বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধ্বংসাবশেষ থেকে পুনর্নির্মাণ...

মেজবাহ্-উল-হক

ধ্বংসাবশেষ থেকে পুনর্নির্মাণ...

জালাল আহমেদ চৌধুরী : জাতীয় দলের সাবেক কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক

ইন্দোরে লাল বলে ইনিংস ও ১৩০ রানে হার, কলকাতায় গোলাপি বলে পরাজয়ের ব্যবধান ইনিংস ও ৪৬ রান! ভারতের বিরুদ্ধে দুই টেস্টেই টাইগারদের ভরাডুবি। চলতি বছর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫টি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে চারটি দেশের বাইরে। এই চার ম্যাচেই ইনিংস ব্যবধানে হার। আর একটি দেশের মাটিতে। ‘পুঁচকে’ আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচেও ২২৪ রানের লজ্জার পরাজয়। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দুই দশক পরও দলের এমন করুণ দশা দেখে মর্মাহত জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ, ক্রিকেট বিশ্লেষক জালাল আহমেদ চৌধুরী। 

সাদা পোশাকে দেশের ক্রিকেট যেন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে! এমন বাজে অবস্থার জন্য যেমন সংগঠকরা দায়ী, তেমনি ক্রিকেটাররাও ধোয়া তুলশীর পাতা নন বলে মনে করেন জালাল আহমেদ। সামনেই পাকিস্তান সফর। তাই লজ্জার হারের এই ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকারও সময় নেই। এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় বলে দিয়েছেন টাইগারদের সাবেক এই গুরু। জালাল আহমেদ মনে করেন, সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। ধ্বংসাবশেষ থেকে এখন সবকিছু করতে হবে পুনর্নির্মাণ।

হঠাৎ করে দুই সিনিয়র ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের অনুপস্থিতি দলকে ভীষণ ভুগিয়েছে। ভারত সফরে সাদা পোশাকে লজ্জার হারের পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন জালাল আহমেদ। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘দলে পঞ্চপা-বের সম্মিলিত পারফরম্যান্সের যে উজ্জ্বলতা ছিল তার একটা প্রভাব পড়েছে। মাশরাফি তো টেস্টে অনেক দিন থেকেই নেই। এই সফরে সব মিলে পঞ্চপা-বের তিনজন ছিলেন না (সাকিব ও তামিম)। আর যে দুজন ছিলেন (মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ) তারাও খুব ভালো কিছু করতে পারেননি। মুশফিক কিছুটা ভালো করেছে বটে।’

সাকিবের নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতের সফরের আগে অধিনায়ক করা হয়েছে মুমিনুল হককে। এই বিষয়টিকে দলের অন্য ক্রিকেটাররা ভালোভাবে নিতে পারেননি বলে জালাল আহমেদ মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত ধারণা, যদিও শিষ্টাচারের জন্য মুখে কেউ কিছু বলেননি তবে নতুন অধিনায়ককে তারা মন থেকে মেনেও নেননি! আমি খুব কষ্টের সঙ্গেই বলছি, মুশফিক ও সাকিবের প্রতি সতীর্থদের যে আনুগত্য দেখেছি এখানে তেমনটা পরিলক্ষিত হয়নি। তবে একেবারে যে ছিল না তা বলব না।’ দীর্ঘদিন ক্রিকেট নিয়ে, ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করেছেন জালাল আহমেদ। তাই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সম্পর্কেও তার অজানা নয়। ভারত সফরের আগ মুহূর্তে ক্রিকেটারদের আন্দোলন এবং সাকিবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি দলের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বোর্ড এবং ক্রিকেটারদের মধ্যে সেতুবন্ধন খুব জরুরি ছিল বলে দাবি এই সাবেক কোচের, ‘এনভায়রনমেন্টাল মটিভেশন বা পরিবেশগত প্রণোদনা বলে একটা কথা আছে! এটার মানে মুখে কথা বলে উজ্জীবিত করা নয়। পুরো পরিবেশ কতটা উজ্জীবিত করে সেটা। এই পরিবেশগত প্রণোদনা অনুপস্থিত ছিল। সাকিবের নিষেধাজ্ঞা, ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পর খুবই দরকার ছিল পরিবেশগত প্রণোদনার। সেটা পায়নি ক্রিকেটাররা।’

দলের প্রধান কোচ, বোলিং কোচ, স্পিন কোচ তথা বলতে গেলে পুরো কোচিং স্টাফই নতুন! এদিকে বোর্ডের সঙ্গেও ক্রিকেটারদের ছিল মানসিক দূরত্ব। সব মিলেই নাকি এই ভরাডুবি! ‘প্রত্যেক দলে খেলোয়াড়দের মটিভেট করার জন্য কেউ থাকে! কিন্তু বাংলাদেশ দলে মটিভেটিং ক্যারেক্টার কে? বিদেশি কোচ? মাত্র কিছুদিন আগে আসছেন, তিনি কিভাবে দলকে উদ্দীপ্ত করবেন? তিনি আমাদের খেলোয়াড় সম্পর্কে কতটুকুইবা জানেন! এখনো ঠিকমতো সবকিছু বুঝে উঠতেই পারেননি। তাকে যেমন ক্রিকেটারদের বুঝতে হবে, তেমনি কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে, আবার এদেশের জনগণ কি চায় তাও বুঝতে হবে! তিনি তো ততটা সময়ই পাননি!’ -মন্তব্য জালাল আহমেদের।

পাকিস্তান সফরকে সামনে রেখে দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে ক্রিকেটার-কর্মকর্তাদের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলেন টাইগারদের সাবেক গুরু। তিনি বলেন, ‘সবার আগে দরকার সংহতি। খেলোয়াড়-কর্মকর্তা সবাইকে ছাড় দিয়ে এই কাজটা করতে হবে। ভারত সফরের আগে যে গোলমেলে অবস্থায় ছিল তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুই পক্ষকেই বুঝতে হবে আমাদের ভুল কোথায় হয়েছে? তা খুঁজে বের করতে হবে।’

তবে ভারত সফরে ভরাডুবির পরও পাকিস্তান সফর নিয়ে আশার কথা শোনালেন জালাল আহমেদ, ‘এমন হারের পর খেলোয়াড়রা তো লজ্জিত। তারা তাদের সক্ষমতা বুঝতে পারছেন। এখন সব ভুলে তাদেরকে নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে। একটা বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানও বিদেশ ট্যুরে খুব ভালো করেনি। এখানে আমরা সমঅবস্থানে আছি। যা ক্রিকেটারদের বুস্টআপ করতে পারে।’

বোর্ডের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এখন প্রধান কাজ হচ্ছে, এই দলকে মানসিকভাবে টেনে তুলতে হবে! আমজনতার কাজ হচ্ছে ক্রিকেটারদের ট্রল করা। বোর্ডের সেটা করলে চলবে না। এমন সময় ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের সাহস দিতে হবে। সবাই মিলে বসে পরিকল্পনা করতে হবে, কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উতরানো যায়। এক্ষেত্রে বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত সাবেক অধিনায়করা বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। মনে করতে হবে, আমরা এখন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আছি। এখান থেকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর