বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা

বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের খ্যাতনামা ফুটবলার ছিলেন। রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বের শত ব্যস্ততার মধ্যেও দেশ এবং বিদেশের খেলাধুলার খোঁজখবর রাখতেন তিনি। সময় পেলেই কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের ডেকে দেশের ক্রীড়া উন্নয়নে পরামর্শ নিতেন। বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখা ও কথা বলা- এমন তিন ক্রীড়াব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণা তুলে ধরেছেন- আসিফ ইকবাল

 

বঙ্গবন্ধুর কারণেই আজ আমি ফুটবলার : পিন্টু

১৯৫৭ সালের কথা। সবেমাত্র আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফল প্রকাশ হয়েছে। সেবার পিরোজপুর মঠবাড়িয়া স্কুল মাঠে এক প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, ওই ম্যাচে আমি ছিলাম মঠবাড়িয়া দলের অধিনায়ক। আর প্রতিপক্ষ অফিসার্স ক্লাবে অধিনায়ক ছিলেন আমার বাবা ক্যাপ্টেন ডা. নজিবউদ্দিন আহমেদ। ম্যাচ তখনো শুরু হয়নি, ওই সময়ে শুনলাম শেখ মুজিবুর রহমান (তখনো বঙ্গবন্ধু খেতাব পাননি) এলাকায় এসেছেন। আমি মাঠ ছেড়ে দ্রুত ছুটে গেলাম তার কাছে। আমাকে দেখেই নেতা বললেন, কি ইয়ং বয় কি চাই? আমি বললাম আমাদের একটা ম্যাচ হবে। আপনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। রাজি হয়ে বললেন, চলো তোমাদের ম্যাচ দেখব। আমার বাবাকে তিনি আগে থেকেই চিনতেন, বললেন, ডা. সাহেব আপনার ছেলের নাম কি? বাবা উত্তর দিলেন জাকারিয়া পিন্টু। এরপর বাবা হেসেই বললেন, আমি আর পিন্টু দুই দলের অধিনায়ক। মুজিব ভাই হাসতে হাসতে বললেন, দেখি বাপ-বেটার লড়াইয়ে জিতে কে?

খেলা শুরু হলো, আমার দুই গোলেই মঠবাড়িয়া একাদশ জয়ী হয়। ট্রফি আনতে গিয়ে মুজিব ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তুই তো অসাধারণ খেলিস। তোর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল খেলবি। আমি বলে গেলাম তুই একদিন দেশের নামকরা ফুটবলার হবি। সত্যি বলতে কি আজকের ফুটবলার পিন্টুর হওয়ার পেছনে বড় অবদান বঙ্গবন্ধুর। সে দিনকার তার কথা আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।

১৯৭৩ সালে মারদেকা কাপে খেলতে যাওয়ার আগে জাতীয় দল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে। আমাকে দেখেই বললেন, কিরে পিন্টু বলেছিলাম না তুই বড় খেলোয়াড় হবি। স্বাধীন বাংলাদেশ তোর নেতৃত্বে খেলতে যাচ্ছে। দোয়া করি তোদের জন্য।

 

তুই অধিনায়ক তোর দায়িত্ব অনেক : সালাউদ্দিন

ছোটবেলা থেকেই শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব। দুজনা এক সঙ্গে শাহীন স্কুলে পড়েছি। তাই বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এত বড় নেতা অথচ বঙ্গবন্ধুর চাল-চলন ছিল সাধারণ মানুষের মতো। খুব কাছ থেকে তাকে দেখেছি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও খেলাধুলার খবর রাখতেন। নিজে ফুটবলার ছিলেন বলেই ফুটবলের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। আমার এখনো মনে পড়ে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ। ফুটবল কিভাবে মাঠে গড়াবে এ নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বললেন, অবশ্যই খেলাধুলা হবে। গড়ে ফেললেন ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও কাবাডি ফেডারেশন। সে বছরই ফুটবলে স্বাধীনতা কাপ শুরু হলো। তখনো আমি ঢাকা মোহামেডানে খেলি। সেমিতে বিজেআইসির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক আর ফাইনালে ইস্টএন্ডের বিপক্ষে ২ গোল দিই। ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু মোহামেডানকে অভিনন্দন জানান। আর সেই বছরই আমার গোলে ঢাকা একাদশ এক প্রদর্শনী ম্যাচে কলকাতার বিখ্যাত মোহনবাগান ক্লাবকে হারায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, তোর গোল আমার মনে থাকবে। টিভিতে খেলা দেখলাম। সত্যিই তোরা ভালো খেলেছিস।  ১৯৭৪ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আবাহনী আইএফএ শিল্ডে খেলতে যায়। কোয়ার্টার ফাইনালে জেতার পর শেখ কামাল রুমে এসে বললেন, বাবা ফোন করেছিলেন আমরা যদি চ্যাম্পিয়ন হই বিশেষ প্লেন পাঠিয়ে দেবে। বাবা নিজেই এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করবেন। একজন রাষ্ট্র নায়ক খেলাধুলাকে কতটা ভালোবাসেন এ ঘোষণায় আমরা প্রমাণ পেলাম। যদিও আমরা সেমিতে হেরে যাই। ১৯৭৫ সালে মারদেকা কাপে খেলতে যাওয়ার আগে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। অধিনায়ক ছিলাম বলে আমাকে ডেকে বললেন, তুই ক্যাপ্টেন দায়িত্ব অনেক। দেখবি কেউ যেন ডিসিপ্লিন না ভাঙে। কষ্ট লাগে সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা।

 

হঠাৎ দেখি বঙ্গবন্ধু উপস্থিত : ববি

নামকরা ক্রীড়াবিদ নন। তবু ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে তার ভূমিকা কম নয়। খেলাধুলার প্রতি টান বলে তরুণ বয়স থেকে সংগঠক হিসেবে সেবা করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ উঠতেই আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। বললেন, আমার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে আমাদের বাসা এতটা কাছে যে প্রায় প্রতিদিনই দুই পরিবারের যাওয়া-আসা ছিল। বঙ্গবন্ধু ওয়ান্ডারার্সে ফুটবল খেলেছেন। বাবা খেলোয়াড় না হলেও ছিলেন খেলাপাগল মানুষ। ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে বড় কোনো খেলা থাকলেই বাবাকে দেখা যেত গ্যালারিতে। বঙ্গবন্ধু ও বাবা রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলা নিয়েও আলোচনা করতেন। সত্যি বলতে কি তাদের জন্য আমিও খেলাধুলার প্রতি ঝুঁকে পড়ি। আমার এখনো মনে আছে শেখ কামাল ভাই আবাহনী গড়ার পর আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো খেলাধুলা ভালো বোঝো, তোমাকেও আবাহনীর সঙ্গে জড়িত হতে হবে।’ তারই কথায় আমি আবাহনীর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। সংগঠক হিসেবে যতটুকু পরিচিত হয়েছি তা আবাহনীতে থাকার কারণে। একদিন সন্ধ্যাবেলায় কামাল ভাইয়ের রুমে কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি বঙ্গবন্ধু উপস্থিত। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম পড়াশোনার সময় বলে বকাঝকা করবেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুও মেতে উঠলেন আড্ডায়। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন। ১৯৭২ সালে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রেসিডেন্ট একাদশ ও প্রধানমন্ত্রী একাদশের ম্যাচ হচ্ছে। আবু সাঈদ চৌধুরী ও বঙ্গবন্ধু ভিআইপিতে বসে খেলা দেখছিলেন। আমিও পাশে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু দুই দলের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে যেভাবে চিৎকার দিচ্ছিলেন তা দেখে বুঝলাম খেলাধুলাকে তিনি কতটা ভালোবাসেন।

সর্বশেষ খবর