ভারত বা পাকিস্তান হকিতে বিশ্ব কাঁপিয়েছে। বিশ্বকাপ কিংবা অলিম্পিক গেমসে তাদের দাপট ছিল তুঙ্গে। দুই দেশের সঙ্গে এশিয়ায় বাংলাদেশেরও শক্ত অবস্থান থাকার কথা ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও মালয়েশিয়া এক সময়ে পিছিয়ে থাকলেও তিন দেশই এখন বাংলাদেশর চেয়ে অনেক এগিয়ে। যা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটা ঠিক, বিশ্ব হকিতে এশিয়া এখন শক্ত অবস্থানে নেই। শিরোপা জিতছে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন। বেলজিয়াম ভালো পজিশনে, এমনকি ফুটবলের দেশ আর্জেন্টিনাও হকিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কেন বেহাল? এনিয়ে প্রশ্ন করলে হকি কর্মকর্তারা বলেন, যেখানে ভারত-পাকিস্তানই চুপসে গেছে, সেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা হাস্যকর।
এ যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো না হলেও এটা তো ঠিক হকি তো বাংলাদেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলা। পূর্ব পাকিস্তান আমলেও বাঙালিরা দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। ষড়যন্ত্র করে বাঙালি খেলোয়াড়দের পাকিস্তান জাতীয় দলে নেওয়া হতো না। তার পরও পিছু হটতে হয়েছে তখনকার হকি কর্তৃপক্ষকে। যোগ্যতা দিয়েই পাকিস্তান জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন আবদুস সাদেক। বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রথম অধিনায়কও তিনি। প্রসঙ্গটা কেন উঠছে, বাংলাদেশ আজ হকিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়বে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে প্লে-অফ ম্যাচে দুই দেশ তিন ম্যাচের সিরিজ খেলবে। যারা জিতবে তারাই বাছাই পর্বে সুযোগ পাবে।
পাকিস্তানের আগের শক্তি না থাকলেও বাংলাদেশের কোচ বলেছেন, পাকিস্তানকে হারাব এ প্রতিশ্রুতি কোনোভাবেই দিতে পারব না। ভালো খেলার চেষ্টা করব। যে মানসিকতা তাতে মনে হচ্ছে ম্যাচের আগেই হেরে বসে আছে বাংলাদেশ। কেন এ বেহাল দশা। যেখানে এগিয়ে যেতে পারত সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এত পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? বিশ্ব হকি ফেডারেশনের সভাপতি লিয়েনেন্দ্রো নেগ্রে বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা সফরে এসেছিলেন। তিনি আবদুস সাদেককে দেখে বলেছিলেন, অনেক দিন পর পুরোনো বন্ধুর দেখা পেলাম। তার পর তিনি যা বলেছিলেন তা অবাক করার মতো। আবদুস সাদেককে কাছে টেনে বলেন, সাদেকের মতো হকিরত্ন থাকার পরও বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে? হয় তোমরা যত্ন নাও না, না হয় ভিতরে বড় গণ্ডগোল থাকার কারণে এমন অবস্থা। আবদুস সাদেক যখন পাকিস্তানের জাতীয় দলে খেলেছিলেন তখন নেগ্রে স্পেনে খেলতেন। সেই থেকে তাদের বন্ধুত্ব।
নেগ্রে সেদিন হকিপ্রেমীদের মনের কথাটিই বলে ফেলেছিলেন। আসলেও হকির যত্ন নেওয়া হয় না। নেবেই বা কীভাবে? সবই তো দ্বন্দ্বে ভরা। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যে সাড়া জাগানো এশিয়া কাপ হয়েছিল। তার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন আবদুস সাদেকই। ওই সময়ে তিনি হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এশিয়া কাপের আয়োজক হতে এশিয়ান হকি ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিরা বৈঠকে বসেছিলেন। আবদুস সাদেক জোরালো কণ্ঠে বলেছিলেন, ঢাকা এশিয়া কাপ আয়োজনে প্রস্তুত। পাকিস্তান, ভারত আপত্তি জানালেও আবদুস সাদেক ঠিকই এশিয়া কাপ নিয়ে এসেছিলেন ঢাকায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে হঠাৎ করে ৪০ বছর আগে হওয়া এশিয়া কাপের প্রসঙ্গ উঠল কেন? ওই আসরে পাকিস্তান খেলতে এসেছিল আগের বছর অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সবাই ভেবেছিলেন বাংলাদেশ পাত্তাই পাবে না। অথচ পাকিস্তানের দম বের করে ছেড়েছিলেন জুম্মন লুসাইরা। দুর্ভাগ্য জেতা ম্যাচ শেষের দিকে গোল খেয়ে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ওই সময়ে যদি পাকিস্তানকে অস্থির করে তুলতে পারে তাহলে এখন কেন ম্যাচের আগেই হেরে যাওয়ার মতো মানসিকতা থাকবে। যোগ্যদের মূল্যায়ন ও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলে জাতীয় দলের সংকটাপন্ন অবস্থা। খেলা বুঝবেন না অথচ চেয়ারে বসবেন, তখন কি হকি খেলার উন্নয়ন ঘটবে? শুধু কিংবদন্তি সাদেক নন, বাংলাদেশে তো মাহমুদুর রহমান মোবিন, মির্জা ফরিদ আহমেদ ও বশির আহমেদের মতো হকি ব্যতিত্ব ছিলেন। ইব্রাহিম সাবের, সাব্বির ইউসুফ, আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়াদের মতো তারকা খেলোয়াড় ছিলেন। তাদেরও কি মূল্যায়ন করা হয়েছে? যারা হকি বোঝেন না, তাদেরই গুরুত্ব দেওয়া হলে এ খেলা তো অন্ধকারে থাকবে। তাই নেগ্রের মতো আফসোস করতে হয়- আবদুস সাদেকের মতো কিংবদন্তি থাকার পরও এ খেলা শুধুই হাহাকারে বন্দি।