মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুস্তাফিজ এক জাদুকর

মুস্তাফিজ এক জাদুকর

শেষ বলে ছক্কায় ম্যাচের দফা-রফা হয়েছে, উদাহরণ খুঁজতে খুব বেশি দিন পেছনে যেতে হবে না। মার্চে কলম্বোয় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশের স্বপ্ন ভঙ্গ করেছিলেন ভারতের দিনেশ কার্তিক। তার আগের ম্যাচেই আবার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ শেষ বলে ছক্কা মেরে কান্নার নোনা জলে সিক্ত করেছিলেন স্বাগতিক শ্রীলঙ্কাকে। শেষ বলের নাটকীয়তায় ম্যাচ হারজিতের এমন উদাহরণ রয়েছে হাজারও। কিন্তু পাহাড়সম চাপের মুখে শেষ বলে মুস্তাফিজ যে কীর্তি গড়েছেন, তা শুধু কল্পনায় সম্ভব। কল্পনার রঙ তুলি দিয়ে অদৃশ্য ক্যানভাসেই আঁকা সম্ভব! আবুধাবির প্রচণ্ড গরমকে তুড়ি মেরে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে শেষ ওভারে যে বোলিং তিনি করলেন, তার তুলনায় আসতে পারে জুয়েল আইচ, পিসি সরকার কিংবা হুডিনির জাদু। জুয়েল আইচ জাদু দেখিয়ে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন দর্শকদের রবিবার রাতে আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামে শেষ ওভারে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান শিবিরকে সেভাবেই বাকরুদ্ধ করে রেখেছিলেন মুস্তাফিজ। হৃদস্পন্দন বন্ধ করা ওই ওভারে মুস্তাফিজের বাঁ হাতের জাদুতে অবিশ্বাস্য ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। জয়ের ব্যবধান ৩ রান। সাদাচোখে আহামরি নয়, কিন্তু মাঠে উপস্থিত হাজারও দর্শক দুই দলের ক্রিকেটাররা জানেন কতটা চাপ নিয়ে মুহূর্তটি জয় করেছেন সবার প্রিয় মুস্তাফিজ।

২৮ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ের ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ হতে জিততেই হতো টাইগার শিবিরকে। গ্রুপ পর্বে রশীদ ও মুজিবের দুর্ভেদ্য স্পিনে নাকাল হয়ে বাংলাদেশ গুটিয়ে গিয়েছিল ১১৯ রানে। ওই ধাক্কা সামলে উঠতে হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে উড়িয়ে আনে দুই বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান ইমরুল কায়েস ও সৌম্য সরকারকে। ইমরুল খেলতে নেমেই বাজিমাত করেন। সাজঘরে বসেছিলেন সৌম্য। আফগানদের বিপক্ষে আগের ম্যাচ না খেললেও পরশু খেলেন মুস্তাফিজ। এরপর সব কিছুই স্বপ্ন।

আফগানদের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বিশ্রামে ছিলেন মুস্তাফিজ ও মুশফিক। পরশু দুজনেই ফিরেন এবং ৩ রানের রোমাঞ্চকর জয়ে অবদানও রাখেন। রান আউট হওয়ার আগে মুশফিকের ব্যাট থেকে বেরোয় ৩৩ রান। মুস্তাফিজ তিন স্পেলে ১০ ওভার বোলিং করেন পানিশূন্যতা নিয়ে। আবুধাবির গরমে কাহিল হয়ে ৫ ওভার পরেই মাঠের বাইরে চলে আসতে চেয়েছিলেন কাটার মাস্টার। কিন্তু টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি তার সেরা অস্ত্রটাকে মাথায় হাত বুলিয়ে মাঠে রেখে দুই স্পেলে বাকি পাঁচ ওভার করান। শেষ ওভারটি ছিল নাটকীয়তায় ভরা। ১৯৯৩ সালে মোহালিতে হিরো কাপের সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ওভারে এমনই নার্ভজয়ী বোলিং করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি শচিন টেন্ডুলকার। শেষ ওভারে প্রোটিয়াসদের জিততে দরকার ছিল ৬ রান। ব্রায়ান ম্যাকমিলান, ফানি ডি ভিলিয়ার্স ও অ্যালান ডোনাল্ডরা নিতে পেরেছিলেন মাত্র ২ রান। ভারত ম্যাচ জিতেছিল ৩ রানে। ২৫ বছর পর আবুধাবিতে তার চেয়েও উত্তেজনাকর ওভার করেন মুস্তাফিজ। শেষ ওভারে আফগানিস্তানের দরকার ৮ রান। ক্রিজে দুই মেজাজি ব্যাটসম্যান রশীদ খান ও সামিউল্লাহ শেনওয়ারী। মুস্তাফিজের প্রথম বলে দুই রান নেন রশীদ। দ্বিতীয় বলে কাটারে বোকা বনে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে সাঝঘরে হাঁটা দেন রশীদ। সমীকরণ দাঁড়ায় ৪ বলে ৬ রান। শেনওয়ারী তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে প্রান্ত বদল করেন। তিন বলে ৫ রান। দুই বলে এক রান নেন গুলবদন নাইম। শেষ বলে সমীকরণ দাঁড়ায় ৪ রান। টানটান উত্তেজনায় শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল সে াত তখন নেমে যাচ্ছে দুই দলের শিবিরে। বিশেষ করে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ১১ টাইগার ক্রিকেটারের। এরপরই শেষ বলে মুস্তা জাদু। যা হার মানিয়েছে জুয়েল আইচ, পিসি সরকার, হুডিনিদের বিশ্ব মাতানো সব জাদুকে। মুস্তাফিজের শেষ বলটি ছিল ইনসুইঙ্গার। ব্যাটেই বল লাগাতে পারেননি শেনওয়ারী। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ ম্যাচ জিতে নেয় ৩ রানে। আশা টিকিয়ে রাখে ফাইনালের।                               

২০১৫ সালে ধূমকেতুর গতিতে আগমন মুস্তাফিজের। ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিন বছরে খেলেছেন মাত্র ৩৩ ওয়ানডে। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলগুলোর বিপক্ষে ম্যাচ জিতিয়েছেন দুরন্ত বোলিংয়ে। কিন্তু আফগানিস্তানের ম্যাচটি নিশ্চিত করেই তার ক্যারিয়ার সেরা। ৭৪ রান, এক উইকেট এবং  দুই ক্যাচ নিয়ে ম্যাচ সেরা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। অথচ ম্যাচসেরা মাহমুদুল্লাহ অবিশ্বাস্য ম্যাচ জয়ের সব কৃতিত্ব দিলেন মুস্তাফিজকে, ‘মুস্তাফিজ বল হাতে নিতেই আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। আমি ম্যাচ জেতানোর সব কৃতিত্ব দিব মুস্তাফিজকে।’ ধারাভাষ্য দিতে আসা অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটসম্যান ডিন জোন্সও কৃতিত্ব দিলেন মুস্তাফিজকে, ‘ওই পরিস্থিতিতে নার্ভ ঠিক রেখে বল করা কঠিন। মুস্তাফিজ সেই কাজটিই করেছেন। মাথা ঠাণ্ডা রেখে অসাধারণ বোলিং করেছেন তিনি।’

ফাইনালে খেলতে হলে আগামীকাল হারাতেই হবে পাকিস্তানকে। ওই ম্যাচেও জ্বলে উঠতে হবে ‘বিস্ময় বোলার’ মুস্তাফিজকে। 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর