মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

খলনায়ক থেকে নায়ক

খলনায়ক থেকে নায়ক

বেন স্টোকস

বাংলার ট্র্যাজেডি গল্প ‘সোহরাব-রুস্তম’ এর শেষ দৃশ্যটি মনে আছে? যুদ্ধের ময়দানে শেষ পর্যন্ত বাবার হাতে নিহত তার বীর সন্তান! মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করে ‘মহাবীর’ হওয়ার অনন্য খেতাব জিতেছেন তিনি, কিন্তু নিজের সন্তানকে নিজ হাতে বধ করার কষ্ট কি কখনো ভুলতে পারবেন?

ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে দিয়ে বেন স্টোকসও এখন ইংলিশদের ‘জাতীয় বীর’! কিন্তু নিজের মাতৃভূমি নিউজিল্যান্ডকে নিজ হাতে পরাজিত করার মনোকষ্ট থেকে কি কখনো নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন! ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো শিরোপা এনে দেওয়ায় যেমন তিনি অনেক বেশি সম্মানিত হবেন তেমনি নিউজিল্যান্ডকে পরাজিত করার জন্য গ্লানিতে ভুগবেন।

মাত্র ১৬ বছর আগেও বেন স্টোকসের স্বপ্ন ছিল কেবলই নিউজিল্যান্ড কেন্দ্রিক। কারণ তার জন্মই তো নিউজিল্যান্ডে। বেড়ে ওঠাও ক্রাইস্টচার্চে। জীবিকার টানে ১৬ বছর আগে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। বেন স্টোকসের বাবা জেরার্ড স্টোকস ছিলেন নিউজিল্যান্ড রাগবি জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়। দেশটির হয়ে রাগবি টেস্টও খেলেছিলেন একটি। তবে রাগবি কোচ হিসেবে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। কাল ছেলে ইংল্যান্ডের হয়ে খেললেও বাবা নিউজিল্যান্ডকেই সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু তার ছেলের হাতেই নিউজিল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে গেল। তাই অনেকে জেরার্ডকে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে ঘৃণিত বাবা মনে করেছেন। আর মাতৃভূমিতে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি এখন বেন স্টোকস।

তবে নিউজিল্যান্ড বেন স্টোকস যাই মনে করুক না কেন ইংল্যান্ডে তিনি এখন মহানায়ক। তাকে ঘিরেই তো ইংলিশ উৎসব। অবিশ্বাস্য ফাইনালে তিনি যেন একাই ইংল্যান্ডকে নিয়ে গেছেন স্বপ্নের ঠিকানায়। নির্ধারিত ৫০ ওভারের ম্যাচে ইংলিশরা যে টাই করেছে সেটা সম্ভব হয়েছে স্টোকসের অপরাজিত ৮৪ রানের সৌজন্যেই। সুপার ওভারেও ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তিনি। তাই তো ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগান স্টোকসকে বলেছেন ‘সুপারম্যান’! ‘স্টোকস তো সুপারম্যান! সে যেভাবে ব্যাট করে দলকে টেনে নিয়ে গেছে তা এক কথায় অসাধারণ। বাটলারের সঙ্গে তার জুটিটি ছিল দেখার মতো। প্রচ  চাপকে আগলে রেখে তিনি তার মতো করে অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন।’ একদিকে ইংল্যান্ডে যেমন স্টোকসকে নিয়ে চলছে আনন্দ উৎসব একই সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে চলছে শোকের মাতম! নিউজিল্যান্ড হেরে যাওয়ায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছে স্টোকসের পরিবার। নিউজিল্যান্ডে থাকা স্টোকসের মা ডেবোরাহ বলেন, ‘খেলা শেষে খুবই কেঁদেছি। নিউজিল্যান্ডের হার কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। এমন একটা ম্যাচ ড্র হলেই সবচেয়ে ভালো হতো। কাউকে কষ্ট পেতে হতো না।’

তবে একই সঙ্গে তাদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। নিজেদের হার এবং ছেলের জয় নিয়ে সিনিয়র স্টোকস সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘ব্লাক ক্যাপসদের জন্য খুবই খারাপ লাগছে। তবে ছেলের পারফরম্যান্সে ইংল্যান্ড জিতেছি এটি কিন্তু ভালো লাগারও বিষয়। তবে এটি আমার দেখা সেরা ক্রিকেট ম্যাচ। ক্রিকেটে এর আগে কখনো এমন নাটকীয়তা আর দেখিনি।’

তবে শুধু বেন স্টোকস নয়, ইংল্যান্ডের একাদশে আরও বেশ কয়েকজন প্রবাসী ক্রিকেটার আছেন। অধিনায়ক ইয়ন মরগানের বাড়িই তো ডাবলিনে। দলের সেরা বোলার জোফরা আর্চারের জন্ম বার্বাডোজে। সেরা ওপেনার জেসন রয়ের বাড়ি দক্ষিণ আফ্রিকায়। এ ছাড়া দলের স্পিনার আদিল রশীদ ও মঈন আলী পাকিস্তানি বংশো™ভূত। প্রবাসীরাই এখন ইংল্যান্ড দলের প্রাণ। ইংল্যান্ডকে জিতিয়ে দিলেন বিশ্বকাপ। তবে বেন স্টোকসের ঘটনা যেন সবার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। ফাইনালে নিজ দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে তাকে। আবার সেই ম্যাচেই কিনা সেরা হয়েছেন। এখানে মাতৃভূতির প্রতি আবেগের চেয়েও স্টোকসের কাছে বড় ছিল তার দায়িত্ব। গল্পের সোহরাব যেমন নিজের দায়িত্বের প্রতি অবিচল থাকতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে সন্তান রুস্তমকে বধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্টোকসও তার মাতৃভূমিকে এতটুকুও ছাড় দেননি। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হলেও দায়িত্বশীলতার অনন্য এক নজির স্থাপন করেছেন বেন স্টোকস। তিনি শুধু ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় বীর’ নন, গোটা ক্রিকেট বিশ্বের যেন এক ‘মহাবীর’! যতদিন এই বিশ্বে ক্রিকেট নামক খেলাটি থাকবে, ততদিন আলোচিত হবে অবিশ্বাস্য এই ‘ফাইনাল’, আর এই ফাইনালের নায়ক হিসেবে আলোচিত হবেন বেন স্টোকস! স্যালুট হে, মহানায়ক!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর