শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইতিহাদে বৃষ্টিভেজা বিকাল

মেজবাহ্-উল-হক, ম্যানচেস্টার থেকে ফিরে

ইতিহাদে বৃষ্টিভেজা বিকাল

ইতিহাদ ক্যাম্পাস। ম্যানচেস্টার শহরের একটি জনপ্রিয় ট্রাম স্টেশন। প্লাটফরমে নেমে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেই বিখ্যাত ‘ইতিহাদ স্টেডিয়াম’। আগে নাম ছিল ‘সিটি অব ম্যানচেস্টার স্টেডিয়াম’। স্পন্সরের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে ‘ইতিহাদ’। এটিই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির ‘হোম গ্রাউন্ড’।

ম্যানচেস্টারের প্রধান দুটি ক্লাব। আরেকটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তবে ম্যানইউ প্রধান শহরের বেশ বাইরে। আরেক ছোট্ট শহর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। ম্যানচেস্টার শহরবাসী যত উচ্ছ্বাস ‘ম্যানসিটি’কে ঘিরেই। সিটির ভক্তদের অনেকে তো সহ্যই করতে পারেন না ম্যানইউকে। যেন চিরশত্রু।

ম্যানচেস্টারের প্রধান ট্রেন স্টেশন ‘ম্যানচেস্টার পিকাডিলি’ থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় ইতিহাদ ক্যাম্পাসে। ট্র্যামে গেলে ৩-৪ মিনিটের পথ।

ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনাল ছিল ম্যানচেস্টারে। যে ম্যাচে ভারতকে বিদায় করে দিয়ে ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাওয়া সমর্থক কিংবা কাভার করতে যাওয়া মিডিয়াকর্মীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ইতিহাদ স্টেডিয়াম।

অফ-সিজন হওয়ায় অবকাশ যাপনে ব্যস্ত ছিলেন ফুটবলাররা। বৃষ্টিস্নাত এক বিকালে ইতিহাদে গিয়ে দেখা যায় চারদিকে সুনসান। কেবল দর্শনার্থীদের কেউ কেউ বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ইতিহাদের পাশেই অ্যাথলেটিকস স্টেডিয়াম। সেখানে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন কেউ কেউ। দুই স্টেডিয়ামের আলাদা কোনো বাউন্ডারি নেই।

কথা হয় অ্যাথলেটিকসের প্রশিক্ষক টিম মার্টিনের সঙ্গে। বাড়ি স্কটল্যান্ডে। কিন্তু এখন থাকেন ম্যানচেস্টারেই। নিজ থেকেই পরিচিত হলেন মার্টিন। বললেন, ‘ইতিহাদ দেখতে এসেছেন? কিন্তু এখন তো এখানকার আসল রূপটাই দেখতে পাচ্ছেন না। কেবল নি®প্রাণ স্টেডিয়াম দেখছেন। খেলার দিন এই পুরো ক্যাম্পাস লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।’ ইতিহাদের বেশ কয়েকটি গেট। কিন্তু কোনটি প্রধান  গেট তা বলা কঠিন। প্রত্যেক গেটকেই মনে হয় প্রধান। স্টেডিয়াম থেকে বের হতে যাতে ভক্তদের কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য বিশাল বিশাল একেকটি গেট।

লিভারপুলের অ্যানফিল্ডে মোহাম্মদ সালাহকে নিয়ে যতটা মাতামাতি, ঠিক ততটাই ইতিহাদে আর্জেন্টাইন তারকা সার্জিও আগুয়েরোকে নিয়ে। ২৩৩ গোল করে ম্যানসিটির সর্বোচ্চ গোলদাতা এখন তিনি। স্টেডিয়ামের গায়ে আগুয়েরোর বিশাল ছবি টানিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া ক্লাবের ইতিহাসের সেরা তারকাদের ছবিও আছে।

ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠিত ১৮৯৪ সালে। দল প্রথম বড় কোনো শিরোপার স্বাদ পায় ১৯০৪ সালে। তারা এফএ কাপের ট্রফি ঘরে তোলে। তবে তখনো ম্যানসিটি নিজেদের শক্তিশালী ইংলিশ দল হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ছায়াতেই ছিল।

১৯৬০-এর দশকে এসে ম্যানসিটি শক্তিশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমবারের মতো এক মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা, এফএ কাপ এবং লিগ কাপ জেতে। প্রথমবারের মতো তারা ট্রিবল জয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল।

তারপর আবার দীর্ঘ সময়ের জন্য যেন শ্বেত নিদ্রায় যায় ম্যানসিটি! অবনমন হতে হতে তারা তৃতীয় বিভাগে নেমে যায়। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে ভীষণ অর্থকষ্টে ভুগতে হয়েছিল দলটিকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আবুধাবী ইউনাইটেড গ্রুপ ম্যানসিটি কেনার পর নতুন করে জেগে ওঠে ক্লাবটি। একের পর এক তারকা মহাতারকাদের দলে এনে বিশ্বকে চমকে দেয়। দ্রুত সাফল্য পেতে শুরু করে দলটি। ২০১১ সালে তারা ৪৪ বছর পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জেতে। স্প্যানিশ তারকা কোচ পেপ গার্ডিওলাকে নিয়োগ দেওয়ার পর আরও উজ্জীবিত হয় ম্যানসিটি। শেষ দুই মৌসুমেই লিগের শিরোপা জিতেছে।

এ পর্যন্ত মোট ৬টি লিগ শিরোপা জিতেছে সিটি। ২০১৮ সালে তো ১০০ পয়েন্টসহ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে দলটি। হু হু করে বেড়ে গেছে সিটির আয়ও। এই মুহূর্তে ফুটবল বিশ্বে পঞ্চম ধনী ফুটবল ক্লাবের মধ্যে একটি। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও বায়ার্ন মিউনিখের পর ম্যানসিটির অবস্থান।

আবুধাবী গ্রুপ ম্যানসিটি কিনে নিয়েছিল ২১০ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে, আর ২০১৭-১৮ মৌসুমে সিটির আয় ৫২৭.৭ মিলিয়ন ইউরো।

যাই হোক, অ্যাথলেটিকস স্টেডিয়ামের পাশের গেট থেকে উল্টো পাশের গেটে গিয়ে দেখা হয়, ব্লাঙ্কোসের সঙ্গে। ব্রাজিলের ছেলে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের অন্ধ ভক্ত। যুক্তরাজ্য সফরে এসে দেখতে গিয়েছিলেন ইতিহাদ স্টেডিয়াম। খুঁটিয়ে খুুঁটিয়ে সব কিছু দেখছিলেন, ছবি তুলছিলেন।

ব্লাঙ্কোসের বাড়ি নাকি ব্রাজিলের বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামের পাশেই। কথা প্রসঙ্গে মারাকানা ও ইতিহাদের তুলনা করতে বললে ব্লাঙ্কোস বলেন, ‘আমার কাছে মারাকানা সেরা স্টেডিয়াম। কিন্তু ইতিহাদের মতো মারাকানার বাইরের দৃশ্য এতো চমৎকার নয়। সত্যিই আমি অভিভূত হয়ে গেছি। না জানি, এই ইতিহাদের ভিতরটা কতটা সুন্দর।’

কথা বলতে বলতেই হঠাৎ বৃষ্টি নেমে পড়ে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে যেন ইতিহাদের অন্যরকম এক মায়াবী রূপ চোখে ভাসে। যা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। কেবল কল্পনাই করা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর