লুকা মডরিচকে দেখে তার ভিতরের আগুনটা বুঝা বড় দায়। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার মৃদুভাষী এই ক্রোয়েশিয়ানকে প্রথম নজরে সাদা-সিধে আম আদমি বলেই মনে করে সবাই। কিন্তু ভিতরটা খতিয়ে দেখলেই বুঝা যায় কী পরিমাণ আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে এই আম আদমির দগ্ধ হৃদয়ে।
নানা কারণে লুকা মডরিচের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ক্রোয়েশিয়ার গণযুদ্ধের সময় বিদ্রোহীদের হাতে দাদাকে নিহত হতে দেখেছেন ছেলেবেলায়। চোখের সামনেই বিদ্রোহীরা সাজানো-গোছানো বাড়িটাকে পুড়িয়ে মিশিয়ে দিয়েছিল মাটির সঙ্গে। এরপর থেকে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন। সে সময় হাজারও বোমা পড়তে দেখেছেন প্রিয়জনদের উপরে। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে তাদের দেহ। সেই সময় কঠিন সংগ্রামের শুরু। ক্রোয়েশিয়ান উপশহর জাডারের এক হোটেলে উদ্বাস্তু জীবন কাটানোর সময়ই ফুটবল নিয়ে লড়াইটা শুরু করেন তিনি। সেই ছেলেবেলাতেই নাকি ইতালিয়ান ফুটবলার ফ্রান্সেসকো টট্টির কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছিলেন মডরিচ।
এরপর জীবনের প্রতিটা লড়াইয়ে বিজয়ী হয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন আজকের লুকা মডরিচ।দীর্ঘ এই ভূমিকাটার প্রয়োজন ছিল। যিনি ১০ বছরের একটা বাস্তবতাকে পিছনে ফেলতে পারেন, মেসি-রোনালদো যুগে বাস করেও শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছিনিয়ে নিতে পারেন, তাকে নিয়ে দীর্ঘ ভূমিকা লেখাটা নিশ্চয়ই যুক্তিযুক্ত। গত পরশু গভীর রাতে প্যারিসে এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্যালন ডি’অর ট্রফিটা অন্তত বিনয়ের সঙ্গে লুকা মডরিচের হাতে তুলে দিয়েছে ‘ফ্রান্স ফুটবল’ কর্তৃপক্ষ। মেসি-রোনালদোরা অনেকটা পেছনে পড়ে রইলেন। রোনালদো হলেন দ্বিতীয়। মেসি পঞ্চমে! তিন আর চারে দুই বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি তারকা আঁতোয়ান গ্রিজমান ও কিলিয়ান এমবাপ্পে। কানা-ঘুষা ছিল। কিন্তু তারপরও মেসি-রোনালদোর আধিপত্য এতটা সহজেই শেষ হবে, বলে অনেকেই ভাবতে পারেননি। এজন্যই গুজবে কান না দিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন চূড়ান্ত ফলের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গুজবটাই সত্যি প্রমাণ হলো। ৭৫৩ ভোট পেয়ে সেরা নির্বাচিত হয়েছেন গত মৌসুমে রিয়ালের জার্সিতে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা লুকা মডরিচ। এছাড়াও তিনি গত মৌসুমে ক্লাব বিশ্বকাপ, উয়েফা সুপার কাপ এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জিতেছেন। ৪৭৮ ভোট পেয়ে রোনালদো দুই, ৪১৪ ভোট পেয়ে গ্রিজমান তিন, ৩৪৭ ভোট পেয়ে এমবাপ্পে চার এবং ২৮০ ভোট পেয়ে মেসি পাঁচ নম্বরে আছেন।
ফিফা এবং উয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার জয়ের পর ব্যালন ডি’অর ট্রফি জেতা লুকা মডরিচ বলছেন, ‘সেরা সময় কখনোই সহজে ধরা দেয় না। আমি এটা বিশ্বাস করি। আমার জীবনটাই গড়ে উঠেছে কঠোর সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবনের উচ্চতম লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা ছিল আমার।’ প্রথম ক্রোয়েশিয়ান হিসেবে ব্যালন ডি’অর ট্রফি হাতে নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বলবে, একজন ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার তার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছে ব্যালন ডি’অর জয়ে।’ মেসি এবং রোনালদোর মতো ভিন্ন লেভেলের ফুটবলারদের টপকে এই ট্রফি জিতে তিনি বলেন, ‘তাদের সমকক্ষতা কেউই দাবি করতে পারে না। তারা ফুটবলের ইতিহাসের সেরা।’
ব্যালন ডি’অর ট্রফি হাতে বক্তব্যের শেষদিকে দারুণ একটা মন্তব্য করেছেন মডরিচ। ‘আমি সত্যিই সুখি যে সাধারণ কেউ ব্যালন ডি’অর জিততে পারে।’ মডরিচ ঠিকই বলেছেন। মেসি-রোনালদো ছাড়াও যে এই পুরস্কারটা কেউ জিততে পারে গত ১০ বছরে তা তো ভুলেই গিয়েছিল সবাই!