শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

অ্যাংলো স্যাক্সন ও সাকিব...

অ্যাংলো স্যাক্সন ও সাকিব...

অনুশীলনে কোচ স্টিভ রোডসের সঙ্গে সাকিব আল হাসান - সংগৃহীত

রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ফুরফুরে মিষ্টি বাতাস দেহ-মনকে প্রফুল্ল করে দেয়! ফাঁকা শহর। মানুষ খুব কম। দোকানপাট খোলা থাকে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। একটু এদিক-সেদিক হওয়ার উপায় নেই। সন্ধ্যা হয় সাড়ে ৯টায়। কিন্তু অধিকাংশ দোকান বন্ধ হয়ে যায় ঠিক সাড়ে ৫টায়। দেখে মনে হতেই পারে এটি কোনো মফস্বল শহর! কিন্তু নিয়মকানুন সব আন্তর্জাতিক মানের! আর আন্তর্জাতিক মানের কেনই বা হতে হবে, আমরা ‘আন্তর্জাতিক মান’ বলে নিজেদের আরও উন্নততর জীবনমানের প্রয়াসে যে আপ্তবাক্য আওড়াই সেটা তো এদেরই সৃষ্টি।

এ শহরে মেইন রাস্তার চেয়ে ফুটপাথ বড়! এখানে কোনো গাড়ির চালক হর্ন বাজায় না। কখনই যে হর্ন বাজে না ঠিক তা নয়! তবে এখানে হর্ন বাজানোর অর্থ ‘গালি দেওয়া’। রাস্তায় লোক থাকুক বা না থাকুক ট্রাফিক সিগন্যালের সবুজ বাতি জ্বলা পর্যন্ত কোনো গাড়ি সামনে যায় না। সবার আগে এখানে ‘অগ্রাধিকার’ পায় পথচারী। রাস্তা পার হওয়ার জন্য কোনো পথচারী সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখামাত্রই গাড়ি থামিয়ে চালক মাথা ঝুঁকিয়ে তাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছে।

বাংলাদেশে যেমন রাস্তায় এক গাড়ির সঙ্গে আরেক গাড়ির রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে, একজন আরেকজনকে একটুও ছাড় দেয় না; এখানে ঠিক তার উল্টো। কে কাকে সবার আগে সাইড দেবে সেজন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সভ্য শহরের সভ্য মানুষ বলে কথা! এমন এক শহরেই ‘বাঁচা-মরা’র ম্যাচ খেলতে মাঠে নামছে বাংলাদেশ! সেমিফাইনালের আশা জিইয়ে রাখতে হলে জিততেই হবে টাইগারদের। প্রতিপক্ষ ‘ভয়ঙ্কর’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

এই ক্যারিবীয় দলটিকে তাদের মাটিতে সবশেষ সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে তিন জাতি টুর্নামেন্টে টানা তিন ম্যাচে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে টাইগাররা। তার পরও এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুর্দান্ত-দুর্বার! কেননা, তাদের দলে আছে ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, এভিন লুইস, শিমরন হেটমায়ারের মতো দানবীয় চরিত্রের ক্রিকেটার; যারা একই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!

তবে বাংলাদেশও কম কীসে! আমাদের আছেন একজন সাকিব আল হাসান। এ টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচেই তিনি ২৬০ রান করে সবার ওপরে এখনো। কেবল ব্যাট হাতে জ্বলে উঠে সাকিব সবার ওপরে। বল হাতে যখন আগুন ঝরাবেন তখন না জানি কী হয়!

এই সাকিবই এখন বাংলাদেশ দলের আশা-ভরসার প্রতীক। তা ছাড়া প্রতিপক্ষ যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার তখন আরও বেশি উজ্জীবিত! আরও উচ্ছল। আরও দুর্বার-দুরন্ত।

২০১ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ব্যাট হাতে যেখানে সাকিবের গড় ৩৬.৬৬, সেখানে ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে ৪৫.৯২। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরদ্ধে তিনি খেলেছেন মোটে ১৭ ম্যাচ, রান ৫৯৭। ব্যাট হাতে যতটা সফল ততটা নন বল হাতে। কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তার উইকেট মাত্র ১৬টি। তবে নিজের দ্বিতীয় সেরা বোলিং কিন্তু আবার এই উইন্ডিজের বিরুদ্ধেই। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে যে ম্যাচে ক্যারিবীয়দের মাত্র ৬১ রানে অলআউট করে দিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ম্যাচে মাত্র ১৬ রানে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট নেওয়ার আগে সেটিই ছিল সাকিবের সেরা।

অতীতের কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ?

টনটন ক্রিকেট গ্রাউন্ড তো স্পিনারদের জন্য বধ্যভূমি! এখানে সবশেষ দুই ম্যাচে একাধিপত্য ছিল পেসারদের। স্পিনারদের ন্যূনতম গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে মাত্র ৩০ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ আমির। আর অসিদের জিতিয়ে দিয়েছেন তিন পেসার প্যাট কামিন্স (৩ উইকেট), মিচেল স্টার্ক (২টি) ও কেন রিচার্ডসন (২টি)।

আগের ম্যাচেও ছিল পেসারদেরই দাপট। নিউজিল্যান্ডের দুই পেসার জেমস নিশাম ও লকি ফার্গুসন ধসিয়ে দিয়েছেন আফগানিস্তানকে। মাত্র ১৭২ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধবিধ্বংস দেশটির ইনিংস। নিশাম ৩১ রানে ৫ উইকেট আর ফার্গুসন ৩৭ রানে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। আফগানিস্তান তাদের সেরা বোলার রশিদ খানের হাতে তো বলই তুলে দেওয়ার সাহস পায়নি।

সেই মাঠে স্পিন নিয়েই আক্রমণ সাজাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আতঙ্ক তৈরি করার মতো আগ্রাসী পেসার যে আমাদের দলে নেই তা তো ‘ওপেন-সিক্রেট’! তাই ঘুরেফিরে ভরসা করতে হচ্ছে স্পিনেই। স্পিন মানেই তো সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার ব্যাট হাতে যেমন দুরন্ত ছন্দে রয়েছেন বল হাতে ততটা নন। হয়তো এই ম্যাচ থেকেই বোলিংয়েও সাকিবই সেরা! সত্যিই কি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হতে পারবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বধের নায়ক? এমন বাঁচা-মরা ম্যাচে কি হতে পারবেন লাল-সবুজের ত্রাণকর্তা?

টনটন তো ইতিহাস গড়ার শহর। এখানে যেমন ক্রিকেটের প্রথম ব্যক্তিগত ৪০০ রানের ইনিংস হয়েছে, তেমনি ভিভ রিচার্ডসের এক দিনে ৩২২ রান করার রেকর্ডটিও আছে। এ শহরেই গোড়াপত্তন হয়েছিল জগদ্বিখ্যাত ইংরেজি সাহিত্যের ‘অ্যাংলো স্যাক্সন’-এর (প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় লেখা সাহিত্য)। হাজার বছরের পুরনো আশ্রম ও টনটন প্রাসাদই তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখন দেখা যাক, ঐতিহাসিক এই শহরে বাংলাদেশের প্রাণ সাকিব আল হাসান নতুন কোনো ‘মহাকাব্য’ সৃষ্টি করতে পারেন কিনা!

সর্বশেষ খবর