১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৬:১৫

সীমান্তে শান্তির পায়রা: বন্ধুতার নতুন মাত্রা

হাসান ইবনে হামিদ:

সীমান্তে শান্তির পায়রা: বন্ধুতার নতুন মাত্রা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গল্পটা বহু পুরোনো। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের নামটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পূর্বকালীন সময় থেকে যুদ্ধকালীন পুরো সময়টাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে ভারত। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের পাশে তারা যেভাবে দাঁড়িয়েছিলো তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরেই লিখা থাকবে। 

যে দেশ তার নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে সীমান্ত উন্মুক্ত করে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো সেই দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতে এখন কেনো আমার দেশের মানুষের লাশ পড়বে? এই প্রশ্ন অনেকের মনেই। বিভিন্ন ইস্যুতে দু’দেশের সম্পর্কে টানপোড়ানোর সৃষ্টি হলেও দু’দেশের সম্পর্কের মাঝে বিষফোঁড়া হলো সীমান্ত হত্যা, সীমান্ত হত্যা নিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক প্রায়ই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। প্রত্যেক দেশ স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে কিন্তু সীমান্ত হত্যার সার্বিক চিত্র বা খুঁটিনাটি বিষয় কখনো জনগণের সামনে আসেনা, সীমান্ত হত্যার তুলনামূলক চিত্র সাধারণ মানুষ জানার আগেই একদল ভয়াবহ মিথ্যাচার এবং অপপ্রচারে লিপ্ত হয়ে যায়। খুব বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয় দু’দেশের সরকারকেই। পৃথিবীর সবকটি দেশেই সীমান্ত হত্যা আছে এবং এর পেছনে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের দায়ও আছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হত্যার কারণ ও তুলনামূলক চিত্র যেমন এই লেখায় তুলে ধরবো ঠিক তেমনি সীমান্ত হত্যা নিয়ে যে অপপ্রচার করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গাতে তার ব্যবচ্ছেদও করা হবে আজকের লেখায়। 

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঃ 
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেই ২,২১৭ কিমি. সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। সীমান্তের মানুষ বিভিন্ন কারণে এই এলাকা ব্যবহার করে। এই যেমন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যাওয়া, হাট-বাজারে বিকিকিনি করা, এবং কাজ খোঁজার জন্য অনেক মানুষ নিয়মিতভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিজমিতে কৃষিকাজ কিংবা নদীতটে মৎস্য আহরণের জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্তপথ অতিক্রম করতে হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন ছোটখাটো এবং গুরুতর আন্তঃসীমান্ত অপরাধে নিয়োজিত। সীমান্ত বাহিনী অবৈধ কার্যক্রম মোকাবেলার বাধ্যতামূলক করা হয়, বিশেষ করে মাদক চোরাচালান, যৌন কাজের জন্য মানব পাচার, এবং জাল মুদ্রা ও বিস্ফোরক পরিবহন। আর এই অপরাধ দমনের বিষয়টাতে এসেই বাধে সমস্যা, ঘটে সীমান্ত হত্যা। হত্যাকান্ডগুলো যখন সংগঠিত হয় তখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ কর্তৃক এই উপরোক্ত অভিযোগগুলো আনা হয় আবার বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষী বিজিবি কর্তৃক এই অভিযোগের পাল্টা বক্তব্য দেয়া হয়। তবে কি চোরাচালান বন্ধে হত্যাই সমাধান? নিশ্চয়ই উত্তর হবে ‘না’। এবং এই ‘না’ এর মধ্যে থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চালাতে হবে। 

সীমান্ত হত্যার কারণঃ 
সীমান্ত অনুপ্রবেশ বর্তমানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটা বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ নানা কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করে। এছাড়া চোরাচালান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চোরাকারবার ও সীমান্ত পারাপার রুখতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর অতিউৎসাহ ও অতিসক্রিয়তার ফলে সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আসলেই সবার সামনে প্রথমে চলে আসে গরু চোরাচালান। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পর উভয় দেশের পক্ষ থেকেই এই বিষয়টি সামনে আনা হয়। আরো বেশ কিছু কারণ সামনে আসে আর তা হলো, 

১. লাইন না করে অর্থাৎ কোন অর্থ কড়ি না দিয়েই কাটাতার কেটে গরু পাচার করলে ব্যাক্তিগত ভাবে ঐ স্থানে ডিউটিরত বিএসএফ সদস্যের শাস্তির ঝুঁকি থাকে। ফলে এভাবে গরু পাচারের ঘটনা টের পেলেই বিএসএফ গুলি করে বা ধরে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক প্রথা কিংবা খোদ ভারতীয় আইনে আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া গুলি না চলানোর বিধান যতই থাকুক, তারপরেও অনেকে অতিউৎসাহী হয়ে গুলি চালায়।

২. অনেক সময় ডিউটিরত ব্যক্তি অসাধু উপায়ে বখরা নেবার জন্য এই চোরাচালানে জড়িত থাকে এবং হুট করেই অন্য বিএসএফ বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চোরাচালানের স্থানে আসলে গুলি চালানো হয়। এই বখরা প্রথা শুধু ভারতে না বাংলাদেশের বিজিবির মধ্যেও দৃশ্যমান।

৩. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এখনও কাশ্মীর সীমান্ত থেকে রক্ষীদের এনে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা ভাষা বোঝে না। এছাড়া তাদের মধ্যে থাকে একটা যুদ্ধংদেহী মনোভাব। ফলে তারা গুলি চালায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর। এদের অধিকাংশই হয় সাধারণ মানুষ অথবা চোরাচালানকারী।
 
৪. তাছাড়া সীমান্ত হত্যার জন্য বিএসএফকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে এরকম ঘটনা বিরল, এটাও একটি বড় কারণ এই হত্যাকান্ডের পেছনে।
 
৫. গরু চোরাচালানকারীদের হত্যা করা হয়, কিন্তু মাদক চোরাচালানকারীরা নিরাপদেই ভারত থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচার করছে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আবার ভারত বিশ্বে গরুর মাংস রপ্তানিতে শীর্ষে। কিন্তু বাংলাদেশে গরু আসতে দেবে না। মজার ব্যাপার, এই গরুই যখন আবার হরিয়ানা বা মধ্য প্রদেশ থেকে আসে তখন তাদের বাধা দেয়া হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বাধা দেয় হয়। বিষয়গুলো নিয়ে কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে ভাবতে হবে। 

সীমান্ত হত্যা বন্ধে চুক্তিঃ 
২০০৮ সালে ভারত সরকার ও বিএসএফ বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল যে, সীমান্তে প্রাণঘাতী কোনও অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না। পরবর্তীতে ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তিও করে। ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বার বার।

সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেঃ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হত্যা হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে। তাদের শাসনামলে ২০০৬ সালে ১৪৬, ২০০৫ সালে ১০৪, ২০০৪ সালে ১৩৫, ২০০৩ সালে ৪৩, ২০০২ সালে ১০৫ ও ২০০১ সালে ৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরেই নিহত হয় ৬২৭ জন বাংলাদেশি।

এছাড়া সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই বছরে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মোট ১৮২ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে ৬২ জন এবং ২০০৭ সালে ১২০ জন নিহত হয়। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সীমান্তহত্যা ঘটে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। ২০১১ সালে সীমান্ত হত্যা বন্ধে চুক্তি করার পর এই হত্যাকান্ডের পরিমাণ কমে আসে। 

সীমান্ত হত্যার তুলনামূলক চিত্রঃ  
এক নজরে বিগত ২২ বছরের (১৯৯৬-২০১৮) সীমান্তহত্যার ছক। আমরা দেখি ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামীলীগ এর শাসনামলের পাঁচ বছরে সীমান্তে হত্যাকান্ডের সংখ্যা ১৪৬টি অপরদিকে ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সীমান্তে হত্যার সংখ্যা প্রায় ৫৩৩টি। আবার ২০০৯-২০১৪ পর্যন্ত হত্যাকান্ডের সংখ্যা ২৬৮টি। আবার ২০১৪ থেকে ২০১৮ নাগাদ হত্যাকান্ডের সংখ্যা ১৩৫টি। তুলনামূলক চিত্র থেকে দেখা যায় আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে অপেক্ষাকৃত কম হত্যাকান্ড হয়েছে এবং এই বছর মাত্র দুজন বিএসএফ দ্বারা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। যেখানে ২০০১ থেকে ২০০৬ অর্থাৎ পাঁচ বছরে হত্যার সংখ্যা প্রায় ৬০০ সেখানে বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলের দশ বছরে হত্যার সংখ্যা ৪০৩টি। আবার ২০১১ সালের চুক্তির পর হত্যাকান্ড অনেকটাই কমে এসেছে। ২০১৮ সালে এখন পর্যন্ত বিএসএফ এর গুলিতে একটি হত্যাকান্ডও সংগঠিত হয়নি যা দু’দেশের সরকারের এক অন্যতম প্রধান সফলতা। 

সীমান্তে হত্যাকান্ড কমে যাবার কারণঃ 

১.সীমান্ত-হত্যা বন্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত দুটো দেশের ইতিবাচক অবস্থানের কারণে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য রকমের উন্নতি ঘটেছে। এব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাবেরও বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটেছে। ভারত সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠে সাম্প্রতিক এক ঘটনার মাধ্যমে। মাস দুয়েক আগে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িতে ২০ বছরের এক তরুণ বিএসএফের ছররা গুলিতে আহত হয়েছিলেন। এর প্রতিবাদ জানিয়ে আইন ও শালিস কেন্দ্র বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে। তখন ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশন থেকে তাদেরকে বলা হয়েছে যে ভারত সরকার ওই তরুণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। 

২. বিএসএফের সৈন্যদের হাতে নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো খুবই সোচ্চার। বাংলাদেশ সরকার এসব সংগঠনের কথায় কান দিয়ে বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরেছে। 

৩. সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি এটার প্রতিফলন ঘটতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নীতিমালাতেও। তা নাহলে ভারত কিম্বা বাংলাদেশ - যে কোন দেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিস্থিতি আবারও আগের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। কেননা বিএনপির আমলে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা প্রকট আকার ধারণা করেছিল। কিন্তু এর পরে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দু'দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কাজ চলছে। 

৪. ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক কে. কে. শর্মা কয়েক মাস আগে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভারতীয় সৈন্যরা এখন আর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে না। যদিও তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার কারণে তাদের জওয়ানদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ছে। চোরাকারবারিরা জানে যে বিএসএফের সৈন্যরা গুলি করবে না, তাই চোরাকারবারীরা তাদের উপর আক্রমণ করছে। কিন্তু তারপরেও বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, এই অস্ত্র আর ব্যবহার করা হবে না এটা ভারত সরকারে সিদ্ধান্ত। 

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিশ্বের সবচাইতে রক্তাক্ত সীমান্ত; একটি অপপ্রচারঃ 

বাংলাদেশে থাকা অনেক শিক্ষাবীদ নামধারী ব্যক্তিবর্গের মুখে প্রায়ই এই বক্তব্য শুনা যায় যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তাক্ত সীমান্তের একটি। কিন্তু এই বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা। যারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা টিভি টকশোতে এই কথা বলে বেড়ান তাদের বলবো একটু গুগলে সার্চ দিয়ে সঠিক তথ্য জেনে নিন কেননা আজকের যুগে যেকোন মনগড়া বক্তব্য দিয়ে পার পাওয়া যায়না। বিশ্বের সবচাইতে বিপজ্জনক ও রক্তাক্ত সীমান্ত হিসেবে যে নামগুলো সামনে আসে তার একটি তালিকা নীচে দিলাম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তঃ 
পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তাক্ত সীমান্তের একটি। এফপি’ এর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত এই সীমান্তে প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর ২০১৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ২০০০-২০১৪ সাল পর্যন্ত বিগত ১৪ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে ৬,০০০ এর বেশি লোক সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছে, এতো অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। 

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তঃ 
এই সীমান্তের ৪০টি ‘স্পর্শকাতর’ অংশে ‘লেজার’-এর বেড়া দেয়া হবে বলে জানিয়েছে ভারত৷ পাকিস্তান থেকে ভারতে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর ফলে বেড়ার সংস্পর্শে কিছু আসলে উচ্চস্বরে সাইরেন বেজে উঠবে। ২০১১ সালের জুনে ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮০০ মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তে নিহত হয়েছে এক লক্ষ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। যেখানে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার সংখ্যা এখনো দুই হাজারের ঘরেও না তবে কিভাবে শিক্ষাবীদ নামধারী ব্যক্তিরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে বিশ্বের সবচাইতে রক্তাক্ত ও বিপদজনক সীমান্ত হিসেবে অভিহিত করেন। 

ভূমধ্যসাগরঃ
যুদ্ধ আর সংঘাত এড়াতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশ করছে৷ এদের একটি বড় অংশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করে৷ এতে প্রাণ যায় অনেকের৷ জার্মান ম্যাগাজিন ‘ডেয়ার স্পিগেল’ গত অক্টোবরে এক প্রতিবেদনে ভূমধ্যসাগরকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত বলে আখ্যা দেয়৷ ২০১৫ সালে ভূমধ্যসাগরে নিহতের সংখ্যা ছিল ৩,৭৭০।

আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তঃ 
প্রায় দেড় হাজার মাইল দীর্ঘ ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত সীমান্ত এখনও মেনে নেয়নি আফগানিস্তান৷ পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখা রাজ্যের পশতুন অধ্যুষিত এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে আফগানিস্তান৷ ‘নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশন’ এর তথ্যমতে বিগত ৫ বছরে এই সীমান্তে হত্যাকান্ডের সংখ্যা ৪ হাজারের উপরে

সৌদি আরব-ইয়েমেন সীমান্তঃ 
এই সীমান্তে গত কয়েকবছরে প্রায় ১০হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছে সৌদী সীমান্ত রক্ষী দ্বারা যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। 

উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তঃ  
বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সজ্জায় সজ্জিত সীমান্ত বলা হয় একে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় দেড়শ' মাইল দীর্ঘ এই সীমান্তের দুই পাশ থেকে সৈন্যদের সরিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকেই দুই দেশের সৈন্যরা প্রায় আড়াই মাইল প্রশস্ত এই সীমান্তের দুই পাশে অবস্থান করছে এবং হাজারো মানুষ হত্যার এক সীমান্ত হিসেবে একে অভিহিত করা হয়।
 
এছাড়াও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ভয়াবহতার আগে আরো কিছু দেশের সীমান্তের নাম এখানে এসে যায় এফপি এর রিপোর্টে। চায়না-নর্থ কোরিয়া, ইসরাইল-সিরিয়া, কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড, কঙ্গো-এঙ্গোলা, ভেনিজুয়েলা-কলম্বিয়া, চাদ-সুদান। তারপরেও একদল অপপ্রচার করেই যাচ্ছে এই সীমান্ত নিয়ে যার জবাব আমাদেরকে দিতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই না জেনে নয় বরং জেনে বুঝেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে তারা এই বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। 

সবশেষে বলবো, কোন হত্যাকান্ডই কাম্য নয় এবং এই সীমান্ত হত্যা বন্ধে দু’দেশকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য যে পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে এই সীমান্ত হত্যা অনেক কম তবে শূন্যের কোটায় এই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আসতে হবে। তেরঙ্গা-লাল সবুজ সম্পর্ককে আরো সুউচ্ছে স্থান দিতে হলে এই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতেই হবে। মনে রাখা দরকার, ‘গণভবন থেকে জনপথ রোড’ এর দূরত্ব বাড়াতে সবসময়ই একটি মহল কাজ করে যাচ্ছে, তাই সে সুযোগ চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। 

লেখকঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও  রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

বিডি-প্রতিদিন/ ই-জাহান

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর