মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

তারুণ্যে এলো ক্রিকেট-বসন্ত

ক্রিকেট বিশ্লেষকদের দাবি, পুরস্কারে পুরস্কারে ভাসিয়ে দিয়ে তরুণ ক্রিকেটারদের মাথা নষ্ট করে দেওয়া হয়! যেন এমন ঘটনা না ঘটে!

মেজবাহ্-উল-হক

তারুণ্যে এলো ক্রিকেট-বসন্ত

পারভেজ হোসেন ইমন তো রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাখলেন। পেশিতে টান নিয়েও দলের প্রয়োজনে বাইশগজে নামলেন দ্বিতীয়বারের মতো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই রান নিলেন। আকবরের সঙ্গে গড়লেন ৪১ রানের মহামূল্যবান এক জুটি। জয় থেকে ৩৫ রান দূরে রেখে আউট হয়ে মাঠ থেকে যখন বের হচ্ছিলেন হাঁটতেই পাচ্ছিলেন না। ১৮ বছরের এক তরুণ এমন অবস্থায় খেললেন কিভাবে?

চোখে-মুখে আগুন! বুকে আত্মবিশ্বাস! মনে জয়ের ক্ষুধা! সঙ্গে সেরা পারফরম্যান্স- সব কিছুর সমন্বয়েই বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বজয় করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে প্রথম শিরোপা জিতেছে আকবর আলীরা।

বাংলাদেশ এখন আনন্দে মত্ত। সারা বিশ্বে প্রশংসা পাচ্ছে টাইগার যুবারা। আর ভারত খুঁজছে পরাজয়ের ‘কারণ’! ‘কিভাবে বদলে গেল বাংলাদেশের যুবারা?’ যে দলের সিনিয়ররা এখনো ম্যাচের আগেই হেরে বসে থাকে সেই দলের ছোটরাই কিনা বিশ্বমঞ্চে সাতবারের ফাইনালিস্টদের বোকা বানিয়ে ছাড়ল!

ভারত বাংলাদেশকে অনেক ভুগিয়েছে! দেশের মাটিতে এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশকে তারা উড়িয়ে দিয়েছে। আমিরাতের মরুপ্রান্তরেও এশিয়া কাপের ফাইনালে ‘ভারত-ভীতি’ কাটাতে না হেরে যায় সিনিয়ররা। নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ বলে ছক্কা খেয়ে ম্যাচ হারার দুঃস্মৃতি এখনো কাঁদায়। এছাড়া ২০১৬ বিশ্বকাপে চিন্নাস্বামীর সেই হার এখনো রহস্যময় মনে হয়। ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত যেন মহীরুহ হয়ে গিয়েছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সেই ভারতকে হারিয়েই ক্রিকেট সাম্রাজ্যে নতুন রাজা বাংলাদেশ।

পারফরম্যান্স, মানসিকতায়, সাহসিকতায়- সব জায়গাতেই ভারতকে ধরাশায়ী করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই স্লেজিং শুরু করে দেন বাংলাদেশের পেসার শরিফুল। আধুনিক ক্রিকেটে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে স্লেজিং অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। তবে স্লেজিং করতে হলে নিজের পারফরম্যান্সেও আত্মবিশ্বাস থাকা চাই। সেটা ছিল বলেই ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান যজশ্বী জয়সওয়ালের ক্ষেপাতে চেষ্টা করেন শরিফুল। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত দুই দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে কথার স্ফুলিঙ্গ ফুটেছে। মূলত খেলার শুরুতেই ভারতকে ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করা ভারতের ক্রিকেটারদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার সাহস কী কখনো দেখিয়েছেন সিনিয়ররা?

