বুধবার, ২০ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

আসছে তো ইংল্যান্ড

মেজবাহ্-উল-হক

আসছে তো ইংল্যান্ড

মিরপুর স্টেডিয়ামে নিরাপত্তা জোরদার

১৯৯২ সালের ৪ ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে (তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম) সার্ক ক্রিকেটে খেলতে নামে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান।  প্রথম ইনিংসের খেলা চলছিল। ভারতীয় দুই স্পিনার রাজেস চৌহান ও অজয় শর্মার ঘূর্ণিতে দিশেহারা পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। এমন সময় স্টেডিয়ামের পূর্ব গ্যালারি থেকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল দর্শক স্লোগান দিতে দিতে মাঠে নামে। খেলা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা সফল হয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক প্রয়াত গোলাম ফারুক অপু পাঁচ দর্শককে পুলিশে সোপর্দ করেন। তারপর ম্যাচে পাকিস্তানকে ৯ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে মাঠ ছাড়ে ভারত।

—বাংলাদেশে ক্রিকেটের ইতিহাসে এই একবারই ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণে খেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরপর এ পর্যন্ত কখনোই আর উগ্রবাদ ক্রিকেটের ওপর আঘাত হানেনি।

তবে গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার পর ক্রীড়াঙ্গনেও আতঙ্ক বেড়ে গেছে। আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের। কিন্তু গুলশান হামলার পর এখন বাংলাদেশের আসার ব্যাপারে দোটানায় রয়েছে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। যদিও এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু জানায়নি।

তবে জঙ্গি হামলার কয়েক দিন পর ইংল্যান্ডের টি-২০ অধিনায়ক ইয়ন মরগান কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে মিডিয়ায় জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিরিজটি নিরপেক্ষ কোনো ভেন্যুতে হলেই ভালো হয়! এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অনঢ়। হয়তো খেলা বাংলাদেশের মাটিতে হবে নয়তো নয়।

জঙ্গি হামলা এখন কোথায় হচ্ছে না। ফ্রান্সের মতো সুরক্ষিত দেশেও কয়েক মাসের ব্যবধানের কয়েকবার আক্রমণ করেছে জঙ্গিরা। সব শেষ ট্রাক হামলা চালিয়ে শতাধিক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ এই ফ্রান্সে কিছুদিন আগেই ইউরো কাপের আসর বসেছিল। তাই জঙ্গি হামলার বিষয়টি উদ্বেগ বাড়িয়ে দিলেও সে কারণে সফর স্থগিত করা যে মোটেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়, তা ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড খুব ভালো করেই বোঝে। তারপরেও কোনো বোর্ডই তো তাদের খেলোয়াড়দের বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে পারেন না।

সফরসূচি চূড়ান্ত হওয়ার পরও তো বাংলাদেশ পাকিস্তানে ক্রিকেট দলকে পাঠায়নি শুধুমাত্র নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করে। কিন্তু বাংলাদেশ তো আর পাকিস্তানের মতো জঙ্গি আস্তানা নয়! এখানে জঙ্গি হামলার পর সরকার তন্ন তন্ন করে জঙ্গিদের খুঁজে বের করছে। একের পর এক জঙ্গির আস্তানা খুঁজে বের করছে। বাংলাদেশ সরকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযান বিদেশে প্রশংসাও পাচ্ছে।

তারপরেও ইসিবি বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করার জন্য এক দল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দলটি সন্তুষ্ট হলে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজের ব্যাপারে আর কোনো অনিশ্চয়তা থাকার কথা নয়! তারপরেও ইংল্যান্ড দল বাংলাদেশে না আসা পর্যন্ত একটা শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। কেন না এর আগে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা মহিলা ক্রিকেট দলও বাংলাদেশে আসেনি।

নিরাপত্তার বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা চার বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখেছিল। এক. যে হোটেলে ক্রিকেটাররা থাকবেন সেই হোটেলটি কতটা নিরাপদ। দুই. স্টেডিয়ামে যাওয়া আসার রাস্তাটা কতটা নিরাপদ। তিন. স্টেডিয়ামের আশেপাশের এলাকা কতটা নিরাপদ। চার. দর্শকের আচরণ।

হোটেল সোনার গাঁও নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আপত্তি ছিল। স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে যাওয়া আসার রাস্তাটাও সরু মনে হয়েছিল তাদের কাছে। তা ছাড়া রাস্তার দুই পাশে উঁচু ভবন থাকায় আপত্তি ছিল। তাদের অভিযোগ, উঁচু ভবন থেকে যেকোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো সম্ভব। স্টেডিয়ামের আশেপাশের এলাকার পরিবেশ নিয়ে খুব আপত্তি ছিল না। যদিও দর্শকের আচরণ নিয়ে শঙ্কা ছিল।

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর ইংল্যান্ডের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও নিশ্চয়ই এই বিষয়গুলো মাথায় নেবেন। তবে এখন হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে যাওয়া-আসার জন্য ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের রাস্তা ব্যবহার করায় এই সমস্যা আর থাকছে না। দুই তিন নম্বর সমস্যাও থাকার কথা নয়। স্টেডিয়াম এলাকায় নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্টেডিয়ামের আশেপাশে অন্তত ৬০টি সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। ম্যাচের দিন প্রতিটি গেটে দর্শকদের কড়া তল্লাশির পর স্টেডিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। যদিও হোটেল সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। তবে এখন সোনার গাঁও এর পরিবর্তে ক্রিকেটারদের থাকার জন্য বিসিবির পছন্দ খিলক্ষেতের লা মেরিডিয়ান হোটেল। কিন্তু মেইন রাস্তা থেকে হোটেলটির দূরত্ব খুব কম থাকায় তা নিয়েও একটা নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তবে হোটেল নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কিছুটা সমস্যা থাকলেও নিরাপত্তার বাকি তিনটি বিষয়ে কিন্তু পাস মার্ক পাওয়ার কথা।

আসলে সব কিছুর পরও কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়, যদি ক্রিকেট-কূটনীতিটা শক্ত হয়! কেন না অস্ট্রেলিয়া দল নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে না আসলেও মুম্বাই ক্রিকেট বোর্ডে শিবসেনার ন্যক্কারজনক হামলার পরও তারা ভারত সফর করেছে। কারণ ভারতকে না করা অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল এখন বাংলাদেশে আসবে কি আসবে না তা অনেকটাই নির্ভর করছে বিসিবি কর্তাদের ক্রিকেট-কূটনৈতিকে বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার ওপর।

সর্বশেষ খবর