মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

স্মৃতির আয়না ধরে নড়াচড়া

স্মৃতির আয়না ধরে নড়াচড়া

ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে লাইভে এসে ‘স্মৃতির আয়না ধরে নড়াচড়া’ করে জাতীয় দলের সাবেক তিন অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন ও হাবিবুল বাশার সুমন। তারা এক সঙ্গেই খেলেছেন। তাদের আলোচনাতেই উঠে আসে

বাংলাদেশের ক্রিকেটের আগের কী অবস্থা ছিল। আর এখন কী অবস্থা! এক ঘণ্টার লাইভ অনুষ্ঠানের বিশেষ বিশেষ অংশ তুলে ধরা হলো...

বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট

তামিম : দুর্জয় (নাঈমুর রহমান) ভাই আপনি বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ক্যাপ্টেন। ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে মাঠে নামার আগে টিম মিটিংয়ে কী কথা হয়েছিল?

নাঈমুর রহমান : আমাদের বোলিং এবং ইন্ডিয়ার ব্যাটিং এর মধ্যে অনেক বেশি তফাত ছিল। আমাদের ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও ওটাই প্রথম টেস্ট। সবার ভিতরই একটা প্রশ্ন ছিল কিভাবে টেস্ট খেলতে হয়। একটা চাপ ছিল ওদেরকে কত দ্রুত আউট করতে পারি। পাশাপাশি আমাদের ব্যাটিং নিয়ে বেশি চিন্তা করি। সবাই যাতে দায়িত্বশীলভাবে খেলে। বেশি সময় যাতে ব্যাটিং করতে পারি। যেটা বুলবুল ভাই (আমিনুল ইসলাম) ও সুমন (হাবিবুল বাশার) করেছে।

মুলতান টেস্ট

তামিম : সুজন ভাই, আপনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুলতান টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন। ওই টেস্টে আমরা ভেবেছিলাম জিতব। কিন্তু কি হয়েছিল, ঘটনাটা যদি বলেন?

খালেদ মাহমুদ : ওই টেস্টে জেতার জন্য আমরা খুবই আগ্রাসী ছিলাম। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল না। ওই ম্যাচে আম্পায়ারিংও খুবই বাজে হয়েছিল। একটা আউট নিয়ে রশিদ লতিফ (পাকিস্তানের উইকেটকিপার) বরখাস্ত হয়েছিল। সবাই অসাধারণ খেলেছে। কিন্তু জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষের উইকেটটা আর ফেলতে পারিনি। খুবই দুঃখের একটা ম্যাচ, কষ্টের একটা ম্যাচ।

রেজারের কাহিনি...

তামিম : ১৯৮৯ সালে আপনারা অনূর্ধ্ব-১৯ একটি টুর্নামেন্ট খেলতে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে নাকি মাক-থ্রির মতো একটা রেজার নিয়ে এসেছিলেন। সেটা নাকি বিকেএসপিতে সবাইকে প্রত্যেক দিন ব্যবহার করতে দিতেন?

নাঈমুর রহমান : তখনো আমরা শেভ করি না। কেউ কেউ করতেন। তাই কেউ চাইলে তো আর নিষেধ করতে পারি না (হাসি)।

জাভেদ ওমরের ১২ বছর...

খালেদ মাহমুদ : তখন আমাদের বয়স ছিল ১৮ কিন্তু একজনের বয়স ছিল ১২। জাভেদ ওমর।

নাঈমুর রহমান : ওর ১২ বছর বয়স ছিল, কিন্তু দিনে দুবার শেভ করত।

মুস্তাফিজ আবির্ভাব...

তামিম : মুস্তাফিজকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে আপনার অবদান আছে। সেই কাহিনীটি যদি বলতেন...

খালেদ মাহমুদ : আমি যখন গেম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান হলাম তখন মুস্তাফিজকে প্রথম ক্যাম্পে দেখি। কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহে বলল, কোনো ফাস্ট বোলার আছে কিনা? আমি বললাম, মুস্তাফিজ ও আবু হায়দার রনি। একজনের সুইং ভালো, আরেকজন জোরে বোলিং করতে পারে পাশাপাশি ‘কাটার’। সে বলল কে কাটার? আমি বললাম মুস্তাফিজ। হাতুরা বললো ওকে ডাক। তখন মুস্তাফিজকে সাতক্ষীরা থেকে আসতে বললাম। ওকে কোচ দেখে বলল, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-২০ খেলবে ও। এভাবেই মুস্তাফিজকে আনা।

মিস্টার ফিফটি...

হাবিবুল বাশার : ‘মিস্টার ফিফটি’ তখন শুনতে খুব ভালো লাগত। এখন আর ভালো লাগে না। যদি আরও কিছু একশ হতো অনেক ভালো লাগত। আমার মনে হয় করা উচিত ছিল। কারণ প্রথম ৫০ করা তো কঠিন। আর ওই কঠিন কাজটা খুবই আরামে করতাম, কিন্তু পরের কাজটা আর করতে পারতাম না। সত্যি কথা বলতে কি, তখন ফিফটি করলেই মনে হতো অনেক কিছু করে ফেলেছি।

ক্রিকেটের আগের অবস্থা...

তামিম : আমরা এখন দেশে থাকি বা বিদেশে থাকি না কেন ফাইভ স্টার সুবিধা পাই। আপনার সময় এই সুযোগ সুবিধা কেমন ছিল?

নাঈমুর রহমান : আমরা বিদেশ ট্যুরে প্রথম দিকে ৫-৬ ডলার পেতাম। তা আইসিসি ট্রফির পর ৩০ বা তারও বেশি পেতাম। তাও একটা কিন্তু আইসিসির চাপে। আমাদের যখন বিদেশ ট্যুর থাকত তখন ক্লাবের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতাম পাওনা টাকার জন্য। কারণ বিদেশ ট্যুরে পকেট মানি লাগবে। নিজের টাকাই খরচ করতে হবে। বিদেশে আমরা ফাস্ট ফুড খেতাম। তখন খেলার প্রতি প্যাশন অনেক বেশি ছিল, এখনকার চেয়েও।

‘তামিম, তোমরা তো অনেক ধরনের এনার্জি ড্রিং নষ্ট কর। আমাদের সময় এনার্জি ড্রিংয়ের গল্প শোন, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের মোটামুটি পরিষ্কার একটা বাথরুম ছিল। সেখান থেকে পানি আনত। বাজার থেকে লেবু আর চিনি আনত। এই দুটা হাত দিয়ে গুলিয়ে নিত। লবণ দিত না। কারণ হাতের ঘামে তো লবণের কাজ হয়ে যেত। আমাদের পেটও খারাপ হতো না।’

দলবদল নাটক...

নাঈমুর রহমান : তখন দলবদল নিয়ে কত নাটক হতো! আকরাম ভাই, নান্নু ভাই এদেরকে কিডনাপ করা হতো। সুমন কিডনাপ হতো। আমি থাকতাম মোহামেডানের আখড়ায়। আমার মামা  (গোলাম সারওয়ার টিপু) মোহামেডানের কোচ ছিল। আমি তাদের বাসায় থাকি। কিন্তু আবাহনী আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কামাল ভাইয়ের (অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল) অফিসে নিয়ে গিয়ে দলবদলের টাইমটা পার করে দিল। তারপর আমি তো আর বাসায় ঢুকতে পারি না। ৩ দিন বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে বাসায় যখন ঠান্ডা হয়েছে তখন ঢুকেছি। তখন খেলা নিয়ে আবেগ অনেক বেশি ছিল।

পেটে বালিশ...

হাবিবুল বাশার : প্রথম দিকে অনেক কষ্ট হতো। মফস্বল শহর থেকে এসেছি। ভাড়া বাসায় থাকতাম। টেম্পুতে করে প্রাকটিসে যেতাম। মনে আছে এখন, টেম্পুর ভাড়া ছিল ১ টাকা। প্রথম নিউজিল্যান্ড ট্যুরে প্রতিদিন ৭-৮ ডলার পেতাম। ওটা দিয়ে ভাত খাওয়া যেত না। ফাস্ট ফুড খেয়ে পার করে দিতাম। ভাত খাওয়ার টাকা ছিল না। তখন আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল, খিদা লাগলে পেটে বালিশ দিয়ে থাকতে।

খালেদ মাহমুদ : একটা সত্যি কথা বলতেই হয়। তখন বাঙালিরা কেউ দাওয়াত দিলে খুবই খুশি হতাম। কারণ একবেলা ভাত খেতে পারতাম, আবার পয়সা বাঁচতো।

ওয়াসিম আকরামের ছোটু ...

খালেদ মাহমুদ : আমাদের একজন পেস বোলিং কোচ ছিলেন। তিনি বলছিলেন চোখ গরম করতে। আমি ওয়াসিম আকরামের বিরুদ্ধে বোলিং করে চোখ গরম করেছিলাম। তখন সে আমাকে গালি দেয়। তারপর আবার যখন চোখ গরম করি তখন আকরাম ভাইকে বিচার দিয়েছিল। তারপর পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকায় খেলা, এশিয়া কাপ। ব্যাটিং অর্ডারে দুর্জয়, আমি, পাইলট তো পর পর যেতাম। আমি তাড়াতাড়ি আউট হয়ে গেছি। পরে পাইলট যখন ব্যাট করছিল তখন ওয়াসিম আকরাম বল করতে এসে জিজ্ঞেস করছিল ‘এ তেরা ছোটু কাভা, ও নেহী খেলরা?’ বলছে ও তো আউট হয়ে গেছে। ওয়াসিম বলছিল, ওকে তো আউট করা প্লান ছিল, ওর গায়ে বল মারতাম।

চিতার মতো ফিল্ডিং

তামিম : সুমন ভাইয়ের একটা ডাকনাম ছিল চিতা। ২০০৭ সালের বিশকাপে শুনেছি, ওনাকে বলা হতো চিতার মতো ফিল্ডিং করেন। আপনি নিজেই নিজেকে কেন চিতা বলতেন?

হাবিবুল বাশার : কারণ আমি নিজেই নিজে অনুপ্রেরণা দিতাম। কারণ তখন দলে সবাই তরুণ ক্রিকেটার, সবাই ভালো ফিল্ডার। আমি ছিলাম স্লো। তাই ক্যাচ ধরলে নিজেকে বলতাম চিতা, চিতা (হাসি)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর