শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশও লড়াই করতে জানে

মেজবাহ্-উল-হক

বাংলাদেশও লড়াই করতে জানে

‘এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান!’ -ধ্রুব সত্য এই কথাগুলো অনেক আগেই সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’-তে লিখেছেন! কিন্তু ক্রিকেটবিশ্ব টেস্টে বাংলাদেশকে ‘শিশু’ ভাবলেও স্থান দিতে চায় না। কিন্তু শিশু তো আর সারা জীবন ‘শিশু’ থাকে না! তাহলে বাংলাদেশ কেন টেস্টে ‘শিশু’ হয়েই থাকবে!

চট্টগ্রামের এই টেস্টে টাইগাররা বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ যৌবনে পদার্পণ করতে যাচ্ছে! এটা কেবল তারই একটা পূর্বাভাস মাত্র!

এই টেস্টে কত প্রতিকূলতা নিয়ে খেলতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দলে প্রধান কোচ নেই। তারপর ত্রি-দেশীয় সিরিজের ফাইনালে হার ছিল আরেকটা ধাক্কা। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা ছিল সাকিব আল হাসানের ইনজুরি।

এমন টালমাটাল অবস্থায় থাকা দলটি কী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে লড়াই করতে পারবে! রোমাঞ্চকর এই ড্র-র পর একথা নিঃসংকোচে বলা যায় বাংলাদেশ পেরেছে। খুব ভালো করেই পেরেছে।

হয়তো বোলিংয়ে ততটা দৃঢ়তা দেখানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু ব্যাটসম্যানরা যে স্বপ্নিল ব্যাটিং করেছেন— তার কী কোনো তুলনা হয়। প্রথম ইনিংসে মুমিনুল হকের ১৭৬ রান। মুশফিকের ৯২। হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন তামিম ইকবাল। আর ক্যাপ্টেন মাহমুদুল্লাহর সেই ৮৩ রানের হার না মানা ইনিংসের তো জবাব নেই।

সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের লড়াকু মানসিকতা। শেষ পর্যন্ত তারা লড়াই করেছেন। মাহমুদুল্লাহ যখন ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন তখন স্বীকৃত কোনো ব্যাটসম্যানই ছিল না। তিনি লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে বড় স্কোর এনে দেন।

আর দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ যা দেখালো— এর চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। মুমিনুল হকের ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। সঙ্গে লিটন কুমার দাসের লড়াকু ৯৪(!) তাদের দুজনের ১৮০ রানের জুটিই বাংলাদেশকে তীরে পৌঁছে দিল। এই দ্বিতীয় ইনিংসটি টেস্টে টাইগারদের সামর্থ্যের দলিল হয়ে থাকবে।

এর আগে পঞ্চম দিনে এমন দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাটিং করার নজির আমাদের হাতে নেই বললেই চলে। পঞ্চম দিনে ভালো কিছু করতে হলে ধৈর্য্যের সঙ্গে ফিটনেসের প্রয়োজন। এই জায়গায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা উন্নতি করেছে বলেই না আমরা ওয়ানডের মতো এখন টেস্টেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছি।

বাংলাদেশ ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেলেও সত্যিকার অর্থে উন্নতির গ্রাফটা উপরের দিকে উঠতে থাকে বছর দুয়েক আগে থেকে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দারুণ জয় দিয়ে। ওই সিরিজে যে ম্যাচে বাংলাদেশে হেরেছিল সেটাতেও ভয়ঙ্কর লড়াই হয়েছিল। জয়ের পরিস্থিতিতে ছিল টাইগাররা। কিন্তু শেষ দিনে ২২ রানে হেরে যায়।

তারপরের সিরিজে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে প্রথম ম্যাচে কী দাপটই না দেখালো বাংলাদেশ। বাতাসের শহর ওয়েলিংটনে উপমহাদেশের দলগুলো যেখানে পাত্তাই পায় না সেখানে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ৫৯৫ রান করে ইনিংস ঘোষণা করার ক্ষমতা দেখিয়েছে। সাকিবের ডাবল সেঞ্চুরি, মুশফিকের সেঞ্চুরি। দুই তারকার ৩৫৯ রানের পার্টনারশিপটা ছিল দেখার মতো।

গত বছরের মার্চে শ্রীলঙ্কা সফরের কথা কি কেউ ভুলতে পারবেন! নিশ্চয়ই না। শততম টেস্টে ঐতিহাসিক জয়ের কথা কী আর ভোলা যায়। শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা কেন, ওই ঘটনা ক্রিকেটবিশ্বই ভুলতে পারবে না। কী দাপটের সঙ্গেই না জিতেছে বাংলাদেশ।

তারপর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে তো রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেন টাইগাররা। টেস্ট ক্রিকেটের শিরোমণি অস্ট্রেলিয়াকে হারানো কী আর সোজা কথা। বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের মানটাই যেন অন্য পর্যায়ে উঠে যায়।

তারপর হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের প্রসঙ্গ আসবে? কিন্তু পাঠক ভেবে দেখুন, ওই সফরেই চন্ডিকা হাতুরাসিংহে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি আর বাংলাদেশের কোচ থাকছেন না। পুরো দলেই কেমন যেন একটা অগোছালো পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। তার ওপর ছিলেন সাকিব আল হাসান। সব মিলেই বাজে অবস্থা হয়েছিল।

তা ছাড়া নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশ যে রানের পাহাড় গড়েও হেরে গিয়েছিল তার পেছনে বড় কারণ ছিল ‘ফিটনেস’! টানা পাঁচদিন সমানতালে খেলা চালিয়ে যাওয়া কিন্তু অনেক কঠিন। ঠিক ওই ম্যাচের পরই যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মনোজগতে একটা দারুণ পরিবর্তন এসে যায়। শুধু স্কিল থাকলেই হবে না টানা পাঁচ দিন খেলতে হলে ফিটনেসের দিকে নজর দেওয়াও জরুরি। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এই সিরিজের আগে সেজন্যই ফিটনেস ক্যাম্প করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। আর তার পুরস্কারটাও পেল হাতে-নাতে। শেষ দিনে দুর্বার ব্যাটিং করে অসাধারণ এক ড্র করে। জয়ের সমান এক ড্র করতে পারায় এই ম্যাচ থেকে ক্রিকেটাররা যেমন বাড়তি আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন, তেমনি ক্রিকেট বিশ্বকে একটা বারতাও দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন আমাদেরকে অবহেলা করার দিন শেষ। ওয়ানডের মতো টেস্টেও লড়াই করতে শিখে গেছি।

 

সর্বশেষ খবর