শিরোনাম
বুধবার, ২ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাফল্যের গ্রাফ কেন নামছে

মেজবাহ্-উল-হক

সাফল্যের গ্রাফ কেন নামছে

আমাদের ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে না। এ ছাড়া খেলোয়াড়রা বড় স্বপ্নও দেখে না। কোচের পরিবর্তন, সঙ্গে প্রস্তুতির বিষয়টি তো আছে। সব মিলেই গ্রাফটা নিচে নামছে

 

ক্রিকেটে উত্থান-পতন আছে এবং থাকবেই! কখনো ভালো হবে, কখনো খারাপ। তবে এই ভালো-মন্দের মধ্যে একটা সামঞ্জস্যও থাকা চাই। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থান-পতনটা খুবই অস্বভাবিক! টাইগারদের সর্বশেষ তিন বছরের (২০১৭, ’১৮, ’১৯) পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে উঠতে হঠাৎ চলতি বছরে ছন্দপতন! যেন চূড়ায় উঠতে গিয়ে ধপাস করে পাদদেশে ছিটকে পড়েছে।

টেস্ট ক্রিকেটে খুব নিয়মিত নয় বাংলাদেশ। তাই সাফল্যও সেভাবে আসেনি। তবে ২০১৭ সালে সাফল্যের হার ছিল ২২.২২ ভাগ (নয় ম্যাচে দুই জয়)। এ জয় দুটিই ঐতিহাসিক। একটি শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে তাদের মাটিতে শততম টেস্টে, আরেকটি ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ রানের স্মরণীয় জয়।

২০১৮ সালে সাফল্যের এ হারটা বেড়ে গিয়ে হয়েছিল ৩৭.৫ ভাগ (আট ম্যাচে তিন জয়)। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইনিংস ও ১৮৪ রানেরর জয়টি টাইগারদের টেস্ট ইতিহাসেই বড় জয়। কিন্তু চলতি বছরে সাদা পোশাকে কোনো জয়ই পায়নি টাইগাররা। তিন ম্যাচের তিনটিতেই হার। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে দুই ম্যাচে ইনিংস ব্যবধানে এবং ঘরের মাঠে সর্বশেষ আফগানদের বিরুদ্ধেও হারতে হয়েছে ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে।

এবার আসুন ওয়ানডেতে! এখানে কোনো অজুহাত দেখানোর উপায় নেই। ওয়ানডেতে বাংলাদেশ নিয়মিত দল। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ মোট ৫২টি ওয়ানডে খেলেছে। প্রতি বছরের পরিসংখ্যানটা এমন- ২০১৭ সালে সাফল্যের হার ২৮.৫৭ ভাগ (১৪ ম্যাচে চার জয়), ২০১৮ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয়ে যায় ৬৫ ভাগ। ওই বছর ২০টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ১৩টিতে। মাত্র সাতটি ম্যাচে হারতে হয়েছে। কিন্তু চলতি বছরে সেই ওয়ানডেতেও হতাশায় নিমজ্জিত বাংলাদেশ। এ পর্যন্ত ১৮ ম্যাচ খেলে জয় মাত্র সাতটি। শতকরা হিসাবে সাফল্যের হার মাত্র ৩৮.৮৯ শতাংশ। ব্যর্থতা ৬১.১১ ভাগ। হঠাৎ করে যেন উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করেছে টাইগাররা!

বাংলাদেশের সাফল্যের এই গ্রাফটা কেন হঠাৎ করে নিচে নেমে গেল? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কথা হয় জাতীয় দলের সাবেক কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী, সাবেক কোচ ও বিসিবির সাবেক পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম, বিসিবির সাবেক পরিচালক খন্দকার জামিল উদ্দিন আহমেদ ও বর্তমান পরিচালক এবং ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান আকরাম খানের সঙ্গে।

জালাল আহমেদ চৌধুরীর ব্যাখ্যা, ‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান দিন দিন কমছে। আর এর একটা বড় প্রভাব পড়ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। তা ছাড়া আমাদের ক্রিকেট যদি এক পা এগোয় তো অন্যরা এগোচ্ছে দুই পা। এখানে আমরা ঠিক ঠাকমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছি না। যে কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।’

ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিমও। তবে তিনি পাশাপাশি বাংলাদেশ দলের এই বিপর্যয়ের পেছনে আরও কিছু কারণ খুঁজে পাচ্ছেন, ‘আমাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফটা নিচে নামার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। অস্থিরতা, ফিলোসফির পরিবর্তন ও আস্থাহীনতা। আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। এ কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পার্থক্যটা অনেক বেশি। কিন্তু ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পার্থক্য খুব কম। সে কারণে ওদের পারফর্ম দিন দিন ভালো হয়, আমাদের ক্রিকেটাররা ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারে না। এ ছাড়া খেলোয়াড়রা বড় স্বপ্নও দেখে না। কোচের পরিবর্তন, সঙ্গে প্রস্তুতির বিষয়টি তো আছে। সব মিলেই গ্রাফটা নিচে নামছে।’

বিসিবির সাবেক পরিচালক খন্দকার জামিল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, কিছু সিনিয়র ক্রিকেটারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণেই নিম্নগামী বাংলাদেশের ক্রিকেট। সেই সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে দ্বিধা তো আছেই। জামিল বলেন, ‘কিছু সিনিয়র ক্রিকেটারের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তারা যখন খারাপ করছে তখন দলও খারাপ করছে। তা ছাড়া নতুন যারা আসছে তারা নিয়মিত পারফর্ম করতে পারছে না।’

দেশের ক্রিকেটের মান দিন দিন কেন খারাপ হচ্ছে, কেন সাফল্যের গ্রাফ নিম্নমুখী তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন জামিল উদ্দিন আহমেদ, ‘সাংগঠনিক অনৈতিকতা একটা বড় কারণ। ক্রিকেট বোর্ডের একটা বড় কাজ হচ্ছে ফ্যাসিলিটিজ বিভাগের হাতে। বিসিবির সেই বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন লোকমান ভূঁইয়ার মতো লোক। যেখানে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন। কোনো জবাবদিহি ছিল না। এ অবস্থায় কেন ক্রিকেটের গ্রাফ নিচে নামবে না? তা ছাড়া বোর্ড এখন ক্রিকেটারদের প্রতি ততটা যত্নবান নয়। সবার তেমন আন্তরিকতা নেই। নিজেদের পকেট ভরাতেই ব্যস্ত তারা। এ কারণে দিন দিন খারাপ করছে।’

 

দেশের ক্রিকেটের এই ক্রান্তিকালে ক্রীড়ামোদীরা হতাশায় ভুগলেও বিসিবি পরিচালক ও ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান আকরাম খানের কাছে এটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটে উত্থান-পতন থাকে। অনেকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। সব দেশেই একটা ভালো-খারাপ সময় যায়। এখন আমাদের একটু খারাপ সময় যাচ্ছে। তবে এই বছরে আমরা বিদেশের মাটিতে বেশি ম্যাচ খেলেছি। আর ২০১৭-১৮-তে আমরা ঘরে বেশি ম্যাচ খেলেছি। এ কারণে ভালো হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার ফর্মে নেই। যে কারণে খারাপ হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা আলোচনাও করছি। কীভাবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়।’

সত্যিই কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের বর্তমানের অবস্থাটা কেবল উত্থানের পর পতনের অংশ! নাকি খাদে পড়ে গেছে এ দেশের ক্রিকেট?

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর