকের কঠিন ভাষায় সমালোচনা করা হতো। আমরা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ, কথাবার্তা চালাচ্ছিলাম। অ্যামনেস্টি তখন সিদ্ধান্ত নিল নোবেল বিজয়ী আইরিশ রাজনৈতিক নেতা শোন ম্যাক ব্রাইডকে বাংলাদেশে একটি প্রাথমিক তদন্তে পাঠানোর জন্য। সেই মতে শোন ম্যাক ব্রাইড বাংলাদেশে গেলেন। লন্ডনে ফিরে তিনি জানালেন জিয়াউর রহমান তাকে এই মর্মে কথা দিয়েছেন যে, খুনের বিচার স্বাভাবিক আইনের পন্থায় হবে। যদিও জিয়াউর রহমান কখনো তা করেননি। আগস্টজুড়েই ব্রিটিশ টেলিভিশন, রেডিও এবং পত্র-পত্রিকায় মূল খবর হিসেবে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু খুনের খবর এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মন্তব্যসমূহ। প্রভাবশালী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ পিটার শোর, থমাস উইলিয়ামস, শোন ম্যাক ব্রাইড, লড ব্রোকওয়ে, মাইকেল বার্নস প্রমুখ নেতৃবৃন্দের কর্মতৎপরতার ফলে আমাদের শক্তি ও মনোবল বহুলাংশ বেড়ে যায়। এর মধ্যে ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকা বাঙালি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু পাকিস্তান এবং চীনপন্থিরাও বসে ছিল না, বসেছিল না পাকিস্তান ও চীন দূতাবাস। হত্যাকান্ডের আগে পাকিস্তান দূতাবাসের অর্থায়নে একাধিক বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা সেগুলো প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি। এরই মধ্যে মোশতাক সমর্থক একটি দল পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাঠে নেমে যায়। তাদেরও আমরা সব জায়গায় প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি। এ সময় যুক্তরাজ্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে জানতে পারলাম হত্যাকান্ডের মূল নকশা করেছিল জিয়া, মোশতাক, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায়, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশে পরিণত করার জন্য। সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করার চিন্তা তখনই জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে শফিক সিদ্দিকী, ড. সেলিম, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ কয়েকজনের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রথমে থমাস উইলিয়ামস কিউসি পরে পিটার শোর, শোন ম্যাক ব্রাইড, মাইকেল বার্নস প্রমুখ। এ পরিষদ গঠনে আমারও ছোট ভূমিকা ছিল এবং আমিও এ পরিষদের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম। পেছন থেকে সহায়ক ছিলেন গাফ্ফার ভাই, মতিন ভাই, মুকুল ভাই প্রমুখ সিনিয়র ব্যক্তিবর্গ। আস্তে আস্তে সময়ের যাত্রাপথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের শক্তি বহুগুণ বেড়ে গেলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি প্রবল হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালে আমরা যেমন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, বিভিন্ন দূতাবাস এবং ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দিতাম গণহত্যা বন্ধের এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবি নিয়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও, হত্যার বিচারের জন্য চাপ সৃষ্টি করার দাবি নিয়ে আমরা নতুনভাবে ব্রিটিশ পালার্মেন্ট, দূতাবাসসমূহ ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ধরনা দেওয়া শুরু করি। তাদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পেয়েছিলাম। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, মার্শাল টিটো, নায়রেরে, কেনেথ কাউন্ডা, ইন্দিরা গান্ধী, আনোয়ার সাদাত, ইয়াসির আরাফাত, সাদ্দাম হোসেন, উইলি ব্রান্ট, আন্দ্রে মালরোসহ বহু বিশ্ববরেণ্য নন্দিত নেতৃবৃন্দ হত্যাকারীদের সমালোচনায় ফেটে পড়েন। হত্যাকান্ডের বিরোধিতায় ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দসহ বিশ্বনেতাদের কঠোর বাণী সারা পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবি আরও অধিক গতি পেতে থাকে। আমরা হত্যাকান্ডের দুই দিন পরে পাকিস্তান, মার্কিন এবং চীনা দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করাকালে পাকিস্তান এবং চীনা সমর্থকরা আমাদের ওপর হামলা চালালে আমরা পুলিশের সহায়তায় তা প্রতিহত করি। এর মধ্যেই জিয়া-মোশতাকের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে জনমনে ঘৃণা সৃষ্টি হতে থাকে। আমাদের আন্দোলন শুধু বৈঠক ও সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা জিয়া-মোশতাকসহ অন্য খুনিদের ফাঁসির দাবি সংবলিত প্লাকার্ডসহ লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরে মিছিল করতে থাকি। যখন জানতে পারলাম জিয়া-মোশতাক খুনিদের বিভিন্ন দেশে লোভনীয় পদে পদায়ন করতে যাচ্ছে তখন আমরা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং অন্যান্য দূতাবাসে লিখিত দাবি জানালাম- যেন এসব খুনিকে কোনো দেশের দূতাবাসে গ্রহণ করা না হয়। ব্রিটিশ সরকার কোনো খুনিকে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত হতে দেয়নি। পোল্যান্ডও তাদের দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে একজন খুনিকে চাকরি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তাকেও সে দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে পদায়ন করতে পারেনি জিয়া-মোশতাক গোষ্ঠী। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সব দেশে বিভিন্ন স্তরের জনগণ খুনিদের বিরুদ্ধে হিংসা এবং ঘৃণায় ফেটে পড়েন। ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় জনগণ অবাক হয়ে যান কীভাবে বাংলাদেশের জাতির জনককে হত্যা করা হলো। ইউরোপ এবং আমেরিকার বহু নামিদামি সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ছবিসহ তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিকের কথা উল্লেখ করে অনেক প্রবন্ধ লেখে। সানডে টাইমসসহ কয়েকটি পত্রিকা খুনিদের ইন্টারভিউ ছাপায়। যেখানে খুনিরা স্পষ্ট ভাষায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে। কয়েকজন খ্যাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর জীবনী এবং সারা জীবনের কর্মকান্ড নিয়ে টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় ফিচার লিখতে এবং প্রদর্শন করতে থাকেন। তাদের কথায়ও পরিষ্কার হয়ে ওঠে জিয়াই ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল খলনায়ক। বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ বিভিন্ন তথ্য-উৎপাত্ত এবং যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে পাঠকদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে, হত্যাকান্ডের নীলনকশা প্রণয়ন জিয়াউর রহমানই করেছিলেন। পিটার হেজেল হার্স্ট, এন্থনি মেসকেরেনিয়াস, সাইমন ড্রিং, ডেভিড ফ্রস্ট, ডেভিড ডিম্বলবি, রিচার্ড ডিম্বলবি প্রমুখ সাংবাদিকও একই কথা লিখতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরপরই হত্যাকারী সরকার মুকুল ভাই এবং মিহির ভাইকে চাকরি এবং জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে দেশে ডেকে পাঠান। কিন্তু তারা দুজনই ঘৃণাভরে খুনিদের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে লন্ডনেই থেকে যান। ব্রিটিশ সরকারও তাদের লন্ডনে বসবাসের অনুমতি দিতে কার্পণ্য করেনি। মুকুল ভাই ‘মুজিবের রক্ত লাল’ নামে একটি বই লেখেন। চরমপত্রের মুকুল ভাইয়ের আত্মার প্রতি সবার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা উচিত। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের যেসব সদস্য এবং আত্মীয়-পরিজন শহীদ হয়েছিলেন, ৪ নভেম্বর যে চার নেতা শহীদ হয়েছিলেন তাদের সবাইকে সারা দেশের মানুষের মতো বিলেতে প্রবাসী বাঙালিরাও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে থাকেন।  ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয়  জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশ্বনেতা হিসেবে পরিচিত।

 

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর