কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল কল্পলোকের গল্প বলছেন। কিন্তু বক্তা যখন মাশরাফি নিজে, তখন সেটা আর গল্প হয়ে থাকেনি। বাস্তবতার কঠিন জমিনে সেটা সত্য বলে মানতেই হচ্ছে। বছর কয়েক আগে মিরপুর স্টেডিয়ামে মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে জমাট আড্ডায় হঠাৎই বলেছিলেন, ‘ক্রিকেট ইতিহাসে আমার মতো ক্রিকেটার নেই, যিনি দুই হাঁটুতে সাত-সাতটি অস্ত্রোপচারের পরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন।’ ২০০১ থেকে ২০১৮; শুধু ১৭ বছর নয়, ১৪১ বছরের ক্রিকেট ইতিহাস ঘেঁটেও পাওয়া যায়নি সাতটি বড় অস্ত্রোপচারের পরও ক্রিকেট খেলছেন। মাশরাফি বিন মর্তুজা সেই বিরল ক্রিকেটার, যিনি খেলছেন, খেলাচ্ছেন এবং একই সঙ্গে আলো ছড়াচ্ছেন। বিরল প্রজাতির ক্রিকেটার মাশরাফি বৈপরীত্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্যারিয়ারের ২০০ নম্বর ওয়ানডে খেলেছেন গতকাল। হয়েছেন ম্যাচ সেরাও। শুধু খেলেই ইতিহাসের সোনালি পাতায় নাম লিখে থেমে থাকেননি টাইগার অধিনায়ক, নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন প্রিয় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। অসম্ভবকে সম্ভব করেই চলেছেন মাশরাফি। প্রথম টাইগার ক্রিকেটার হিসেবে মাশরাফি খেলেছেন ২০০ ওয়ানডে। ১৯৬ ওয়ানডে খেলে পরের নামটি মুশফিকুর রহিমের। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবের ওয়ানডে সংখ্যা ১৯৩ এবং তামিম ইকবালের সংখ্যা ১৮৪। ২০০১ সালে চট্টগ্রামে অভিষেক। এরপর ১৭ বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছেন থেমে থেমে। বন্ধুর এই পথ চলায় সাতবার হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে মাশরাফির। যখনই ইনজ্যুরিতে পড়েছেন, তখনই মনে হয়েছে ক্যারিয়ার থেমে যাবে ‘নড়াইল এক্সপ্রেসের’। কিন্তু থেমে পড়েননি। বিপরীত প্রতিকূলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ‘টু হান্ড্রেড’ ওয়ানডে ক্লাবের সদস্য হয়েছেন। ইতিহাস লেখার আগের দিন রেকর্ডটি নিয়ে আলাদা করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি মাশরাফি, আমি কোনোদিনই এসব নিয়ে ভাবিনি। তবে বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ ওয়ানডে খেলতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। যখনই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নাম উঠবে, তখন আমার নামটা থাকবে সেখানে। এটাই অনেক।’ অসম্ভবকে সম্ভব করা ক্রিকেটারের ইতিহাস লেখা ম্যাচটির পারফরম্যান্সও স্মরণে রাখার মতো। ২০০ নম্বর ওয়ানডেতে মাশরাফির স্পেল ১০-০-৩০-৩! ৩৫ বছর বয়সী একজন ক্রিকেটারের বোলিং এমন মিতব্যয়ী স্পেল! ভাবা যায়! গতকাল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বোলিংয়ে আসেন ১৫ নম্বর ওভারে। প্রথম বলে বাউন্ডারি দিয়ে শুরু তার স্পেল। এরপর টানা ৭ ওভার বোলিং করে ১৪ রানের খরচে নেন ড্যারেন ব্রাভো ও শাই হোপের উইকেট। দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে আসেন ৩৭ নম্বর ওভারে। এবারের স্পেল ২-০-৫-১। তৃতীয় স্পেল ছিল খরুচে। ৪৪ নম্বর ওভারে। ১১ রান দেওয়া ওভারের শেষ বলটি ছিল ছক্কা।
ক্যারিয়ারের অন্তিম সময়ে দাঁড়ানো মাশরাফির ঘরের মাঠে সম্ভবত এটাই শেষ ওয়ানডে সিরিজ। বোলিং বুট তুলে রাখতে চান ২০১৯ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলে। কারিয়ার শেষে নতুন জীবনে পা রাখার ইচ্ছায় যোগ দিয়েছেন রাজনীতিতে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন টাইগার ওয়ানডে অধিনায়ক। রাজনীতিতে নাম লেখানোয় সমালোচকরা নড়েচড়ে বসেছিলেন। খুঁজতে শুরু করেছিলেন, ক্রিকেটীয় মানসিকতায় খুঁত ধরতে। কিন্তু অদম্য লড়াকু মাশরাফির কাছে ক্রিকেট সব, ক্রিকেটই শেষ এবং ক্রিকেটই ধ্যান-জ্ঞান- গতকাল শীতের সন্ধ্যায় আরও একবার প্রমাণ দিলেন তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে। দুরন্ত বোলিং করে নাভিশ্বাস তুলে ফেলা মাশরাফির পরিসংখ্যানই বলে, আরও উপরে থাকার কথা ছিল তার। ২০০ ওয়ানডেতে মাশরাফির উইকেট সংখ্যা ২৫৫টি।