আবার অধিনায়ক আকবর আলীর ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করুন, একদমই ‘আইস-কুল’! কী চমৎকারভাবেই না ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষের বোলারদের স্লেজিং সহ্য করে দলকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে দিলেন। পুরো টুর্নামেন্টে রান পাননি কিন্তু ফাইনালে খেললেন ৪৩ রানের মহামূল্যবান এক ইনিংস। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর অনেকে আকবরকে তুলনা করছেন ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনীর সঙ্গে। পুরো টুর্নামেন্টে ব্যাটে রান নেই কিন্তু ফাইনালে খেললেন ৯১ রানের ঐতিহাসিক এক ইনিংস।

আসলে আকবর আলী কিন্তু ছাপিয়ে গেছেন ধোনিকেও। কেন না ধোনি খেলেছেন নিজের মাঠে- মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে, আকবর খেলেছেন হাজার মাইল দূরে পচেফস্ট্রুমে। তাছাড়া আকবর ফাইনালের আগে জানতে পারেন তার প্রিয় বোনের মৃত্যুর সংবাদ। নিজের কষ্টকে বুকে চেপে রেখে ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে খেলে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন।

আকবর এই বয়সে যে পরিপক্বতার ছাপ দেখিয়েছেন তা পুরো ক্রিকেট বিশ্বকেই অবাক করে দিয়েছে।

পারভেজ হোসেন ইমন তো রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রাখলেন। পেশিতে টান নিয়েও দলের প্রয়োজনে বাইশগজে নামলেন দ্বিতীয়বারের মতো। না নেমে উপায়ও ছিল না। ১০৬ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ধ্বংস্তুপে দল। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই রান নিলেন। আকবরের সঙ্গে গড়লেন ৪১ রানের মহামূল্যবান এক জুটি। জয় থেকে ৩৫ রান দূরে রেখে আউট হয়ে মাঠ থেকে যখন বের হচ্ছিলেন হাঁটতেই পাচ্ছিলেন না। ১৮ বছরের এক তরুণ এমন অবস্থায় খেললেন কিভাবে?

এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনাগুলোই উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে এই সাফল্য। তরুণদের এমন লড়াই দেখে ক্রিকেট বিশ্বও অবাক।

ইয়ান বিশপ কাছে থেকে দেখেছেন ফাইনাল। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর টাইগার যুবাদের সেলিব্রেশনের ভিডিও টুইটারে আপলোড করে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘এই তরুণদের দেখে আমি অভিভূত। আমার বিশ্বাস এই তরুণদের মধ্য থেকেই বেশ কয়েকজন বড় তারকা পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে।’

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক তারকা ক্রিকেটার, ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কোচ এবং ভাষ্যকার টম মুডি বলেন, ‘এই শিরোপা বাংলাদেশের যুবাদের প্রত্যাশিতই ছিল। তারা প্রথম যেভাবে বোলিং ও ফিল্ডিং করেছে তা এক কথায় দুর্দান্ত ছিল। আমি মুগ্ধ।’

জাতীয় ক্রিকেট দল বেশ কিছু দিন থেকেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করছে। সিনিয়ররা এক পা এগিয়ে যাচ্ছেন, তো আবার পিছিয়ে পড়ছেন অনেকটা। ঘরোয়া লিগে পাতানো ম্যাচের কেলেঙ্কারি। সাকিব আল হাসানের নিষেধাজ্ঞা। জাতীয় দলের হতাশাজনক পারফরম্যান্স - নানা ঘটনায় দেশের ক্রিকেট যখন খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে তখনই উনিশের হাত ধরে বাংলাদেশ করল বিশ্বজয়। নতুন উদ্দীপনায় ধুঁকতে থাকা ক্রিকেট জেগে উঠল। তারুণ্যে এলো ক্রিকেট-বসন্ত!

এই বসন্তকে ধরে রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। সেটা যেমন ক্রিকেটারদের দায়, তেমন অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও। ২০১৬ সালের যুব বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ। তারপর ২০১৯ বিশ্বকাপে কি করল আমাদের সিনিয়ররা? সেই সময়ের তরুণ প্রতীভাধর মিরাজ-মুস্তাফিজরা সঠিক পরিচর্যার অভাবে এখন হারিয়ে যেতে বসেছেন! ক্রিকেট বিশ্লেষকদের দাবি, পুরস্কারে-পুরস্কারে ভাসিয়ে দিয়ে তরুণ ক্রিকেটারদের মাথা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। এবার যেন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়!

এখন সম্পূর্ণ চ্যাম্পিয়ন এক তরুণ-ব্রিগেড পেয়েছে বিসিবি। তবে এই চ্যাম্পিয়ন তরুণদের সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন বানাতে পারে কিনা সেটাই দেখার বিষয়!

সর্বশেষ খবর