বৃহস্পতিবার, ২১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

রান আউটটি করলে তিরস্কৃত হতাম

ক্রীড়া প্রতিবেদক

রান আউটটি করলে তিরস্কৃত হতাম

ক্রিকেট পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে। হারিয়েছে ‘দ্বীপরাস্ট্র’ শ্রীলঙ্কাকেও। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এমন আনন্দ, উৎসবে মেতে উঠার বহু গল্প রয়েছে বাংলাদেশের। একই সঙ্গে রয়েছে দুঃখ গাঁথা। রয়েছে আক্ষেপের গল্প। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের চির আক্ষেপের গল্প ‘মুলতান টেস্ট’। ২০০৩ সালে মুলতানে খালেদ মাহমুদ সুজন, মোহাম্মদ রফিক, হাবিবুল বাশাররা যেভাবে লড়াই করেছিলেন ইনজামাম উল হক, সালমান বাট, উমর গুলদের বিপক্ষে, সেই স্মৃতি ভাবলে এখনো শিহরিত হতে হয়। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয় ২০০৫ সালে। অথচ ভাগ্য সহায় থাকলে, রফিক ‘ম্যান কাড’ আউট বা রান আউটটি করলে কিংবা রশিদ লতিফ প্রতারণা না করলে, অথবা আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা বাজে সিদ্ধান্ত না দিলে ২০০৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বরই লেখা হতো নতুন ইতিহাস। সেদিনই প্রথম টেস্ট জয়ের উদ্বাহু আনন্দে মেতে উঠত বাংলাদেশ। কিন্তু রশিদের প্রতারণা, ইনজামাম উল হকের অতিমানবীয় ১৩৮ রানের ইনিংস, অশোকার একচোখা আম্পায়ারিং এবং সর্বোপরি রফিকের স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের জন্য উৎসব ও উচ্ছ্বাসে মেতে উঠা হয়নি টাইগারদের। বরং মুলতান টেস্টটি হতাশার, কষ্টের, বেদনার, চির আক্ষেপের গল্প হয়ে আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।

টেস্ট জিততে পাকিস্তানের টার্গেট ছিল ২৬১ রান। অধিনায়ক সুজন, মঞ্জরুল ইসলাম এবং রফিক ত্রিমুখী আক্রমণে ২০৫ রানে ৮ উইকেট জয়োৎসবের মঞ্চ তৈরি করে নেন। কিন্তু সেই উৎসবে পানি ঢেলে দেন ইনজামাম দুই টেল এন্ডার উমর ও ইয়াসির আলিকে নিয়ে। নবম উইকেট জুটিতে ইনজামাম ও উমর যখন ব্যাটিং করছেন, তখনই সুযোগটি পেয়েছিলেন রফিক। আকাশসম চাপের মুখে রান নিতে উইকেট থেকে বেশ কয়েক কদম বাইরে চলে আসেন গুল। বোলার রফিকের সুযোগ ছিল গুলকে রান আউট করার। কিন্তু রফিক আউট করেননি। ক্রিজে ফিরে যান গুল এবং ইনজামামের সঙ্গে নবম উইকেট জুটিতে যোগ করেন  ৫২ রান। এই জুটিতে ভর করেই খাঁদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান তুলে নেয় ১ উইকেটের অবিশ্বাস্য জয়। ১৭ বছর আগে রান আউটের সুযোগ পেয়েও সেটা কাজে লাগাননি রফিক। কেন রান আউট করেননি, সেটা জানতে চাইলে রফিক বলেন, ‘ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম আউট হলো এই ধরনের রান আউট। সেদিন যদি রান আউটটি করতাম, আমরা হয়তো ম্যাচটি জিততাম। কিন্তু লোকে আমাকে আজীবন ঘৃণা করত।’ বন্ধু বৎসল রফিক সেই আউট করতে রাজি হননি। অধিনায়ক সুজনও মেনে নিয়েছিলেন রফিকের সিদ্ধান্ত।

মুলতানে রফিক রান আউটের সুযোগ পেয়েও হেলায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ অলক কাপালির ক্যাচ মাটি থেকে ধরেও আউটের আবেদন করেন পাকিস্তানি অধিনায়ক রশিদ লতিফ। তার আবেদনে সাড়াও দেন শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার অশোকা। রফিক রান আউট করলে, রশিদ প্রতারণা না করলে এবং অশোকা বাজে সিদ্ধান্ত না দিলে, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

১৭ বছর আগে মুলতানে নামার আগে সিরিজের দুটি টেস্টই হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মুলতানে বাংলাদেশ খেলেছিল আত্মবিশ্বাসী ক্রিকেট। প্রথমে ব্যাট করে বাশারের ৭২, রাজিন সালেহ’র ৪৯, জাভেদ ওমরের ৩৮ রানে ভর করে বাংলাদেশ ২৮১ রান করে। রফিক ও সুজনের দুরন্ত বোলিংয়ে ১৭৫ রানে গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। রফিক ৫টি ও খালেদ মাহমুদ ৪ উইকেট নেন। ১০৬ রানে এগিয়ে থাকার সুবিধা দ্বিতীয় ইনিংসে নিতে ব্যর্থ হয় টাইগাররা। গুঁড়িয়ে যায় মাত্র ১৫৪ রানে। স্বাগতিকদের টার্গেট দেয় ২৬১ রানে। পাহাড়সম টার্গেট না হলেও দুরন্ত লড়াই করে মাহমুদ বাহিনী। সুজন ও মঞ্জুর সাঁড়াশি আক্রমণে এক পর্যায়ে ৯৯ রান তুলতেই স্বাগতিকরা হারিয়ে বসে ৫ উইকেট। সেখান থেকে ‘মুলতানের সুলতান’ ইনজামাম তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ব্যাটিং করে পাকিস্তানকে উপহার দেন ১ উইকেটের জয়। কিন্তু ম্যাচটি জেতা উচিত ছিল বাংলাদেশের। তেমনটাই মনে করেন রফিক, ‘এতদিন পর এসব কষ্টের কথা মনে করে কি লাভ? ম্যাচটি জিততে পারতাম। জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ায় শুধু আমি নই, গোটা দল কষ্ট পেয়েছিল। মাঠে আমরা কেঁদেছিলাম।’

জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন খালেদ মাহমুদ। বেদনায় নীল হয়ে পড়েছিলেন বাশার, রফিক, পাইলটরা। ১৭ বছর আগের ম্যাচটি ভুলে যেতে চান ক্রিকেটাররা। কিন্তু ভুলতে পারছেন না অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন, ‘জীবনে অনেক ম্যাচ হেরেছি। কিন্তু মুলতান টেস্টের হারটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’

ট্র্যাজিক মুলতান টেস্ট

বাংলাদেশ : প্রথম ইনিংস, ২৮১ (হাবিবুল বাশার ৭২, রাজিন সালেহ ৪৯, জাভেদ ওমর ৩৮) ও দ্বিতীয় ইনিংস, ১৫৪ (রাজিন সালেহ ৪২, খালেদ মাহমুদ ৩৮)।

পাকিস্তান : প্রথম ইনিংস, ১৭৫  মোহাম্মদ রফিক ৫/৩৬, খালেদ মাহমুদ ৪/৩৭ ও দ্বিতীয় ইনিংস, ২৬২/৯ (ইনজামাম উল হক ১৩৮*। খালেদ মাহমুদ ৩/৬৮, মোহাম্মদ রফিক ২/৮০)।

সর্বশেষ খবর