শুক্রবার, ২০ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা

এত মিল তবু কত অমিল

ক্রোয়েশিয়ার সুকার, বাংলাদেশের সালাউদ্দিন

ক্রীড়া প্রতিবেদক

এত মিল তবু কত অমিল

ক্রোয়েশিয়ার ডেভর সুকার। বাংলাদেশের কাজী সালাউদ্দিন। দুজনার মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে। দুজনার নামের শুরু এস দিয়ে। দুজনা দুই দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার ছিলেন। এখন আবার দুজনই দুই দেশের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও দুজনার তুলনা চলে না। এত মিল কিন্তু পার্থক্য আকাশ-পাতাল। সুকার ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলে ক্রোয়েশিয়াকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান। অভিষেক আসরে নিজে গোল্ডেন বুট জিতে আলোড়ন তোলেন। বিশ্বকাপের কথা বাদই দিলাম। কেননা ফুটবলে বাংলাদেশের মান কখনো সে পর্যায়ে ছিল না। তবে আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল। সালাউদ্দিনের আজকের যে দেশব্যাপী পরিচয় তা হয়েছে ফুটবল খেলেই। ক্রীড়াঙ্গনে দেশের প্রথম সুপারস্টার তিনিই। বাংলাদেশের হয়ে দেশের বাইরে প্রথম পেশাদারি লিগ খেলার কৃতিত্ব তারই।

অন্য দিকে সুকারের ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনায়ই প্রয়োজন পড়ে না। যিনি বিশ্বকাপ খেলেছেন ও গোল্ডেন বুট জিতেছেন তিনি তো শুধু দেশ নয় বিশ্বের আলোচিত ফুটবলার ছিলেন। সালাউদ্দিনের নাম দেশ ছাড়িয়ে এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়েছিল তা না হলে হংকংয়ের মতো দেশে পেশাদার লিগ খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন কিভাবে?

এবার বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার দুর্দান্ত দাপট দেখে এদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, যে দেশ ১৯৯১ সালে স্বাধীন হয়েছে তারা যদি রানার্স হতে পারে তা হলে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলাটা স্বপ্নেও ভাবা যাবে না কেন? এ নিয়ে অনেক যুক্তি-তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন জাগাটা তো অস্বাভাবিকের কিছু নয়। এটা ঠিক স্বাধীনতার আগে ক্রোয়েশিয়া ছিল যুগোশ্লাভাকিয়ারই অংশ। যুগোশ্লাভাকিয়া ফুটবলে দুর্দান্ত দল ছিল। সেক্ষেত্রে স্বাধীন হলেও সেই রক্ত ক্রোয়াটদের ভিতর থেকে গেছে। তাই তাদের বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের মেলে ধরতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি।

না এই যুক্তিও আবার পুরোপুরি ঠিক নয়। স্বাধীনতার পর ক্রোয়েশিয়া যখন ফিফার সদস্যভুক্ত হয় তখন একটা র‌্যাঙ্কিং ধরে দিয়েছিল। বিশ্ব ফুটবলে তখন তাদের ছিল অসহায় অবস্থা। প্রথম প্রীতিম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ঘাম ঝরানো জয় পেলেও পরের ম্যাচে ৯-০ গোলে হেরেছিল হাঙ্গেরির কাছে। এই পরাজয়ই ক্রোয়াটদের ভিতর জেদ ধরিয়ে দেয়। সুষুম পরিকল্পনা ও পরিশ্রমে ১৯৯৮ সালেই তারা বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়। অভিষেকেই বাজিমাত। ফেবারিটদের পেছনে ফেলে সেমিতে উঠে জানিয়ে দেয় ফুটবলে নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে।

ডেভর সুকার সভাপতি হওয়ার পর একটা ভিশন তৈরি করে এগুতে থাকে। কঠিন পরিশ্রমে সব ভয়কে জয় করা যায় তা ক্রোয়াটরা দেখিয়ে দিয়েছে। যা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি তা ভুল প্রমাণিত করে মডরিচ, রাকিটিচ, মান্দজুকিচ, পেরিশিচরা বিশ্ব জয় প্রায় করেই ফেলেছিল। দুর্ভাগ্য বলতে হয় ভালো খেলেও তাদের হাতে উঠে রানার্স আপের ট্রফি। সুতরাং ক্রোয়াটদের দাপট দেখে দেশের ফুটবলপ্রেমীদের আফসোস হতেই পারে ওরা পারলে আমরা কেন পারব না?

সালাউদ্দিন যখন ফুটবল ছাড়েন তখন কিশোর সুকার মাত্র ফুটবলে লাথি মারা শুরু করেন। সেই সুকারের হাতে কি এমন জাদু ছিল যে মাত্র ছয় বছরে সভাপতির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিশ্ব ফুটবলে এত বড় বিপ্লব ঘটালেন? কেউ কেউ বলেন, সালাউদ্দিন সভাপতি হওয়ার পর দেশের ফুটবল ধ্বংস হয়ে গেছে। না এই কথাও ঠিক নয়। আগে যারা সভাপতি ছিলেন তারা এমন কিছু করে যাননি যে যা নিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা গর্ব করতে পারেন।

সালাউদ্দিনের মতো কিংবদন্তি অভিভাবকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ফুটবলপ্রেমীরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সালাউদ্দিন একটাই কথা বলছিলেন হুট করে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। আমাকে সময় দিতে হবে। সত্য কথাটাই বলেছিলেন তিনি। দেখতে দেখতে টানা ১০ বছর ধরেই তিনি সভাপতির চেয়ারে বসে আছেন। শুধু তিনি একা নন, আছেন সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, শেখ মো. আসলামদের মতো কিংবদন্তি ফুটবলাররা। আগের কমিটি না পারলেও আশা ছিল সালাউদ্দিনের নেতৃত্বেই ফুটবল জেগে উঠবে। ১০ বছরে তার ছিটেফোঁটাও দেখা মিলেছে কি? মানলাম নারী ফুটবলে দেশ বেশ এগিয়েছে। কিন্তু যাদের ঘিরে আশা সেই পুরুষ ফুটবলাররা হতাশা ছাড়া দেশকে কিছু দিতে পারছে কি?

বিশ্ব বা এশিয়ান মানের কথা বাদ দিলাম। সামান্য সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা নয় সেমিফাইনাল খেলাটাই স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। ফুটবলারদের এত তীব্র সংকট যে জাতীয় দল গড়তেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অথচ সালাউদ্দিনের মতো ফুটবল জ্ঞানীই ঘোষণা দিয়েছিলেন ভিশন টোয়েন্টি-টুয়ের। কতটা হাস্যকর যে বাংলাদেশ মালদ্বীপের কাছে গুনে গুনে গোল হজম করছে, ভুটানের কাছেও হারছে সেখানে কিনা তিনি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখালেন। সুকার বা ক্রোয়েশিয়ার কথা বাদই দিলাম। প্রতিবেশী ভারত তো বিশ্ব বা এশিয়া ফুটবলে শক্তিশালী দেশ নয়। তারা যে পরিকল্পনা নিয়েছে সালাউদ্দিন সেই পথেও তো এগুতে পারেন। প্রশ্ন উঠবে অর্থের। সাফে সেমিফাইনাল উঠতে তো আর কোটি টাকার প্রয়োজন পড়ে না। ফিফা, এএফসির অনুদানও আসছে তাহলে এই টাকা ব্যয় হয় কীভাবে? তাছাড়া স্পন্সর আসবে সেই ধরনের চমক কি দেখানো সম্ভব হয়েছে গত ১০ বছরে? সুকার সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপে রানার্স-আপ হয়েছে। অন্যদিকে ১০ বছর ধরে সালাউদ্দিন সভাপতি থাকলেও  ফুটবলের মান নামতে নামতে লাইফ সাপোর্টে এসে ঠেকেছে। এখান থেকে ফুটবল উদ্ধার হবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর