সোমবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

৫০ বছরে ৫ সুপারস্টার

৫০ বছরে ৫ সুপারস্টার

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনেক তারকা খেলোয়াড়ই সৃষ্টি হয়েছে। একক বা দলগতভাবে সাফল্যও পেয়েছেন। দেশকে এনে দিয়েছেন সুনাম। তবে এমন ক’জন সুপারস্টার আছেন যাদের নৈপুণ্য ও জনপ্রিয়তা ক্রীড়ামোদীদের হৃদয়ে গাঁথা হয়ে আছে। আবদুস সাদেক, কাজী সালাউদ্দিন, নিয়াজ মোর্শেদ, সাকিব আল হাসান ও জোবেরা রহমান লিনু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গত ৫০ বছরে নিজ নিজ খেলায় তারা নিজেদের সেরা প্রমাণ করেছেন। এ নিয়ে মনোয়ার হকের প্রতিবেদন-

 

বাংলাদেশের ৫০ বছরে বড় তিন খেলার মধ্যে হকি অন্যতম। এক সময়ে ফুটবলের পর হকির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ৫০ বছরে হকিতে দেশ বা আন্তর্জাতিক আসরে মাতানো অনেক খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটেছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা এশিয়ান একাদশেও সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু মেধা, ক্যারিশমা, দাপট, আচরণ ও নেতৃত্ব গুণেই আবদুস সাদেককেই ৫০ বছরে হকির সেরা খেলোয়াড় বলা যায়। প্রথিতযশা সাংবাদিক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘সাদেক ভাই এমন এক ব্যক্তি তিনি যে কত গুণের অধিকারী তা বলে শেষ করা যাবে না। ফুটবলেও তিনি দাপটের স্বাক্ষর রেখেছেন। তারপরও আমি সাদেক ভাইকে হকির লোকই বলব। বলতে পারেন দেশের হকির বাতিঘর জীবন্ত এ কিংবদন্তি।

বাংলাদেশ তো কখনো হকিতে বড় ট্রফি জেতেনি। কিন্তু এ খেলার জনপ্রিয়তার পেছনে সাদেক ভাইয়ের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে সবাই স্মরণ করবেন।’ মঞ্জু বলেন, ‘ষাট দশক থেকে তার ক্যারিয়ারের প্রায় প্রতিটি খেলা আমি দেখেছি। ঘরোয়া বা আন্তর্জাতিক আসরে তার মতো পরিশ্রমী খেলোয়াড় আমার চোখে পড়েনি। একজন কমপ্লিট খেলোয়াড় বলতে যা বুঝায় তা আমি দেখেছি সাদেক ভাইয়ের মধ্যে।’

জাতীয় দল ও আবাহনীর মতো জনপ্রিয় দলের প্রথম অধিনায়ক সাদেক ভাই। ৫০ বছর তো দীর্ঘ সময়ের কথা। উনি আশির দশক পর্যন্ত খেলেছেন। এই সময়ের মধ্যেও তাঁর স্টিক ওয়ার্ক,  নৈপুণ্য ও ডিসিপ্লিন কারোর মধ্যে দেখিনি।’

 যদিও বিষয়টি ৫০ বছরের আগের। তারপরও না বলে পারছি না পাকিস্তান যখন আমাদের খেলোয়াড়দের অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল, তখন সাদেক ভাই পাকিস্তানের দলে দাপটের সঙ্গে খেলে বুঝিয়ে দিয়েছেন বাঙালিরাও পারেন।’

সাদেক ও বাংলাদেশের হকি একই সূত্রে গাঁথা। কোচ ও সাংগঠনিক ক্যারিয়ারে তিনি সফল। হকির দুঃসময়ে তাঁকে কাছে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ এশিয়া কাপ হকি হবে তা ছিল স্বপ্ন। তা বাস্তবে রূপ দিয়েছেন সাদেকের সাংগঠনিক ক্যারিশমায়।

 

 

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন হয়েছে। তাই ৫০ বছরে ফুটবলে সেরা বা তারকা খেলোয়াড় কে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। আসলে এমন কজন ফুটবলার আছেন যাদের নৈপুণ্য এখনো চোখে ভাসে।

এক্ষেত্রেই কাজী সালাউদ্দিনের নামটি চলে আসে সবার আগে। তিনি শুধু ফুটবলার নন, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম সুপারস্টার। সাবেক তারকা ফুটবলার ও জনপ্রিয় বিশ্লেষক গোলাম সারোয়ার টিপু বলেন, ‘নানা বিষয়ে নানাজনের মধ্যে দ্বিমত থাকতে পারে। হয়তো আমার সঙ্গেও আছে। কিন্তু যা সত্যি তাতো আমাকে স্বীকার করতেই হবে। কাজী সালাউদ্দিন নিঃসন্দেহে ৫০ বছরে বাংলাদেশের সেরা ফুটবলার। তাঁর নৈপুণ্য, ডিবলিং, স্পিরিট, গোল করার দক্ষতা সবই দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। আজকের আবাহনীর যে জনপ্রিয়তা তার পেছনে সালাউদ্দিনের অবদান রয়েছে। ১৯৭৬ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশে পেশাদার লিগ খেলে সালাউদ্দিনের জনপ্রিয়তা চলে যায় অনন্য উচ্চতায়। অল্প বয়সেই স্বাধীন বাংলা দলে খেলে সাহসিকতার পরিচয় দেন। জনপ্রিয়তার কারণে খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম বিজ্ঞাপনে মডেল হন সালাউদ্দিন।

ওর পোশাক কিংবা হেয়ার স্ট্রাইলও অনেকে অনুসরণ করতেন।’

 

 

ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কে? গ্যারি সোবার্স নাকি ইমরান খান? পেলে-ম্যারাডোনা বিতর্কের মতোই এর সমাধান নেই। এই বিতর্কে স্থান করে নিয়েছেন সাকিব আল হাসানও। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-২০ ক্রিকেটে একই সময়ে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নাম লিখিয়ে ইতিহাস গড়েছেন তিনি। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আকাশচুম্বি উচ্চতায় নিয়ে যেতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। সাকিব হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘বরপুত্র’। সুপারস্টার। তাকে দেশের সেরা ক্রিকেটার বলতে এক মিনিটও সময় নেননি সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট। তিনি বলেন, ‘আমার দেখা সাকিব ৫০ বছরে বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার।’ ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি দেশের হয়ে ৫৮ টেস্টে ৩৯৩৩ রান ও ২১৫ উইকেট, ২১৫ ওয়ানডেতে ৬৬০০ রান ও ২৭৭ উইকেট এবং ৮৮ টি-২০ ম্যাচে ১৭৬৩ রান ও ১০৬ উইকেট নিয়েছেন। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি ওয়ানডেতে আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা অলরাউন্ডার হন তিনি। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি ক্রিকেটের তিনটি ফরম্যাটেই র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করে ইতিহাস গড়েন সাকিব।

 

 

ঘুঁটি চালের খেলা দাবা এক সময়ে ঘরের খেলা বলেই বাংলাদেশে পরিচিত ছিল। কিন্তু  এ বুদ্ধির খেলার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বা দেশের সুনাম বাড়ানো যায় তা অনেকের কাছেই ছিল অজানা। যারা জানতেন ও বুঝতেন তাদের কাছেও দাবাড়ু মানে গ্যারিকারপভ, ববি ফিশার, আনাতলি কারপভ, আলেকজান্ডার বা মিখাইল বটভিনির ছবি চোখের সামনে ভাসতো। এমন অবস্থা ছিল যে ওরা ছাড়া কেউ যেন দাবা খেলতেই পারেন না।

যে দাবাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছিল সেই দাবায় বাংলাদেশকে প্রথম বড় সম্মান এনে দেন নিয়াজ মোরশেদ। ১৯৮৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে বিশ্ব দাবার সর্বোচ্চ সম্মান গ্র্যান্ডমাস্টারে মর্যাদা পান তিনি। এই কৃতিত্ব তখন শুধু সার্ক অঞ্চল নয়, এশিয়ার পঞ্চম দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টারের মর্যাদা পান নিয়াজ। নিয়াজের এ সাফল্যই দেশে দাবার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে। বাংলাদেশের ৫০ বছরে শুধু দাবাড়ু হিসেবে নয়, ১০ জন সুপারস্টারের তালিকা যদি তৈরি হয় সেখানে নিয়াজের নাম ঠাঁই পাবে।

অনেকে শুনে হয়তো অবাক হবেন দাবায় নিয়াজের ক্যারিশমার গুণে অনেক দেশ বাংলাদেশের নাম জেনে ছিল। দেশে এখন দাবাড়ুর ছড়াছড়ি।

এর পেছনে বড় অবদান নিয়াজেরই। ৫০ বছরে অর্জনের মধ্যে নিয়াজের গ্র্যান্ডমাস্টারের খ্যাতিটাও অন্যতম।

 

বড় বোন মুনীরা রহমান হেলেনের হাত ধরে শৈশবকালেই জোবেরা রহমান লিনুর ক্রীড়াঙ্গনে আগমন। ১৯৭৪ সালে পুরনো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমনেসিয়ামে প্রথম টেবিল টেনিস জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসে। হেলেন প্রথম আসরেই মহিলা বিভাগে দেশ সেরার খেতাব পান। লিনুও ওই আসরে অংশ নেন। বয়স কম বলে সাড়া জাগাতে পারেননি। কিন্তু বড় বোনের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হন। তখন কে জানত এ শিশুই একদিন পিংপং বলে লড়াই করে দেশ কাঁপাবেন। নিষ্ঠা ও সাধনা একজনকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে তা বড় প্রমাণ লিনু। বাংলাদেশের অনেক নারী ক্রীড়াবিদের আগমন ঘটেছে ও ঘটছে। সাফল্যও পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু ৫০ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে লিনু যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তা এক কথায় অবিশ্বাস্য বলতে হয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেমন কোনো সাফল্য নেই। তবুও ঘরোয়া আসরে ইতিহাস গড়ে প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে গিনেস বুকেও নাম লিখিয়েছেন। এই রেকর্ড ভাঙাটা এভারেস্ট বিজয়ের মতো। ১৯৭৭ থেকে ২০০১। টানা ১৬ বছর টেবিল টেনিসে মহিলা এককে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। তাঁকে রুখবে এমন কোনো প্রতিযোগী খুঁজে কী পাওয়া যাবে?

পাওয়া যায়নি। সাবেক টিটি খেলোয়াড় শহিদুর রহমান রিন্টু বলেন, আমি ভাগ্যবান যে লিনু আমার মিক্সড ডাবলে সঙ্গী ছিলেন। আমরা শিরোপাও জিতেছি। আসলে ওর সম্পর্কে আমি কী বলব ওর কৃতিত্বের কথা সবারই জানা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর