সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘আশা-ভরসার প্রতীক’ মুশফিক

আসিফ ইকবাল

‘আশা-ভরসার প্রতীক’ মুশফিক

মার্ক টেলরের কাছ থেকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নেতৃত্বভার যখন তুলে দেওয়া হয় স্টিভ ওয়াহ’র হাতে, তখন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটাররা সমালোচনায় মুখর। সবাই বলাবলি করছিলেন, অস্ট্রেলিয়া কক্ষপথ হারাবে। সময়ের চোরাস্রোতে সিনিয়র ওয়াহ’র হাত ধরে বিশ্বসেরা হলো অস্ট্রেলিয়া। গোটা ক্রিকেটবিশ্ব শাসন করল দোর্দণ্ড প্রতাপে। এক সময় স্টিভ ওয়াহও দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। দায়িত্ব পেলেন রিকি পন্টিং। তখন আবার ক্রিকেট বিশ্লেষকরা কাটাছেঁড়া শুরু করলেন, টেলর আর ওয়াহ’র অস্ট্রেলিয়া দলের পার্থক্য খুঁজে বের করতে। তখন অস্ট্রেলিয়ার আরেক লিজেন্ডারি ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেলের ব্যাখ্যা দিলেন, টেলর ও ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া একই মানের। শুধু দুজনের নেতৃত্ব গুণ আলাদা। টেলর ‘টিম ম্যান’ অধিনায়ক। গোটা দলকে এক করে চালাতে পছন্দ করেন। ওয়াহ দল পরিচালনা করতে পছন্দ করতেন সামনে থেকে। পারফরম্যান্স করে উজ্জীবিত করতেন গোটা দলকে। ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান কিংবা ক্রিকেট মেধায় টেলর, ওয়াহ’র কাতারে হয়তো নন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু কোথায় যেন স্টিভ ওয়াহর ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় টাইগার অধিনায়কের মধ্যে। ওয়াহর মতো চাপের মুখে ভেঙে না পড়ে পারফরম্যান্স করেই জবাব দিয়ে থাকেন মুশফিক। ঐতিহাসিক হায়দরাবাদ টেস্টে বাজে দল কিপিংয়ের জন্য সমালোচনার তরবারিতে এফোর-ওফোর হওয়া মুশফিক জবাব দিয়েছেন অদম্য এক সেঞ্চুরিতে। ১২৭ রানের ইনিংসটি এমন সময় খেলেছেন টাইগার অধিনায়ক, যখন তার কিপিং যাই-যাই করছে। নেতৃত্বও ঝুলে পড়েছে সুতোর ওপর।

ভারতের পর্বতসমান ৬৮৭ রানের চাপে গোটা দল যখন এলোমেলো। ভালো ব্যাটিং করেও সাকিব যখন কাণ্ডজ্ঞানহীন শট খেলে বিপদে ফেলেন দলকে, কিংবা স্বপ্ন দেখানোর পরও পরের দিনের শুরুতেই মেহেদী হাসান মিরাজ ফিরে যান সাজঘরে। তখন টেল এন্ডারদের নিয়ে অসম দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন মুশফিক। তিন বোলার তাইজুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ ও কামরুল ইসলাম রাব্বিকে নিয়ে স্কোর বোর্ডে যোগ করেন আরও ৬৬ রান। এর মধ্যেই তিনি তুলে নেন ৫২ টেস্ট ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরি। দেশের বাইরে চার নম্বর এবং ভারতের বিপক্ষে এবং তাদের মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরির ইনিংসটি খেলেন ২৬২ বলে ১৬ চার ও ২ ছক্কায়। টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ভারতের বিপক্ষে এর আগে চট্টগ্রামে ১০১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ২০১০ সালে। শুধুমাত্র তামিম ইকবাল ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস ও ম্যাঞ্চেস্টারে টানা সেঞ্চুরি করেছিলেন। ৪৭ টেস্টে তামিমের সেঞ্চুরি ৮টি।  অসাধারণ টেকনিকের জন্য দেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে অ্যাখ্যা পেয়েছেন আগেই। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের জন্য, নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠেছেন গোটা দলের। তাই সতীর্থরা আদর করে ‘মি. ওয়াল’ নামেও ডাকেন মুশফিককে। এই নামে ডাকা হতো ভারতের কিংবদন্তির ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়কেও। ‘মি. ওয়াল’ কিংবা ‘নির্ভরতার প্রতীক’ যাই হউন না কেন, মুশফিকুর রহিম দলের যে ‘আশা-ভরসা’, সেটা আরও একবার প্রমাণ করলেন।

১২৭ রানের ইনিংস খেলার পথে অবশ্য রেকর্ড বুকে নাম লিখেছেন মুশফিক। হাবিবুল বাশার, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের পর বাংলাদেশের চতুর্থ ক্রিকেটার হিসেবে তিন হাজারি ক্লাবে নাম লেখেন টাইগার অধিনায়ক। ৪৭ টেস্টে তামিমের রান ৩৪৭০। ৪৭ টেস্টে সাকিবের রান ৩৩১৬। অবশ্য সাকিব চতুর্থ দিন শেষে ব্যাটিং করছেন ২১ রানে। হাবিবুল বাশারের রান ৫০ টেস্টে ৩০২৬। মুশফিককে এখনো দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে হবে। তার আগে মুশফিকের পরিসংখ্যান; ৫২-৯৫-৭-৩০৪৯-২০০-৩৪.৬৪-৫-১৫। মুশফিক আবার বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান। ২০১৩ সালে গলে ২০০ রান করেছিলেন। এরপর তামিম ইকবাল ২০৬ এবং সাকিব ২১৭ রান করেন। 

মুশফিকের অভিষেক ২০০৫ সালে লর্ডসে। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি খেলতে নেমেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। তার আঁটোসাঁটো টেকনিকে মুগ্ধতা ঝড়েছিল ক্রিকেটবোদ্ধাদের। স্টিভেন হার্মিসন, ম্যাথু হোগার্ড, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ, সাইমন জোন্সদের গতি, বাউন্স ও সুইংয়ের বিপক্ষে খেলেছিলেন মাত্র ১৮ রানের ইনিংস। কিন্তু তাতেই মুশফিক স্পষ্ট করেছিলেন, তার ওপরই নির্ভর করতে পারবে বাংলাদেশ। গত এক যুগ ধরে যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তখনই মুশফিক ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন। জাত চিনিয়েছেন নিজের। রান করছেন। ‘ফ্রন্ট লাইন লিডার’ হিসেবে স্টিভ ওয়াহ’র মতো পারফরম্যান্স করে দলকে খেলাচ্ছেন। তারপরও সমালোচকরা সমালোচনা করেই চলেছেন। তার কিপিং ও নেতৃত্ব নিয়ে যাচ্ছেতাই বলছেন। হয়তো আসন্ন শ্রীলঙ্কা সিরিজে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই দেখা যাবে মুশফিকুর রহিমকে। তখন আরও বেশি ‘নির্ভরতার প্রতীক’ হয়ে উঠবেন মুশফিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর