সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

কিংবদন্তি ফুটবলার বাদল রায় আর নেই

মনোয়ার হক

কিংবদন্তি ফুটবলার বাদল রায় আর নেই

আগের দুই মৌসুমে প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে চ্যাম্পিয়ন হয় ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান। অথচ পরের বছর ১৯৭৭ সালে লিগে তারা ছিল পুরোপুরি ফ্লপ। সাত নম্বরে থেকে মোহামেডানকে লিগ শেষ করতে হয়। সে বছরই আগাখান গোল্ডকাপে মোহামেডান অংশ নিয়েছিল। অনেক তারকা ফুটবলার ইনজুরির দোহাই দিয়ে টুর্নামেন্ট খেলতে নামেননি। একাদশ গড়তেই হিমশিম খাচ্ছিল দল। কর্মকর্তারা কুমিল্লা থেকে নিয়ে আসলেন বাদল রায় ও রংপুর থেকে মোসাব্বেরকে। একে তো বয়স কম তারপর আবার একেবারে অচেনা ফুটবলার। এরা সাদা-কালোর জার্সির ভার সামলে আগাখান গোল্ডকাপে খেলবে কীভাবে এটাই বড় চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় সমর্থকদের।

এরাই কিনা মন জয় করল ভক্তদের। ভারতীয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া অল ইন্ডিয়া ফুটবল টিমকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেশে আলোড়ন তুলল মোহামেডান। পরের বছর ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান দলে নিয়মিত হয়ে গেলেন এ দুই ফুটবলার। ১৯৮১ সালে ফেডারেশন কাপে ইনজুরি হয়ে ফুটবলার মোসাব্বেরের ক্যারিয়ারই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাদল রায় তার পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে দেশের তারকা ফুটবলার বনে যান। বাদল রায় এক ব্যতিক্রমী ফুটবলার। দীর্ঘ একযুগ শুধুমাত্র মোহামেডানে খেলেই তিনি ক্যারিয়ারে ইতি টেনেছেন। আবাহনী, ব্রাদার্স বা বিজেএমসির লোভনীয় অফার তাকে সাদা-কালো থেকে সরাতে পারেনি। তাই তো ক্রীড়াঙ্গনে তার বড় পরিচয় মোহামেডানের ঘরের ছেলে বলে।

এই কিংবদন্তি ফুটবলার আর নেই। গতকাল সবাইকে কাঁদিয়ে প্রিয় বাদল রায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে।  গতকাল বিকালে বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

৫ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে আজগর আলী হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ বাদল রায়। সেখান থেকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে তার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে। মাঠে দক্ষতার সঙ্গে লড়লেও শেষ পর্যন্ত কিংবদন্তি এ ফুটবলার শেষ লড়াইয়ে না পেরে চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। স্ত্রী মাধুরী রায়,  ১ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে যান বাদল রায়।

২০১৭ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে বাদল রায়ের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। সুস্থ হয়েই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু এ শরীর নিয়েও ফুটবলকে সময় দিতে থাকেন। তার কথা ফুটবল আমার সবকিছু। যতদিন বাঁচব তার পাশেই থাকব। কিন্তু যে লোক ফুটবলকে এতটা ভালোবেসেছিলেন। তার কি সেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। গেল বাফুফে নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার পর তাকে ঘিরে কতই না ষড়যন্ত্র হয়েছে। অনেকের ধারণা এমন মানসিক চাপেই বাদল রায় পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সব ভয়কে দূর করে শেষ পর্যন্ত তিনি ঠিকই নির্বাচন করেন। ভোটে জেতেননি কিন্তু ফুটবলের প্রতি তার ভালোবাসা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছিল।

বাদল রায় মোহামেডানে ক্যারিয়ার শুরু করেন ৭ নম্বর জার্সি দিয়ে। ১৯৭৮ সালে তার অভিষেক লিগে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত দুটো গোলও রয়েছে। ১৯৭৯ সালে লিগের প্রথম ম্যাচে ধানমন্ডির বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ ৪ গোল দিয়ে দর্শকদের প্রশংসা পান। মোহামেডানে খেলে তিনি ৬ বার লিগ, ৬ বার ফেডারেশন কাপে শিরোপা জেতেন। তার নেতৃত্বে ভারতে আশীষ জব্বর স্মৃতি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ১৯৮১ সালে ১০ নম্বর জার্সি পরেই ঐতিহ্যবাহী দলকে নেতৃত্ব দেন। উপহার দেন ফেডারেশন কাপ ট্রফি। ১৯৮২ সালে সতীর্থ সালাম মুর্শেদীর রেকর্ড গড়া ২৭ গোলের পেছনে বাদলের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঢাকার মাঠে বাদল, সালাম ও গাফফার ত্রি-রতেœর খ্যাতি পেয়েছিলেন।

টানা তিনবার ব্যর্থতার পর ১৯৮৬ সালে মোহামেডান লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় বাদল রায়ের নেতৃত্বে। সেবার প্রথম পর্বে আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে বাদল রায় শার্ট-প্যান্ট পরে জ্বর নিয়ে সাইড লাইনে বসেছিলেন। খেলা তখন মিনিট তিনেক বাকি, ড্র করলেই প্রথমপর্বে আবাহনী শীর্ষে থাকবে। বাদল রায় বদলি হিসেবে মাঠে নামলেন। নেমেই অসাধারণ গোল করে মোহামেডানকে জেতালেন। কত মধুর স্মৃতিই না বাদলকে ঘিরে। একবার আবাহনী তাকে বলেছিল চেক দিলাম তোমার খুশি মতো টাকার পরিমাণ বসিয়ে দাও। বাদল রায় তাতে সাড়া দেননি। বলেছিলেন, মোহামেডানই আমার সব।

জাতীয় দলে ইনজুরির কারণে বেশিদিন খেলতে পারেননি। তবু ১৯৮২ এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল বাদলের গোলে। সংগঠক হিসেবেও বাদল খ্যাতি অর্জন করেছেন। বাফুফের যুগ্ম-সম্পাদক ও তিনবার সহ-সভাপতি ছিলেন। ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীও হন বাদল রায়। কোনোদিন কোচের দায়িত্ব পালন করেননি। তবু কায়সার হামিদ, কানন ও সাব্বির বললেন, আমাদের পরিচিত হওয়ার পেছনে মূল অবদান ছিল বাদল রায়ের। তার মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। শুধু মোহামেডান নয় ফুটবল হারালো এক যোগ্য কারিগরকে। বাদলের মরদেহ আজ তার প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে আনা হবে। এরপর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম এবং শহীদ মিনারে নেওয়া হবে।

 

ও ছিল ফুটবলের প্রাণ

কাজী সালাউদ্দিন

বাদল রায়ের সঙ্গে এক ক্লাবে খেলিনি। তবুও ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল মধুর। তার মৃত্যুতে ক্রীড়াঙ্গনের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। অসাধারণ খেলত।

এমন ঠান্ডা মেজাজি খেলোয়াড় দেখিনি। ফুটবলের প্রতি ওর ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাফুফের সভাপতি হওয়ার পেছনে ওর অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে। সত্যি বলতে কি ফুটবলের প্রাণ ছিল বাদল রায়।

 

 

 

সম্পর্ক ছিল ভাইয়ের মতো

সালাম মুর্শেদী

১৯৮০ সালে মোহামেডানে যোগ দিয়েই বাদল রায়কে পেয়েছি। মিষ্টি হাসি দিয়ে সবাইকে আপন করে নিতেন। ওর মনে শুধু  বন্ধুত্ব নয়। সম্পর্কটা ছিল ভাইয়ের মতো। একজন যোগ্য ফুটবলার, যোগ্য অধিনায়ক ও যোগ্য সংগঠক। ফুটবলে বড় এক সম্পদকে হারালাম।

আমার খ্যাতির পেছনে বাদল রায়ের বড় অবদান রয়েছে। ঠান্ডা মেজাজে ফুটবল খেলা যায় তার বড় উদাহরণ তিনি।

 

 

 

বিশ্বাসই হচ্ছে না

আবদুল গাফফার

টানা তিন বছর আমি ও বাদল রায় মোহামেডানে খেলেছি। আবাহনীতে যোগ দেওয়ার পরও সম্পর্ক অটল ছিল।  শুধু যোগ্য ফুটবলার নয়, মানুষ হিসেবেও বাদল ছিল অতুলনীয়। কখনো তাকে রাগতে দেখিনি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, বন্ধু বাদল বেঁচে নেই। ওর সঙ্গে কতো সুখ-দুখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। একবার তাকে বললাম, দোস্ত আবাহনীতে চলে আয়। এমনভাবে অট্টহাসি দিল মনে হলো আমি যেন ভুল করেছি। মোহামেডানকে ও ভীষণ ভালোবাসত।

সর্বশেষ খবর