বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মারিয়ারাই ওড়ালেন বিজয়ের পতাকা

ক্রীড়া প্রতিবেদক

মারিয়ারাই ওড়ালেন বিজয়ের পতাকা

যে কোনো দেশে ফুটবলের বছর শেষে সাফল্য ও ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় পুরুষ জাতীয় দলকে ঘিরে। সেই হিসেবে ২০২১ সালটা বাংলাদেশের জন্য হতাশাই বলা যায়। একেবারে কম ম্যাচ খেলেননি জামাল ভূঁইয়া-তপু বর্মণরা। কিন্তু ২/১টি জয় ছাড়া দেশবাসীকে কিছুই দিতে পারেননি। সবচেয়ে আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শুধু শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু কি তাই, নেপালে ত্রিদেশীয় ও শ্রীলঙ্কায় প্রাইম মিনিস্টার কাপেও একই দশা। ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছে না জাতীয় দল। তবুও বাংলাদেশ বিজয়ের নিশানা উড়িয়েছে। বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি বাঁধভাঙা উৎসবে মেতেছিল। বছর যখন শূন্যভাবেই শেষ হতে চলেছিল, তা রাঙিয়ে দিল নারী ফুটবলাররা। ২০২১ সালে দেশের ফুটবলে এটাই বড় অর্জন। মান বাঁচিয়েছেন মারিয়া মান্ডারা। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বিজয়ের মাসে বিজয়ের পতাকা উড়ালেন মেয়েরাই। এ সাফল্য ছাড়াও আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ফুটবলে অনেক স্মৃতিই মনে রাখার মতো।

 

সাফে বাংলাদেশের মেয়েরাই সেরা

বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলবে এক সময়ে তা কল্পনাই করা যেত না। এমন কথাও উঠেছিল যেখানে পুরুষরাই কুলিয়ে উঠতে পারছে না, সেখানে মেয়েদের ফুটবল খেলাটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। সেই মেয়েরাই এখন বাংলাদেশের গর্ব। দেশ ছাড়িয়ে সাবিনা, মারিয়া, তহুরা, আঁখি ও শামসুন্নাহারদের নাম বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে কষ্ট এখানেই, মেয়েরা দেশকে সাফল্যে ভাসালেও সেভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যদি এগিয়ে না আসে তাহলে উৎসাহ পাবে কীভাবে? এখনো অনেক নারী ফুটবলার আছেন যাদের পরিবার অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। দেড় যুগ ধরে পুরুষ ফুটবলে সাফল্যের খাতা শূন্য থাকলেও মেয়েরা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আটটি শিরোপা উপহার দিয়েছে। এতে প্রমাণ মিলে নারী ফুটবলের অগ্রগতি কতটা হয়েছে।

যেখানে ট্রফি জুটে না, সেখানে সাফল্য ধরে রাখাটা চাট্টিখানি কথা নয়। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে এবার মারিয়ারা। করোনার জন্য দেশের হয়ে মেয়েরা ফুটবল খেলতেই পারছিল না। নারী লিগই ছিল তাদের ভরসা। দীর্ঘসময়ে বসে থাকলে পারফরম্যান্সে ঘাটতি পড়বেই। কিন্তু দেশপ্রেম ও কমিটমেন্ট থাকলে সব ভয়ই জয় করা যায়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে মারিয়ারা যেন বাঘিনী রূপ ধারণ করে। শুরুতে জেতা ম্যাচ নেপালের বিপক্ষে ড্র করলেও মারিয়ারা-রিপাদের পেছনে তাকাতে হয়নি। টুর্নামেন্টে ভারতই ছিল অন্যতম ফেবারিট। কিন্তু যাদের টার্গেট শুধুই শিরোপা সেই বাংলাদেশকে কি আটকানো যায়? লিগ পর্বে ভারতকে ১, ভুটানকে ৬ এবং শ্রীলঙ্কাকে ১২ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নেয়।

ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত হওয়ায় অনেকে টেনশনে ছিলেন। অথচ ফাইনাল হয়েছে অনেকটা একতরফা। অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা সতীর্থদের নিয়ে প্রতিজ্ঞা করে মাঠে নেমেছিলেন ট্রফি ছাড়া ফিরব না। তাই হয়েছে, ফাইনালে পাত্তাই পাইনি ভারত। মারিয়া, আঁখি, তহুরা, ঋতুপর্ণা, শামসুন্নাহার, রিপা, আনাই মোগিনিদের আক্রমণে ভারত দিশাহারা হয়ে পড়ে। তবুও গোলের দেখা মিলছিল না। শেষ পর্যন্ত মোগিনির গোলে উৎসবে মেতেছিল কমলাপুর স্টেডিয়াম ও পুরো দেশ। শুধু শিরোপা নয়, ইতিহাস গড়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ প্রতিপক্ষের জালে ২০ গোল দিলেও একটাও গোল হজম করেনি। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ফুটবলে এ-এক অনন্য রেকর্ড। নারী ফুটবলে এ সাফল্যের পেছনে বড় কৃতিত্ব গোলাম রব্বানি ছোটনের। তিনিই মূল কারিগর।

 

বসুন্ধরা কিংসই ফুটবল কিং

ঘরোয়া ফুটবলে বসুন্ধরা কিংসের ছিল জয়-জয়কার। বছর শুরুটা হয় তাদের ফেডারেশন কাপ জিতে। ড্যানিয়েল কলিনড্রেস ও আগের মৌসুমে সব বিদেশি ফুটবলার বদলে কিংস আনে দুই ব্রাজিলিয়ান রবসন রবিনহো, জনাথন ফার্নান্দেজ, আর্জেন্টিনার রাউল বেসারা ও ইরানের খালিদ শাফিকে। ফেডারেশন কাপ ফাইনালে সাইফ স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। শেষ পর্যন্ত রাউল বেসারার গোলে কিংস ট্রফি ধরে রাখে। স্বাধীনতার পর বসুন্ধরাই একমাত্র দল যারা অভিষেক আসরে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। শক্তির বিচারে কিংসই পেশাদার লিগে হট ফেবারিট ছিল। মাঠে তা প্রমাণ করেই টানা দ্বিতীয়বার লিগ জেতে তপু বর্মণের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি। ২৪ ম্যাচে ২১ জয়, ১ হার ও দুই ড্রয়ে তাদের পয়েন্ট ছিল ৬৫। অন্যদিকে ৫২ পয়েন্ট নিয়ে রানার্সআপ হয় শেখ জামাল। এএফসি কাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলেও দুর্ভাগ্যক্রমে কিংস পরবর্তী রাউন্ডে যেতে পারেনি। এমন প্রাপ্তির মাঝেও বছরটা তাদের শেষ হয়েছে ফেডারেশন কাপের ট্রফি হারিয়ে।

জামালদের প্রাপ্তি রানার্সআপ

পুরুষ জাতীয় দলের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয় মালদ্বীপে। টুর্নামেন্টে নামার আগে কোচ বদল নিয়ে নাটকে মেতেছিল বাফুফে। সব যখন ঠিকঠাক তখন ঘোষণা এল জেমি ডে নয় সাফে কোচের দায়িত্ব পালন করবেন কিংসের কোচ অস্কার ব্রুজোন। মজার ব্যাপার হলো বাফুফে ঘোষণা দিলেও অস্কার নিজেই জানতেন না তিনি বাংলাদেশের কোচ হয়েছেন। যাক অস্কার বলেই আশা জেগেছিল এবার কিছু ঘটবে। কিন্তু দেড় যুগের হতাশা থেকেই গেল। নেপালে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টেও শিরোপাহীন। রানার্স আপ হয়ে সন্তুষ্ট থাকেন জামালরা। শ্রীলঙ্কায় প্রাইম মিনিস্টার গোল্ডকাপ ফাইনালে না উঠলেও স্বস্তি ছিল মালদ্বীপের বিপক্ষে জয়। ২০০৩ সালের পর এটিই ছিল মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রথম জয়।

 

লিগে গোলের সেঞ্চুরি সাবিনার

নারী লিগেও বসুন্ধরা কিংস টানা দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। দেশসেরা নারী ফুটবলার সাবিনা খাতুনই দলকে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের ফুটবলে ঘরোয়া আসরে বসুন্ধরাই প্রথম যারা দুই বিভাগে টানা দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়ন। লিগটা বিশেষভাবে স্মরণীয় থাকবে বাংলার মেসিখ্যাত সাবিনা খাতুনের জন্য। তিনি লিগে সেঞ্চুরি গোলের রেকর্ড গড়েন। যা দেশের ফুটবলে বিরল ঘটনা।

সর্বশেষ খবর