ব্রিস্টল থেকে টনটন। দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ঘণ্টা খানেকের পথ। সমারসেটের সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে এই টনটন। ৭০ হাজার লোকের বাস।
সমারসেট ও ব্রিস্টল পাশাপাশি। অ্যাভন নদী দুই কাউন্টিকে বিভক্ত করেছে। ওয়েলসও খুব দূরে নয়। সমারসেটকে ওয়েলস থেকে বিভক্ত করেছে ব্রিস্টল চ্যানেল!
বাংলাদেশ দলকে অনুসরণ করতে করতে ক্রীড়া সাংবাদিকরা লন্ডন থেকে কার্ডিফ (ওয়েলসের রাজধানী) এবং ব্রিস্টল ঘুরে এখন টনটনে। লন্ডন কোলাহলের শহর। কার্ডিফ উৎসবের নগরী। ব্রিস্টল বেশ নিরিবিলি। আর টনটনে দেখছি একেবারেই সুনসান নীরবতা।বুধবার বিকালে বাস থেকে নেমেই শুনতে পাই গর্জন। বুঝতে বাকি থাকে না যে এমন শব্দ কেবল স্টেডিয়ামেই পাওয়া যায়। বাস টার্মিনাল থেকে আট মিনিটের হাঁটা পথ স্টেডিয়াম। টনটনের কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তখন চলছিল অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের ম্যাচ। নীরবতার কারণে গর্জন এত জোরে শোনা যাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন পাশের বিল্ডিংইতো! টনটনের এই মাঠেই ১৭ জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলবে বাংলাদেশ।
দুপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও পা রেখেছে এই নীরব শহরে। মাত্র এক ঘণ্টার জার্নি হলেও বুধবার ও বৃহস্পতিবার ছিল ক্রিকেটারদের ছুটি। দলের দুই বড় তারকা সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল চলে গিয়েছিলেন লন্ডনে।
ছুটির আমেজে সন্ধ্যায় বাংলাদেশের টিম ম্যানেজার খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে ‘রাজপুত তন্দুরি ও রেস্টুরেন্ট’-এ খেতে এসেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন, সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও আবু জায়েদ চৌধুরী রাহী।
ভারতীয় খাবারের জন্য টনটনে বিখ্যাত এই রাজপুত রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় ইংলিশদের কাছেও দারুণ প্রিয়। ক্রিকেট মাঠের খুবই কাছে। ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা যখনই সমারসেটে খেলতে আসেন এই রেস্টুরেন্টেই খান। মজার বিষয় হচ্ছে, বিখ্যাত এই রেস্টুরেন্টটির মালিক কিন্তু দুজনই বাংলাদেশি। নোয়াখালীর আবদুল মানাস ও লক্ষ্মীপুরের আমজাদ হোসেন দুই বন্ধু মিলে ২৬ বছর আগে ক্রয় করেছেন এই রাজপুত তন্দুরী রেস্টুরেন্ট। আগে নাম ছিল ‘ফোর-হর্স’। পরে তারা নাম পরিবর্তন করেন। টনটন শহরের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে একটি। হোটেলের কর্মকর্তা কর্মচারীও সবাই বাংলাদেশি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই রেস্টুরেন্টের অনেক নাম ডাক। ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা টনটনে খেলতে আসলে এখানেই খায়। একদিন আগেইতো পাকিস্তান জাতীয় দলের সব ক্রিকেটার এখানে এসে খেয়ে গেছেন।’ ম্যানেজার শহীদুল্লাহ রোমান বলেন, ‘বাংলাদেশের দলের ক্রিকেটাররাও এসেছিলেন। খুবই ভালো লাগে যখন বাংলাদেশ থেকে কেউ এখানে খেতে আসে। আর ক্রিকেটারদের মতো তারকারা আসলে তো কথাই নেই।’
খাবারে ইংলিশরা তেল-ঝাল-লবণ খায় না বললেই চলে! তাই বিদেশ সফরে ক্রিকেটারদের মতো বাংলাদেশ থেকে আসা সাংবাদিকরা ভারতীয় রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকেন। বলে রাখা ভালো, যুক্তরাজ্যে নামে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট হলেও মালিক কিন্তু অধিকাংশই বাংলাদেশি। এখানে বাংলাদেশি খাবার ‘ভারতীয় খাবার’ নামে পরিবেশন করা হয়!
ব্রিস্টলে পরিচয় হয়েছিল রাসেল হুসাইনের সঙ্গে। সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে ইংল্যান্ডে যিনি প্রথম এসেছিলেন এবং ভারতীয় রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেছিলেন সেই ইসরাইল মিয়ার নাতি। রাসেল বলেন, ‘আমার দাদা ১৯৪৯ সালে জাহাজের চাকরি নিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন। লন্ডনে লাহোর তন্দুরী নামে রেস্টুরেন্ট দেন। সেটিই ছিল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি মালিকানায় প্রথম রেস্টুরেন্ট। শুনেছি, তখন বাংলাদেশকে (পূর্ব পাকিস্তান) ইংলিশরা চিনতো না। তাই বাঙালি খাবার বললে হয়তো রেস্টুরেন্টটি চলতো না, সে কারণেই রেস্টুরেন্টটি ভারতীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট নামকরণ করা হয়। এখন পর্যন্ত সেই ধারাটাই চলে আসছে। যুক্তরাজ্যে পরবর্তীতে যারাই রেস্টুরেন্ট দিয়েছেন, তা হয়েছে ভারতীয়। তবে ইদানীং ভারতীয়-বাংলা রেস্টুরেন্ট লেখা হচ্ছে।’
যাই হোক, রাজপুত রেস্টুরেন্টে আড্ডার মুডে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন ক্রিকেটাররা। হ্যাঁ, যুক্তরাজ্যে সন্ধ্যাতেই রাতের খাবার খাওয়া হয়। কারণ রাত তো মাত্র ৬-৭ ঘণ্টা। তা ছাড়া রোজা (নফল) ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তাই সবাই এই রাতের খাবারের জন্য সন্ধ্যাটাই বেছে নিয়েছেন।
রেস্টুরেন্টের কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন মিরাজের দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও হয়। তার বাসা থেকে মিরাজের জন্য ইফতারও নিয়ে আসেন। আড্ডা ও খাবারের ফাঁকে ফাঁকে ফটোসেশনও চলতে থাকে। মিরাজ বলেন, ‘টনটনে ভালোই লাগছে। এখানকার খাবারও ভালো।’
এমন পরিবেশে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ নেই। তারপরও ক্রিকেট খেলতেই তো তারা এখানে এসেছেন। রুবেল হোসেনকে কানে কানে যখন বললাম প্রস্তুতি কেমন- বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রস্তুত হয়েই আছি। যদি সুযোগ পাই নিজের সেরাটা দিয়েই চেষ্টা করব।’ দলের কি অবস্থা? খেতে খেতে রুবেল বললেন, ‘সবাই ভালো আছে।’ দল ভালো থাকলেই সব ভালো। সামনে যে কঠিন পরীক্ষা। সেমিফাইনালের আসা টিকে রাখতে হলে ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে জয়ের বিকল্প নেই। এমন সময় ফুরফুরে মেজাজে থাকা খুই জরুরি। তবে সমারসেটে এসে প্রথম দিনে সন্ধ্যাটা ভালোই উপভোগ করলেন ক্রিকেটাররা।