শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিল্প বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

রুহুল আমিন রাসেল

শিল্প বিপ্লবের পথে বাংলাদেশ

পুরো বিশ্বের লক্ষ্য এখন চর্তুথ শিল্প বিপ্লবের। সেই লক্ষ্যে একশত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে শিল্প বিপ্লবের পথে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। এতে দেড় লাখ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাবে ডানা মেলেছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনায়। বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে কোটি মানুষের। এ তথ্য দিয়েছে বেজা।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেজা আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বিনিয়োগকারীদের জমির সমস্যা কমিয়ে দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সেবা সংযোগ এবং অবকাঠামোর নিশ্চয়তা পাচ্ছেন। আর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব সেবা একসঙ্গে দিতে সম্প্রতি ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করেছে সরকার। বিশ্বব্যাপী চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এগিয়ে নিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ট্রান্সন্যাশনাল করপোরেশনস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে- বিশ্বের ১৪৭টি দেশে এখন ৫ হাজার ৪০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল-এসইজেড আছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে রীতিমতো শিল্প বিপ্লব ঘটবে। এ সম্ভাবনার পুরোটাই হচ্ছে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে। বাড়তি ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি আয় করতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে উঠছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। আছে বিদেশিদের জন্য বিশেষ অঞ্চল। বিদেশিদের মধ্যে ভারত, জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, হংকং, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ বিনিয়োগ করবে শত শত বিলিয়ন ডলার। এসব দেশের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৮৮টি অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এসব এলাকায় কাজও চলছে।

সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসে বেজার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী- ৩টি সরকারি ও ১০টি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে মোট ১ হাজার ৭৮৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি। এখন জোরেশোরে কাজ চলছে ২৮টির।  এর মধ্যে ১৩টি সরকারি খাতে। বেসরকারি খাতে ১৫টি। অবশ্য বেসরকারি  খাতে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চূড়ান্ত লাইসেন্স পেয়ে জমি বরাদ্দ ও বিনিয়োগ নিতে পারছে। অন্যদিকে সরকারি খাতে তিনটিতে ইতিমধ্যে জমি বরাদ্দ শুরু হয়েছে। দুটিতে বরাদ্দের আবেদন নেওয়া হচ্ছে।

বেজার প্রতিবেদন বলছে- চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও ফেনী ঘিরে ৩০ হাজার একর জমি গড়ে তোলা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। সেখানেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বেজার হিসাবে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রস্তাব ১ হাজার ২৩৯ কোটি ডলারের। এতে জমি নিয়েছে ৬৯টি প্রতিষ্ঠান। মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে ২টি প্রতিষ্ঠান। তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ২৪৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলের পুরো জমি নিয়ে নিয়েছে ৬টি প্রতিষ্ঠান। তাদের মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব ১৩১ কোটি ডলার। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৬টিতে বিনিয়োগকারীরা কারখানা করছে। এর মধ্যে ৩৯টি কারখানার মধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে ২০টি।

বেজার তথ্যানুযায়ী, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ৮৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থান চূড়ান্ত হয়েছে। এসব অঞ্চলে ১ লাখ একর জমির ‘বিশাল ব্যাংক’ তৈরি করা হবে।

বেজা আরও জানিয়েছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের জন্য জমি নিয়েছে বিদেশি বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশন, দক্ষিণ কোরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম কোম্পানি এস কে গ্যাস, বিশ্বের তৃতীয় বড় ইস্পাত উৎপাদক প্রতিষ্ঠান জাপানের নিপ্পন স্টিল, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খেলনা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেইগো লিমিটেড, ভারতের আদানি ও সিঙ্গাপুরের উইলমারের যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড, রং উৎপাদনকারী বার্জার ও এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের ইউরেশিয়া ফুডস এবং চীনের বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় শিল্প পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপ, এসিআই, পিএইচপি, বিএসআরএম, অনন্ত গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, এনার্জি প্যাক, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট, টিকে গ্রুপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি নিয়েছে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোন উৎপাদনে এসেছে। ইতিমধ্যে ৩০ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বেসরকারি খাতে নতুন মূলধন সৃষ্টির হার বাড়াতে চায় সরকার। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বিনিয়োগের হার মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায় সরকার। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন কৌশলের ওপর জোর দিচ্ছে সরকার।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশে এখন বিনিয়োগের সবচেয়ে উত্তম পরিবেশ। এমন পরিবেশ পেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যবসা স্থানান্তর করতে চান বিদেশিরা। এর সঙ্গে দেশি বিনিয়োগকারীদেরও সক্ষমতা বাড়ছে।

অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে প্রণোদনা ও সুবিধা : অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৫ বছর মেয়াদি কর অবকাশ সুবিধা দেবে সরকার। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। বিদ্যুৎ বিলের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হবে না ১০ বছর। পেট্রোলিয়াম পণ্য ছাড়া সর্বপ্রকার ক্রয়ে ভ্যাট অব্যাহতির সুযোগ থাকবে। লাগবে না শুল্ককর। থাকছে স্ট্যাম্পকর মওকুফসহ আরও সুবিধা।

বিনিয়োগে প্রণোদনা ও সুবিধা : অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন হারে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাবে। শূন্য শুল্কে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, নির্মাণসামগ্রী আমদানির সুবিধা রয়েছে। উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দেশীয় বাজারে বিক্রি করা যাবে। রপ্তানিতে শুল্ককর দিতে হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুল্ক ছাড়াই দুটি গাড়ি আমদানির সুবিধা পাবেন। থাকবে কাস্টমস বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা। যৌথ বিনিয়োগে শিল্প স্থাপন করা যাবে। অংশীদারিত্ব বা মালিকানা হস্তান্তর করা যাবে। শিল্পের মোট জনবলের ৫ শতাংশ বিদেশিকে ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হবে। থাকবে পুনঃবিনিয়োগ সুবিধা। বিনিয়োগকারীরা ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে রেসিডেন্ট ভিসা পাবেন এবং ৫ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব।

সর্বশেষ খবর