বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের ‘অন্য’ মিশন

মেজবাহ্-উল-হক, চট্টগ্রাম থেকে

বাংলাদেশের ‘অন্য’ মিশন

দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচের আগে চট্টগ্রামে হালকা অনুশীলন সেরে নিচ্ছেন বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। ঢাকায় প্রথম ম্যাচ জিতে সিরিজে এগিয়ে আছে টাইগাররা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কোথায় বাংলাদেশ! আর কোথায় জিম্বাবুয়ে! টাইগাররা ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করে সেরা আটে (পড়ুন সাতে) থেকে, আর জিম্বাবুইয়ানরা ঘরের মাঠে বাছাই পর্ব খেলেও ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসরে খেলার টিকিট পায়নি। দুদলের সাম্প্রতিক অবস্থান বোঝার জন্য এই তথ্যই যথেষ্ট!

অথচ একটা সময় বাংলাদেশকে বলে-কয়ে হারিয়ে দিত এই জিম্বাবুয়ে। সেটা ছিল ফ্লাওয়ার ভ্রাতৃদ্বয়ের যুগ। এটা খুব  বেশিদিন আগের ঘটনাও নয়। দেড় যুগ আগেই ক্রিকেট মাঠে দেখা যেত এমন চিত্র। কিন্তু এখন বাতাস উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে।

ক্রিকেট কৌশলের খেলা, বুদ্ধিমত্তার খেলা। তার চেয়েও  বেশি বোধ হয় আত্মবিশ্বাসের খেলা। আর এই আত্মবিশ্বাস তখনই আসে যখন সাফল্যের গ্রাফটা পর্যায়ক্রমে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ধারাবাহিক ভালো খেলার কারণেই মাশরাফিরা এখন আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর। সিরিজের প্রথম ম্যাচে দলের সেরা দুই তারকা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল না থাকার পরও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে জিততে সমস্যা হয়নি। সব ঠিকঠাক থাকলে আজই চট্টগ্রামে সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলবেন টাইগাররা।

বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট গ্রাফ দুভাবে কাজ করছে। মাসাকাদজাদের ক্রিকেটে এখন পড়ন্ত বিকাল। শাষক শ্রেণির সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে জিম্বাবুয়ের সোনালি প্রজন্মের ক্রিকেটাররা সময়ের অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন। এমন দৃশ্য দেখে আফ্রিকার ক্রিকেট পাগল  দেশটির তরুণ প্রজন্মও হয়তো ক্রিকেট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। সে কারণেই আজ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এমন রুগ্ন দশা।

গত দেড় যুগে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট যে গতিতে পিছিয়েছে তার  চেয়েও বেশি গতিতে যে বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়ে গেছে তা বলাই যায়! মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হাবিবুল বাশারদের দেখানো পথ অনুসরণ করে এই প্রজন্মের মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা মিলে এদেশের ক্রিকেট অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

‘পুষ্টি’র অভাবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট যেখানে দিনে দিনে তাদের ‘এন্টিবডি’ নষ্ট করে এখন চরম রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে,  সেখানে ‘সুষম’ খাদ্যে ভরপুর বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন ক্রমশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হচ্ছে!

আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একটা সময় বাবা-মায়ের ভয়ে সন্তানরা ক্রিকেট মাঠে যেত লুকিয়ে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে! এখন অভিভাবকরাই পরমানন্দে হাত ধরে সন্তানকে ক্রিকেট মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সংগঠকদের মধ্যেও পেশাদারিত্ব বেড়ে গেছে। সবকিছু মিলেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের অবস্থানে।

এদেশের ক্রিকেটে এখন আছে পঞ্চপাণ্ডব! পরাক্রমশালী পাঁচ ক্রিকেটার মাশরাফি, সাকিব, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিম। পাঁচ ক্রিকেটারই নিজেদের আলাদা করে চিনিয়েছেন, দিনের পর দিন পারফর্ম করেই তারা ক্রিকেট বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন। বিশ্বের খুব কম  দেশেই দেখা যায় এক সঙ্গে সমসাময়িক সময়ের এতগুলো তারকা ক্রিকেটার দলে খেলছেন। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সুখবর বোধহয় এটাই।

স্বাভাবিক কারণে সাম্প্রতিক সাফল্যের পেছনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে এই পঞ্চপাণ্ডব। প্রতিটি ম্যাচেই এই পঞ্চপাণ্ডবের কেউ না কেউ পারফর্ম করেই চলেছেন। তবে পঞ্চপাণ্ডবের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে একটা আতঙ্কও তৈরি হয়েছিল- তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে, পঞ্চপাণ্ডবের বাইরের অন্য ক্রিকেটারদের নিয়ে। তারা নিয়মিত পারফর্ম করতে পারছিলেন না। কিন্তু জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। পঞ্চপাণ্ডবের দুই সেরা তারকা সাকিব ও তামিম ইনজুরির কারণে ছিলেন না। দলে থাকা বাকি তিন তারকা মাশরাফি, মাহমুদুল্লাহ ও মুশফিকও ভালো করতে পারেননি। মাহমুদুল্লাহ রানের খাতাই খুলতে পারেননি, মুশফিকও আউট হয়েছিলেন মাত্র ১৫ রান করে, মাশরাফি ১০ ওভার বোলিং করে দিয়েছিলেন ৫৫ রান, কোনো উইকেটও শিকার করতে পারেননি। তারপরও জিম্বাবুয়েকে হারাতে এতটুকুও কষ্ট হয়নি।

তরুণ ক্রিকেটাররা, পঞ্চপাণ্ডবের বাইরে থাকা খেলোয়াড়রাই বাংলাদেশকে সিরিজে এগিয়ে দিয়েছেন। ইমরুলের মহাকাব্যিক ১৪৪, সাইফুদ্দিনের ৫০, মিথুনের ৩৭, আর  বোলিংয়ে মেহেদীর ৩ উইকেট এবং অপুর ২ উইকেট শিকারই টাইগারদের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছে।

প্রথম ম্যাচ ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা  স্টেডিয়ামে হয়েছিল। দ্বিতীয় ম্যাচটি টাইগারদের পয়মন্ত  ভেন্যু বন্দরনগরী চট্টগ্রামের এই জহুর আহমেদ চৌধুরী  স্টেডিয়ামে। সাগরিকায় এর আগে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে হারেনি বাংলাদেশ। ৫টি ওয়ানডে ৫ জয়। সেই মহা পয়মন্ত  ভেন্যুতেই আজ সিরিজ নিশ্চিত করতে নামছে মাশরাফিরা।

সফরকারীদের কোনো রকম সুযোগ দিতে চান না টাইগার দলপতি, ‘আমরা এশিয়া কাপে যে মানসিকতা নিয়ে খেলেছি,  সেই মানসিকতা নিয়েই খেলছি। এখানে আমরা হংকংয়ের সঙ্গে হেরেছি (টি-২০, ২০১৪ সালে)। তাই আমরা কোনো সুযোগ দিতে চাই না।’

জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র সিরিজ জয়ই একমাত্র লক্ষ্য নয় টাইগারদের। বাংলাদেশের অন্য মিশনও যে আছে তা পরিষ্কার হয়ে গেল মাশরাফির কথাতেই, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। তবে আমাদের আরেকটু ক্লিনিক্যাল হতে হবে। ম্যাচ হারা যাবে না, আবার একজন দুজনকে সুযোগও দিতে হবে। তরুণরা যেন এসেই খুব দ্রুত পারফর্ম করতে পারে তারা যেন তিন-চার ম্যাচ না নেয় পারফর্ম করতে সেই মানসিক প্রস্তুতি এবং শারীরিক প্রস্তুতিও এনসিউর করার  চেষ্টা করছি।’

মাশরাফি যে বিশ্বকাপ মিশনের কথা মাথায় রেখেই একটু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, সেরা কম্বিনেশন তৈরি করার  চেষ্টা করছে, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর