শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডেল্টা প্ল্যানে আয়তনে বাড়বে বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডেল্টা প্ল্যানে আয়তনে বাড়বে বাংলাদেশ

ইউরোপের একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ নেদারল্যান্ডস, যে দেশটির বেশির ভাগ ভূখ- সমুদ্র সমতলের নিচে অবস্থিত। এই দেশটির আয়তনের প্রায় ১৭ শতাংশ সাগর ও হ্রদ থেকে ভূমি পুনর্দখল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের উত্তর ও পশ্চিমভাগ নিম্নভূমি, যা মূলত রাইন, মোজ ও শেল্ডে এই তিন নদীর সম্মিলিত ব-দ্বীপ। আর বাংলাদেশ হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এই তিন নদীর পললে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবলেন, সুদূর ইউরোপের সেই দেশটি যদি ভূমি পুনর্দখল করে একটি দেশের ১৭ শতাংশ আয়তন বাড়াতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না। সেই ভাবনা থেকেই তিনি নেদারল্যান্ডসের অনুসরণে ওই দেশটির অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রহণ করলেন ডেল্টা প্ল্যান বা বৃহত্তম ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০।

শত বছরের এই বৃহত্তম পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন হবে কয়েক ধাপে। ২০১৮ সালে গৃহীত প্রথম পর্যায়ের পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ৩ লাখ কোটি টাকার এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলে প্রথম পর্যায়ে শুধু এই পরিকল্পনা থেকে সামগ্রিক অর্থনীতিতে আরও ১ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি যুক্ত হবে।

২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে শত বছরের এই বৃহত্তম পরিকল্পনাটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম এই পরিকল্পনাটি অনুমোদনের পর তখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এটিকে ‘ঐতিহাসিক পরিকল্পনা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছিলেন, পৃথিবীর কোথাও এত দীর্ঘ পরিকল্পনা হয়নি। বাংলাদেশে এটিই প্রথম।

আ হ ম মুস্তফা কামাল আরও জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, সুযোগ পেলে নেদারল্যান্ডস ঘুরে এসো। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকবার নেদারল্যান্ডস ঘুরেছেন। তাঁরই নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় এই শতবছরের বৃহত্তম ব-দ্বীপ পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়েছে। পরিকল্পনায় নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং পরবর্তীতে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করা হবে। ফলে নতুন ভূমি পাওয়া যাবে। আয়তনে বাড়বে বাংলাদেশ। নদী পথের ব্যবহার বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে নদী ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। বন্যা-খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় নেওয়া হবে কৌশলগত উদ্যোগ। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে বন্যা, নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর মতে, বাংলাদেশকে আধুনিক, প্রকৃতিবান্ধব ও বাসযোগ্য করে সাজাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে যাচ্ছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। নানা রকম পরিকল্পনার আওতায় এনে প্রতিটি ক্ষেত্রের উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি সচেষ্ট। তাই ব-দ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণরূপে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। 

কত টাকা লাগবে ডেল্টা প্ল্যানে : পরিকল্পনা কমিশন জানায়, ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় ২০১৮-২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ৮০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে, সেগুলোতে  ব্যয় হবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ সরকারি, বেসরকারি, উন্নয়ন সহযোগী এবং জলবায়ু তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মোট খরচের ৮০ শতাংশের জোগান আসবে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে। বাস্তবায়ন ব্যয় মেটাতে গঠন করা হবে একটি ডেল্টা তহবিল। এর পাশাপাশি ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নে গঠন করা হবে ডেল্টা নলেজ ব্যাংক।

ডেল্টা তহবিল গঠনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ প্রয়োজন হবে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা। এ জন্য জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থায়ন সম্বলিত ডেল্টা তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর মধ্যে ২ শতাংশ নতুন বিনিয়োগ এবং শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় করা হবে। জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ সরকারি তহবিল হতে এবং শতকরা ২০ ভাগ বেসরকারি খাত থেকে আসবে।

পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম জানান, ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় ২০১৮ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প এবং সম্ভাব্য বিনিয়োগের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। যেমন- উপকূলীয় অঞ্চলে ২৩টি প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগ করা হবে ৮৮ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। বরেন্দ্র এবং খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৯টি প্রকল্পের আওতায় বিনিয়োগে হবে ১৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। হাওর এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৬টি প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য ৮ প্রকল্পের অনুকূলে ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। নদী এবং মোহনা অঞ্চলে ৭টি প্রকল্পের অনুকূলে ৪৮ হাজার ২৬১ কোটি টাকা এবং নগরাঞ্চলের জন্য ১২টি প্রকল্পের অনুকূলে ৬৭ হাজার ১৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রাক্কলন করা হয়েছে।

যেভাবে বাড়বে আয়তন : নেদারল্যান্ডসের উপকূলীয় এলাকা সম্পূর্ণ সাগরের নিচে। এগুলোকে চর ও কৃত্রিম সমুদ্র বাঁধের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশেরও দক্ষিণাঞ্চলের বিরাট অঞ্চল নিচুভূমি। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বিরাট এলাকা। খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙনের হুমকি মোকাবিলা করতে হয় প্রতিনিয়ত। যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, তাতে ২০৫০ সালে এ দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে করে প্রায় ৩ কোটি লোক জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কাকে সম্ভাবনায় পরিণত করার দিকে হাঁটলেন শেখ হাসিনা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) প্রফেসর শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড় আর নদীভাঙনে আমাদের দেশের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা ভূমি হারায়, ফসল হারায়, সর্বস্বান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই পরিকল্পনায় এমন কিছু কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে যার মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি বন্যা ও ঝড় বৃষ্টি থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শহর রক্ষা; নতুনভাবে জেগে ওঠা চর এলাকায় নদী ও মোহনা ব্যবস্থাপনা জোরদার করা; উপকূলীয় অঞ্চলে জেগে ওঠা নতুন জমি উদ্ধার এবং সুন্দরবন সংরক্ষণ করার উদ্যোগ থাকবে। আর এসব উদ্যোগের মধ্য দিয়েই পললগঠিত এই বৃহত্তম ব-দ্বীপের মোহনায় জেগে ওঠবে নতুন জমি। আয়তনে বাড়বে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা পাবে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। লবণাক্ত জমিতে সহনশীল শস্য উৎপাদনে নেওয়া হবে পরিবেশসম্মত কৌশল। ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জেগে ওঠা নতুন জমিতে, নতুন ফসলে ভরে উঠবে কৃষকের গোলা।

সর্বশেষ খবর