শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু

লাবলু মোল্লা, মুন্সীগঞ্জ

দৃশ্যমান স্বপ্নের পদ্মা সেতু

দেশের অন্যতম মেঘা প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের নানামুখী কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। এই সেতুর উভয় পাড়ে সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজার কাজ শেষ। চলছে নদী শাসন, নদী শাসনের জন্য বিপুল পরিমাণ ব্লক তৈরি, ড্রেজিংয়ের কাজসহ বিভিন্ন স্থানে স্লপিংয়ের কাজ। যেদিকে তাকাবেন শুধু কাজ আর কাজ। পদ্মা সেতুর বিশাল এই কর্মযজ্ঞ রাতের আঁধারকেও হার মানায়। কর্মমুখর পদ্মায় প্রবল স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলছে সেতু নির্মাণ কাজ। ইতিহাসের সাক্ষী হতে ইতিমধ্যে ১৮টি স্প্যান পিলারে বসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতুর প্রায় তিন কিলোমিটার। মূল সেতুর বাস্তবায়ন অগ্রগতি ৮৫ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৭৭ ভাগ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর সবকটি পাইল ড্রাইভের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ৩২টির কাজ শেষ হয়েছে। আর বাকি ১০টির কাজও শেষের পথে। সর্বমোট ৪১টি ট্রাসের মধ্যে চীন থেকে মাওয়া সাইটে এসেছে ৩১টি। এর মধ্যে ১৮টি স্থাপন করা হয়েছে। ১৩টি স্প্যান স্থাপনের জন্য মাওয়া কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে প্রস্তুত রয়েছে। বাকি ১০টি স্প্যান চীন থেকে অতিসত্বর আনা হচ্ছে। এ ছাড়া রেলওয়ে স্লাবের জন্য মোট ২৯৫৬টি প্রি-কাস্টের প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৮৯১টি স্ল্যাব তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাকি স্লাব এ মাসেই শেষ হবে। এ পর্যন্ত ৩৬১টি স্লাব স্থাপন করা হয়েছে। এদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের রেল লাইনের কাজ জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণ করা হবে। এরপর ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬১ কিলোমিটার রেল পথ প্রশস্ত করা হবে।  দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেতু  পদ্মা বহুমুখী সেতুর রেল পথের কাজও শুরু হয়েছে জোরেশোরে। রেল সংযোগ প্রকল্প সূত্রে আরও  জানা গেছে, এ প্রকল্পে ১৬১ কিলোমিটার রেলপথের প্রথম ধাপে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৮৮ দশমিক ২৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা জেলার ৭১ দশমিক ৩২ একর, নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৫ দশমিক ৮৫ একর, মুন্সীগঞ্জ জেলার ১৩৭ দশমিক ৮১ একর, শরীয়তপুর জেলায় ৩ দশমিক ৯৫ একর, মাদারীপুরের ২১৩ দশমিক ৮৮ একর এবং ফরিদপুর জেলার ১৪৫ দশমিক ৪৪ একর ভূমি। তারই ধারাবাহিকতায় পদ্মা সেতুতেও চলছে রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ। পুরো সেতুর নদীগর্ভে থাকবে ৪২টি পিলার এবং ১২টি করে দুই তীরে ২৪টি পিলার মোট পিলার হবে ৬৬টি যার ৪২টির ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। এর মধ্যে আরও থাকবে ২ হাজার ৯৩১টি রোডওয়ে স্ল্যাব আর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৫৯টি।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে শেখ হাসিনাই মূল শক্তি। শেখ হাসিনার হাত দিয়েই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে। এই সেতু প্রধানমন্ত্রীর সাহসের ফসল। এটা তার একক কৃতিত্ব। তার একক সিদ্ধান্তের কারণে নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, প্রথম স্প্যানটি বসেছিল হেমন্তের কুয়াশাভেজা কোনো এক সকালে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা কাজে দেশের বাইরে ছিলেন, তাই আমি তাকে ফোনে বলেছিলাম ইতিহাসের এই শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত থাকার জন্য কয়েক দিন দেরি করতে চাই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেদিন টেলিফোনে বলেছিলেন পদ্মা সেতুর কাজ এক মিনিটের জন্যও বসিয়ে রাখা যাবে না। তাই বর্ষার ভরা মৌসুমেও পদ্মা সেতুর কাজ শিডিউলমাফিক দ্রুতগতিতে চলে। তিনি আরও জানান, বিশ্বের অন্যতম এই সেতুটি চালু করার লক্ষ্যে এক ঝাঁক চাইনিজ ও বাংলাদেশি প্রকৌশলী, পদ্মা সেতুর টেকনিক্যাল পরামর্শক বিশেষজ্ঞ প্যানেল অফ এক্সপার্ট, দক্ষ দেশি-বিদেশি প্রায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক, পদ্মা সেতু প্রতিষ্ঠার নানা সরঞ্জামাদি নিয়ে দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করছে শিডিউল মাফিক কাজ।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আরও জানান, পদ্মা সেতু হলে দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে এটি সহায়ক হবে। অপ্রয়োনীয় জমি পতিত না রেখে দেশের আর্থসামাজিক ও আর্থিক সম্ভাবনার জন্য এ জমিতে আধুনিক উন্নতমানের মিলিটারি ফার্ম গড়ে তোলা হবে। দেশে দুধের চাহিদা মেটানোসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়াও এখানে গড়ে তোলা হবে হংকং সিটির মতো শহর। এখানে থাকবে প্রজাপতি চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, বিশ্বমানের স্টেডিয়াম। দেশের বিভিন্ন শিল্পোদ্যোক্তারা এখানে ইতিমধ্যে জমি কেনার জন্য ভিড় করছেন। এ এলাকায় জমির দামও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতু ঘিরে মহাউন্নয়নের জল্পনা-কল্পনা চলছে দেশজুড়ে। খুলে যাচ্ছে সম্ভাবনার আরও এক নতুন দিগন্ত।

কর্মরত দেশি বিদেশিদের নিরাপত্তার বিষয়ে মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম (বার) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের সর্ববৃহৎ এই পদ্মা সেতুর নির্মাণকে ঘিরে এ এলাকা সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা রয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চৌকস দল রয়েছে। রয়েছে আনসারসহ নির্মাণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব কেয়ারটেকারও।

মূল সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তড়িৎ গতিতে শুরু হয়েছে ফোরলেন সড়ক ও রেললাইন প্রকল্প কাজের প্রক্রিয়া। নদী শাসনের জন্য দায়িত্বে রয়েছেন চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সেতুর মূল নির্মাণ কাজের জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দুই পারে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যৌথভাবে আবদুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার হাইওয়ে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট কাজ করে চলছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এবং রেললাইনের কাজ করছে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড কোম্পানি।

সর্বশেষ খবর