শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দ্রুত স্বপ্ন পূরণের পথে রূপপুর

জিন্নাতুন নূর

দ্রুত স্বপ্ন পূরণের পথে রূপপুর

পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বপ্নযাত্রার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে জোরেশোরে। কাজের গতিই বলে দিচ্ছে নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালে উৎপাদনে আসবে রূপপুর। শুধু তাই নয়, প্রথমটির নির্মাণ শেষ হতে না হতেই আরও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের চিন্তাভাবনা করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। সময়মতো নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এ প্রকল্পে দুটি ইউনিটের মাধ্যমে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবে দেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের ভাষায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপপুর প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

রূপপুর নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা রাশিয়ার রোসাটমের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ রিয়্যাক্টর বিল্ডিংয়ের প্রথম ধাপের ইন্টারনাল কনটেইনমেন্ট স্থাপনার কংক্রিট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। এ কাজে এক হাজার ১৪৫ কিউবিক মিটার কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। একে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন মন্তব্য করে রাশিয়ার প্রকৌশলী জানান, রাশিয়ায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নির্মাণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে ভারি এ যন্ত্রপাতির অনেকগুলোই প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে। আগামী বছরের শুরুতেই প্রকল্পটির ইউনিট ১-এর জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজও শুরু হবে। প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্পের বর্তমান অগ্রগতি আমাদের জন্য এক ধরনের মাইলস্টোন। বলা যায়, পদ্মা সেতুর মতো রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পও ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এ ধরনের কাজ শুরু হলে নির্মাণকাজে কোনো বিরতি দেওয়া হয় না, টানা ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলে।’

জানা যায়, অর্ধশতাব্দী ধরে রূপপুরের ভাবনা থাকলেও স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসতে পারেনি দেশের কোনো সরকারই। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার জ্বালানি সংকট সমাধান ও বিদ্যুৎ উৎপাদনকে তাদের পাঁচটি অগ্রাধিকারের অন্যতম হিসেবে কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৭-এর ৩০ নভেম্বর এ প্রকল্পের প্রথম ঢালাই কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমেই প্রকল্পের ইউনিট-১-এর মূল পর্বের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বিশ্বে নিউক্লিয়ার ক্লাবের গর্বিত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে হাজার একরেরও বেশি এলাকাজুড়ে পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে যে ব্যয়বহুল ও বিশাল উন্নয়নযজ্ঞ চলছে সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে বড় বড় বিদেশি ভারী যন্ত্রপাতি। বাংলাদেশ ছাড়াও এ প্রকল্পের নকশা বাস্তবায়নকারী দেশ রাশিয়া ও প্রকল্প নির্মাণে সহযোগী দেশ ভারতের বিশেষজ্ঞ বাহিনী একত্রে গড়ে তুলছে এই বৃহৎ স্থাপনা। রাতদিন চলা বিশাল এই কর্মযজ্ঞের জন্য এরই মধ্যে রূপপুর ও তার আশপাশের এলাকা বদলে যেতে শুরু করেছে। টানা ৬০ বছর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা নিয়ে নির্মাণ শুরু করা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর পেছনে বার্ষিক খরচ হবে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে আধুনিক জেনারেশন থ্রি প্লাস প্রযুক্তির ভিভিইআর-১২০০ নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এই প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী। এ ছাড়া এটি পরিচালনা করতে তুলনামূলক কম জনবল লাগে। এই প্রযুক্তিতে পারমাণবিক জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম বেশি ব্যবহৃত হয়। ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎও বেশি উৎপাদন হবে। উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে ও দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন হলে দেশের ছয় কোটি মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করবে।

শুধু নির্মাণ কাজই নয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জিং কাজের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে যেন বাংলাদেশিরাই এই বিশাল যজ্ঞের পরিচালনা করতে পারে সে জন্য তৈরি করা হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। রাশিয়ায় উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে ১২৪ মেধাবী তরুণ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ব্যাচে তারা প্রশিক্ষণ শুরু করেছে, পর্যায়ক্রমে যাবে বাকিরাও। রাশিয়ার বাইরে ভারতে তৈরি হচ্ছে আরেকটি দল।

রূপপুর প্রকল্পের মাইলস্টোন

১৯৬১ : পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ।

১৯৬২-১৯৬৮ : পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন এবং প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর ও আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ।

১৯৬৯-১৯৭০ : ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।

১৯৭৭-১৯৮৬ : একনেক কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (১২৫ মেগাওয়াট) নির্মাণ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন; কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাতিল।

১৯৮৭-১৯৮৮ : জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের দুটি কোম্পানির দ্বিতীয়বার ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির আলোকে ৩০০-৫০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ।

১৯৯৭-২০০০ : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

২০০৯ : পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রাথমিক কার্যাবলি ও পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও রুশ ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটোম) মধ্যে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর।

২০১০ : বাংলাদেশ সরকার এবং রুশ ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষর। নভেম্বরে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ।

২০১১ : বাংলাদেশ এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।

২০১৩ : অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

২০১৬ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল পর্যায়ের কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং রাশান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে স্টেট ক্রেডিট চুক্তি স্বাক্ষর।

২০১৭ : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। ৩০ নভেম্বর ২০১৭ বাংলাদেশের একক বৃহত্তম প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক জগতে পা রেখেছে।

 

সর্বশেষ খবর