শনিবার, ৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

স্বপ্নবাজ আর্চারের ছুটে চলা

মেজবাহ্-উল-হক

স্বপ্নবাজ আর্চারের ছুটে চলা

দৃঢ় মনোবল, কঠোর পরিশ্রম, আর লক্ষ্য অটুট থাকলে যে কোনো কিছুই অসম্ভব নয় তার বাস্তব উদাহরণ ইংল্যান্ডের তারকা পেসার জোফরা আর্চার।

হালকা পাতলা গড়নের যে ছেলেটি ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে তিনটি ম্যাচ খেলেই বাদ পড়েছিলেন, সেই ছেলেটি এখন ইংল্যান্ড ক্রিকেট

দলের প্রধান বোলার। ইংল্যান্ডকে স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দেওয়ার নেপথ্য নায়কও এই আর্চার।

তবে ক্রিকেট দুনিয়ার তারকা আজকের এই আর্চার হওয়ার পেছনের গল্পটা অন্যরকম। ক্যারিবীয় বয়সভিত্তিক দল থেকে বাদ পড়ার পর ক্ষোভে আর্চার সিদ্ধান্ত নিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আর নয়, খেলবেন ইংল্যান্ডের হয়ে। যেভাবেই হোক তাকে বড় ক্রিকেটার হতেই হবে!

জোফরা আর্চারের বাবা ফ্র্যাঙ্ক আর্চারের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আছে। এটাই প্লাস পয়েন্ট। তাই আগেপিছে কিছু না ভেবে ‘আপাতত’ জন্মভূমির মায়া জলাঞ্জলি দিয়ে ২০১৫ সালে বার্বাডোজ থেকে পাড়ি জমান আর্চার ইংল্যান্ডে।

তারপর শুরু নতুন যুদ্ধ। অবশ্য এক বছরের মধ্যেই কাউন্টিতে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। ৮ জুলাই, ২০১৬ সালে সাসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম ম্যাচ থেকেই বাইশগজে নিজেকে আলাদা করে চেনাতে থাকেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বয়সভিত্তিক দল থেকে বাদ পড়ার ক্ষোভটা মেটান ইংলিশ কাউন্টিতে পেস বোলিংয়ে ঝড় তুলে।

২০১৮ সালের আইপিএল হৈচৈ ফেলে দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে আর্চারকে দলে ভেড়ায় রাজস্থান রয়্যালস। একই বছর ২ আগস্ট কাউন্টিতে ‘টি-২০ ব্লাস্টে’ হ্যাটট্রিক করে ইসিবির নির্বাচকদের দৃষ্টি কেড়ে নেন।

আর্চার শুধু ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন নিয়েই সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়েছেন, ইসিবির নির্বাচকরাও তাকে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু মাঝখানে বাদ সাধে ইসিবির আইন। অন্তত সাত বছর ইংল্যান্ডে বসবাস না করলে কেউ জাতীয় দলে খেলতে পারবে না। তার মানে ২০২২ সালের আগে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার কোনো সম্ভাবনা নেই আর্চারের! কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুখবর পান তিনি। আইসিসিকে জানিয়ে আইন বদলায় ইসিবি- সাত বছর কমে আসে তিন বছরে।

সব ঠিকঠাক। ইংলিশ ক্রিকেটপ্রেমীরা জানেন, বিশ্বকাপেই অভিষেক হচ্ছে আর্চারের। কিন্তু কী যেন এক অদ্ভুত কারণে ২০১৯ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ডের প্রথম স্কোয়াডে জায়গা হয় না আর্চারের।

তারপর তো রীতিমতো আন্দোলনের

অবস্থা সৃষ্টি হয়। পরে বাধ্য হয়েই আর্চারকে দলে নেয় ইসিবি। সেই আর্চারই কিনা ইংল্যান্ডকে স্বপ্নের বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দিতে রাখলেন বড় ভূমিকা।

সাদা পোশাকে ইংল্যান্ডের হয়ে আর্চারের অভিষেক মর্যাদার অ্যাশেজ সিরিজে। সেখানেও চলে তার পেস ক্যারিশমা। চলতি বছরের এপ্রিলে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের তালিকায় জায়গা পেয়ে বিরল সম্মানে ভূষিত হন আর্চার।

এবার আর্চারের মিশনটা অন্যরকম। টেস্ট সিরিজে খেলতে হবে জন্মভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। নিজের দায়িত্ববোধের প্রতি আস্থা রেখে আবেগ দূরে ঠেলে দিয়ে কীভাবে জন্মভূমির বিরুদ্ধেও ভালো করতে হয় সে পাঠটা হয়তো সতীর্থ বেন স্টোকসের কাছেই নিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই ইংলিশ ক্রিকেটারই যে ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছেন!

আর সে কারণেই হয়তো ‘ঘরের ছেলে’ আর্চারকে ক্যারিবীয়দের মনে হচ্ছে ‘বড় শত্রু’! তা ছাড়া ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা খুব ভালো করেই জানেন আর্চারের সামর্থ্য সম্পর্কে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে যে দাঁড়াতেই পারেনি তার পেছনে এক্স-ফেক্টর কিন্তু এই আর্চারই। একাই ৩ উইকেট নিয়েছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেটিই ছিল একমাত্র ম্যাচ। এবার সাদা পোশাকে জন্মভূমির বিরুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ইংল্যান্ডের হয়ে খেললেও আর্চারের মন পড়ে থাকে বার্বাডোজে। সময় পেলেই ছুটে যান স্মৃতির শহর ব্রিজটাউনে। সেখানকার অলিগলিতে কত্তো স্মৃতি। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন। মায়ের আঁচলতলে শান্তি খোঁজেন। ব্রিজটাউন

যেন আর্চারের অক্সিজেন। সেখানে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আবার ছুটে আসেন ইংল্যান্ডে। প্রিয় ইংলিশ জার্সিতে ক্রিকেট নিয়ে মেতে ওঠেন। এভাবেই চলছে স্বপ্নবাজ আর্চারের জীবন।

সর্বশেষ খবর