সোমবার, ৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

কোথায় বিমান কোথায় বিজেএমসি

ক্রীড়া প্রতিবেদক

কোথায় বিমান কোথায় বিজেএমসি

আশির দশক পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গনে অফিস দলের কমতি ছিল না। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, দাবা কিংবা সাইক্লিংয়ে তাদের দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। কালের বিবর্তনে ক্রীড়াঙ্গন থেকে অফিস দল হারিয়ে যাচ্ছে। ওয়াপদা, পিডব্লিউডি, সাধারণ বীমা, ফায়ার সার্ভিস, বিটিএমসি, বিজি প্রেসের নাম ক্রীড়াঙ্গন থেকে মুছে গেছে বলা যায়। জনপ্রিয় বিমান বাংলাদেশ খেলা থেকে সরে গেছে অনেক আগেই। এবার বিদায় নিল বিজেএমসি। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলোর উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করেছে সরকার। স্বাভাবিকভাবে ক্রীড়াঙ্গনে আর দেখা মিলবে না জনপ্রিয় বিজেএমসির। ওয়াপদা বা পিডব্লিউডির পরিচিত কম ছিল না। ১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে ওয়াপদার অভিষেক হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানকে হারিয়ে। নওশের, শরীফ, সুনিল অনেক ফুটবলারই তারকাখ্যাতি পেয়েছে এ দল থেকেই। ৬০ বা ৭০ দশকে ভলিবলে ওয়াপদা ছিল তুলনাহীন।

পিডব্লিউডি ফুটবল, হকি ও ক্রিকেটের মতো বড় তিন খেলাতেই অংশ নিত। কিংবদন্তি ক্রিকেটার জহির আব্বাস ঢাকা লিগে এই দলকে নেতৃত্ব দেন। দেশের অসংখ্য প্রতিভাবান খেলোয়াড় তৈরি করেছে তারা। সাধারণ বীমা হকিতে টানা দুবার শিরোপাও জিতেছে। ফুটবল ও ক্রিকেটে মাঝারি মানের দল ছিল। তবে অফিস দলের জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের কারণে বিমান ও বিজেএমসির নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কি ছিল না বিজেএমসির। পূর্ব পাকিস্তান আমলে নাম ছিল ইপিআইডিসি। ১৯৬৪ সালে ফুটবল লিগে তাদের অভিষেক। ১৯৬৭ ও ৬৮ টানা দুই মৌসুমে তারা লিগ চ্যাম্পিয়ন। এরপর আবার ৭০ সালে হারানো শিরোপা উদ্ধার। সে সময় পাকিস্তান স্বাধীনতা কাপে আটবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডও আছে তাদের।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রথম ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়নের কৃতিত্ব নাম বদল করা বিজেআইসির। এরপর আবার বিজেএমসি হিসেবে তারা শেষ শিরোপা জিতে ১৯৭৯ সালে। আবাহনীর আগমনের আগে ফুটবলে মোহামেডানের সঙ্গে শিরোপা ভাগাভাগি হতো তাদের। অফিস দল হলেও ক্রীড়াঙ্গনে বিজেএমসির জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। পূর্ব পাকিস্তান আমলে নাম করা মাকরানি ফুটবলার জব্বার, মওলাবক্স, আইয়ুবদার, আমেরবক্স, গফুর বেলুচ, আলী আকবর ও আলি নেওয়াজ তৎকালীন ইপিআইডিসিতে খেলেন। স্থানীয় তারকা ফুটবলারদের মধ্যে সলিমুল্লাহ, ছোট নাজির, এনায়েতুর রহমান এনায়েত, গোবিন্দ, ফারুক, ওয়াজেদ গাজী, বড় গাজি ও মাওলারা দীর্ঘদিন বিজেএমসির জার্সি গায়ে চড়িয়ে মাঠে নেমেছেন। দেশসেরা দুই স্ট্রাইকার সালাম মুর্শেদী ও শেখ মো. আসলামের এই দলে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

ফুটবলে সাফল্য দেখে পূর্ব পাকিস্তান আমলেই অ্যাথলেটিকস্ ও সাঁতারে দল গড়ে বিজেএমসি (তৎকালীন ইপিআইডিসি)। শুরু থেকেই ঈর্ষণীয় সাফল্য আসে দুই ডিসিপ্লিন থেকে। তখনকার সময় অ্যাথলেটিকস্ জাতীয় আসর মানেই বিজেএমসি চ্যাম্পিয়ন। স্বাধীনতার পরও তা ধরে রেখেছিল। মজিবর রহমান মল্লিক, মিলজার হোসেন, শাহ আলম, জোৎস্না আফরোজা, নেলী জেসমিন, লাভলী সুলতানা ও নাজমুন নাহার বিউটিদের মতো দেশখ্যাত অ্যাথলেটরা বিজেএমসিতে খেলেছেন।

এত সাফল্য এত নাম অথচ সেই বিজেএমসি ক্রীড়াঙ্গন থেকে হারিয়ে গেল। সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে চাকরি হারালেন ৩৬৫ জন ক্রীড়াবিদ।

এত গেল বিজেএমসির কষ্টের কাহিনী। ক্রীড়াঙ্গনে বিমান বাংলাদেশের দাপট ছিল তুঙ্গে। লোকসানের কারণ দেখিয়ে ক্রীড়াঙ্গন থেকে সরে দাঁড়ায় অনেক আগেই। ক্রিকেট, দাবা, টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টনে তারা শিরোপা জিতেছে অসংখ্যবার। মোহামেডান-আবাহনীর দাপট ভেঙে যায় ক্রিকেটে বিমানের অভিষেকের পর। ১৯৭৯ সালে ক্রিকেট তারা শুরুটা করেছিল দামাল-সামার চ্যাম্পিয়ন হয়ে। কতই না দেশসেরা ক্রিকেটার খেলে গেছেন এই দলে। ইউসুফ বাবু, জাহাঙ্গীর শাহ্ বাদশা, নাজিম সিরাজি, নেহাল হাসনাইন, এনামুল হক মনি, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সানোয়ার হোসেন, ফারুক আহমেদ, বাচ্চু, সদরুল, উইকেটরক্ষক সানি ও ফয়সাল, সানু বলে নাম শেষ করা যাবে না। সেই বিমানে ডানা ভেঙে যাবে তা কি ভাবা যায়? দাবায় গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, রাণী হামিদ, জিয়াউর রহমান। টেবিল টেনিসে, মুন্সীনুর, আমজাদ, সাইদুল হক সাদী, মওলা, শামিম, আকবর, নাসিমুল হাসান কচি, রচি, সুমিত, জোবেরা রহমান লিনু, জুলেখা। ব্যাডমিন্টনে কামরুল নাহার ডানা, মরিয়ম তারেক, মুন্নি, উর্মি, জুথি, হাসেম, বাবলু জিলানি, রানা ও কচিদের মতো তারকারা বিমানে খেলেছেন। বিমানে নামকরা খেলোয়াড়দের যোগ দেওয়ার প্রধান কারণ ছিল পারিশ্রমিকের নিশ্চয়তা। তারপর আবার চাকরিও মিলত। দাপটেই উড়ছিল বিমান। সেই খ্যাতনামা দল আজ কোথায়। সাঁতারু মোশাররফ হোসেনের তারকার খ্যাতি আসে বিটিএমসি থেকে, সেই দলও বিলুপ্ত। ক্রীড়াঙ্গনে অফিস দলের সত্যিই বেহাল দশা।

সর্বশেষ খবর