শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশ

জুলকার নাইন

সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশ

কিছু দিন আগেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির আবেদন করার জন্য কত ঝামেলাই না পোহাতে হতো ছাত্রছাত্রীদের। তখন প্রত্যেকটি কলেজে গিয়ে আবেদন জমা দিতে হতো। আলাদা ফরম কিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম জমা দিতে হয়েছে। খরচ আর ভোগান্তিতে ছিল এক নাজেহাল অবস্থা। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে আজ এসব কত সহজ হয়ে গেছে, সেবা পৌঁছে গেছে জনগণের দোরগোড়ায়। এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা যে কোনো কলেজে ভর্তির আবেদন ঘরে বসেই করতে পারছে।

টাকা-পয়সার লেনদেনের জন্য সেই দূরের শহরের ব্যাংকে গিয়ে পাতার পর পাতা ফরম পূরণ করে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতির জন্য অপেক্ষার বালাই নেই। আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর নির্ভর না থেকে জনগণ এখন ডিজিটাল পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। পৃথিবীতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এখন এক নম্বরে। মোবাইল ফোনে লেনদেন হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ যেভাবে গ্রহণ করেছে তা অসাধারণ। দেশে গত ১০ বছরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১০০ গুণেরও বেশি। ২০০৮ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ লাখ, এখন প্রায় ৯ কোটি। মোবাইল ফোনের গ্রাহকও বেড়েছে চার গুণ। ২০০৮ সালে মোবাইলে চালু সিমের সংখ্যা ছিল ৪ কোটির কম, সেখানে ২০১৮ সালের জুনে এ সংখ্যা ১৫ কোটি ৯ লাখ ৫৪ হাজারে পৌঁছে যায়। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের কারণে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সেবা। ব্যবসাসহ যে কোনো উদ্দেশ্যে বহির্বিশ্বেও দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন এখন আর কোনো সমস্যা নয়।

দেশের আমূল এ পরিবর্তনের শুরু বেশি দিন আগে নয়। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আসে এ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ঘোষণা। সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ যে একটি মিথ নয়, তা আজ প্রমাণিত। বাংলাভাষায় কম্পিউটার চালনার পথিকৃত তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারের মতে, আগে আমরা কল্পনায় যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সত্যিকার ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। ডিজিটালের এ অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ শিগগিরই বিশে^ নেতৃত্বে দিতে যাচ্ছে বলে আশার কথা জানান সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

সরকারি তথ্যানুসারে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে সরকারি সেবা নিয়ে যেতে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর দেশের ৪ হাজার ৫৪৭টি ইউনিয়নে চালু হয় ‘ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র।’ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার নামে পরিচিত এসব সেবাকেন্দ্রে কম্পিউটার কম্পোজ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত তথ্য, ভর্তি ফরম পূরণ, জন্মনিবন্ধন, বিমা, মোবাইল ব্যাংকিং, কৃষিকাজের জন্য মাটি পরীক্ষা ও সারের সুপারিশ, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, ডাক্তারি পরামর্শসহ দৈনন্দিন ৬০ ধরনের সেবা পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি ডিজিটাল সেন্টার থেকে পাসপোর্ট ও ভিসার আবেদন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ৩ হাজার ৮টি সেন্টারে চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। বিদেশে গমনেচ্ছুক ২০ লাখ ২২ হাজার ৪৩৬ জন শ্রমিক অনলাইনে ডিজিটাল সেন্টারে নিবন্ধন করেছেন। ইউনিয়ন পরিষদের পর দেশের ১১টি সিটি করপোরেশনে ৪০৭টি ডিজিটাল সেন্টার ও ৩২১টি পৌরসভায় ডিজিটাল সেন্টার চালু হয়। প্রতি মাসে গড়ে ৪০ লাখ মানুষ সেবা নিচ্ছে এসব কেন্দ্র থেকে। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর দেশের সব জেলায় জেলা ই-সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। জেলা ই-সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে এরই মধ্যে ৮ লক্ষাধিক সেবা প্রদান করা হয়েছে। দালালদের উৎপাত ছাড়াই ই-সেবাকেন্দ্র থেকে তিন দিনের মধ্যে জমির পর্চাসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

তৈরি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকারি ওয়েবসাইট ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’। এখানে ৪৩ হাজার দফতর যুক্ত হয়। দরপত্র জমা দিতে ঠিকাদারদের জন্য চালু করা হয়েছে ই-প্রকিউরমেন্ট। এতে কমে আসে টেন্ডার বাণিজ্য। আদালতের কার্যক্রমকে ডিজিটালাইজ করতে চালু হয়েছে মোবাইল কোর্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। স্বল্প পরিসরে চালু হওয়া এ উদ্যোগের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালতের যাবতীয় ডকুুমেন্ট অনলাইনে সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের জন্য রাখা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও এটুআই প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে সব রেকর্ড এসএ, সিএস, বিআরএস ও খতিয়ান কপি ডিজিটালাইজড করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি খতিয়ান ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। খুব শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে ডিজিটাল রেকর্ড রুম। এর মধ্যে ২৩ লাখ ২০ হাজার রেকর্ড ডিজিটাল সিস্টেমে প্রদান করা হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ প্রজন্ম গড়তে ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক ও ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। ‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি’ এ মূলমন্ত্রকে ধারণ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য  মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শিক্ষক কর্তৃক মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি, শিক্ষক বাতায়ন, ই-বুক, মনিটরিং ড্যাশবোর্ড ও ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক নামক মডেলগুলো উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ মডেলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উপযোগী কন্টেন্ট তৈরি করে ক্লাসে ব্যবহার করছেন। প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজারের বেশি শিক্ষক এবং ১ হাজার ৬৫০ জন মাস্টার-ট্রেইনার প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি করতে পারছেন মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট। কৃষি সম্প্রসারণ সেবাকে ডিজিটালাইজড করার মাধ্যমে কার্যকর ও সহজ উপায়ে কৃষকের কাছে সম্প্রসারণ সেবাকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে ‘কৃষি পোর্টাল’। এর বাইরে চলছে আরও নানা উদ্ভাবনী সেবার উদ্যোগ। সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়া টকিং বুক, অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, অনলাইন পরিবেশ ছাড়পত্র, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের জন্য মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বয়স যাচাই, বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য টকিং ডিভাইসসহ ১৭০টি উদ্ভাবনী ধারণা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে সরকারের বিভিন্ন দফতর।

সর্বশেষ খবর