রবিবার, ১৫ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রিন্টে বর্তমান, অনলাইনে ভবিষ্যৎ

মতিউর রহমান চৌধুরী, প্রধান সম্পাদক, দৈনিক মানবজমিন

প্রিন্টে বর্তমান, অনলাইনে ভবিষ্যৎ

কোনটি ফেক নিউজ, কোনটি ফটো শপের কারবার, সেটা বুঝতে হলে পাঠকরা প্রিন্টের কাছে ফিরে আসবে। ফিরে তাদের আসতে হবেই...

 

মিডিয়ার ল্যান্ডস্কেপটা দেখতে দেখতে কেমন বদলে গেল। ইদানীং এতটাই দ্রুত বদলায় যে, চোখে চোখে রাখার জো নেই। তাই একপ্রকার হাল ছেড়ে বসে আছি। অনেকের মতো হাতে তো মোবাইল ফোন থাকে। না চাইলেও কত জিনিস পড়া হয়, তার হিসাব কে রাখে। শুধু পড়াই বা বলি কেন, রূপ, রস, গন্ধ আছে, এমন কত খবর। দেখি, শুনি, অনুভব করি। এমনকি না জানার পণ করলেও রক্ষা নেই। দেখতে হবে, জানতে হবে, শুনতে হবে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ইতিমধ্যে ১০ কোটি পার হয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎটা কাদের তা আর বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই একটা কিন্তু থাকে। তাই মিডিয়ার হালফিল বা ভূত-ভবিষ্যৎ বুঝতে হলে এই কিন্তুটা মনে রাখতে হবে। সেটা হলো আমরা দীর্ঘকাল ইয়েলো জার্নালিজম বা হলুদ সাংবাদিকতা কথাটির সঙ্গে অভ্যস্ত থেকেছি। মুদ্রণ হরফে হলদে সাংবাদিকতার রূপটা কী, তা নিয়ে বিশ্বে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। কিন্তু কখনো কে কল্পনা করেছে, এই হলদে সাংবাদিকতাটাকে ‘ফেক নিউজ’ এসে মুহূর্তেই উধাও করে দেবে। লজ্জা দেবে। অবস্থা সত্যি বড় সঙ্গিন। ‘ফেক নিউজ’ শব্দটাই তার জ্বলন্ত সাক্ষী।

মুদ্রণ যুগে শত হোক, একটা রয়ে সয়ে ব্যাপার ছিল। সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন কিংবা তিলকে তাল করার একটা ব্যাপার ঘটত। মুদ্রণের রমরমা যুগেও তাই হলদে সাংবাদিকতা ছিল, সরাসরি ফেক নিউজ কথাটি কখনো ছিল না। সংবাদপত্রের সভ্যতায় কালো দাগ ছিল, কিন্তু সেটা এতটা নয় যে, পুরোপুরি মিথ্যা বা নির্জলা মিথ্যা নির্ভরতা কেউ সহজে কল্পনা করতে পারত। কিন্তু এখন সব সম্ভব। কি সম্ভব নয়, তার তালিকা করতে বসলে সেটাই হ্রস্ব হবে। তাই মুদ্রণ সংবাদপত্রের কাটতি বিশ্বজুড়ে কমছে বটে। কিন্তু সেটা কর্পূরের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে না। বরং খ্যাতনামা কিছু পত্রপত্রিকার মুদ্রণ সংস্করণ বন্ধ করে দেওয়ার পর তা পুনরায় চালু করার ঘটনাও ঘটেছে।

বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রচার, বিজ্ঞাপন কমছে। এবং তা এতটাই যে, গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি চলছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সেন্সরশিপের মাত্রা। রাষ্ট্র অবশ্যই ফেক নিউজের উত্থানে উতলা হবে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা রাষ্ট্রের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে একটা মস্ত দেয়াল তৈরি করেছে।

সত্য বটে, ডিজিটাল আইন বা এরকম ধাঁচের সাম্প্রতিক বিধিবিধানগুলোর প্রয়োগ কম। এখনো পর্যন্ত ‘ব্যাপকতা’ পায়নি। কিন্তু এটা একটা নতুন মনস্তাত্ত্বিক বাধার বিন্দাচল সৃষ্টি করেছে। এর প্রভাবে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সেলফ সেন্সরশিপ বেড়ে গেছে। তাই অনেকের মতে নতুন ডিজিটাল আইনের প্রয়োগ কম। এর মূল কারণ সেলফ সেন্সরশিপ বেড়ে যাওয়া।

কিছু সেন্সরশিপ সব সময় ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে বর্তমানের মিল নেই। এখন এটা দ্রুতলয়ে ওঠানামা করে। বোধগম্য কারণেই, কড়াকড়ি বা কালাকানুনের পরিমাণ বা গভীরতা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে উল্লেখযোগ্য মিডিয়ায় অনেক সময় দেখা যায়, তারা হয়তো কোনো খবরের ট্রিটমেন্ট কি হবে, সেটা বুঝেও তা দিতে অপারগ থাকে। সচেতন পাঠকরা একে অনেক সময় স্খলন বা বিচ্যুতি হিসেবে দেখেন। কিন্তু নিশ্চয় তারা তার ‘নিগূঢ় কারণ’ ঠিকই হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। কিন্তু সেজন্য তো পাঠক ছাড় দিতে প্রস্তুত নয়। সে কারণে পাঠক শুধুই ডিজিটাল যুগ দেখে মুদ্রণ খবরের কাগজ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন, তা বলা যাবে না। কারণ তারা জানেন, ফোনটা স্মার্ট, খবরটা স্মার্ট নয়।

এখন স্মার্ট সাংবাদিকতার যুগ। উপরন্তু বিশ্ব এখন ‘ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের’ যুগে প্রবেশ করছে। এখানে কিছু দিন পরেই ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ যুক্ত হবে। একটা উদাহরণ দেই, তারকা জগতে দুই দেশেই (বাংলাদেশ-ভারত) এ মুহূর্তের আলোচিত একটি বিয়ের খবর। একটি টিভিশোয়ে দুজনকেই প্রশ্ন করা হলো, প্রথম সাক্ষাৎ কীভাবে। পুরুষটির উত্তর : মার্ক জুকারবার্গের একটা ভূমিকা আছে। তিনি পরপর কয়েকটি দিন ধরে দেখেছিলেন, তার ফেসবুকে একজন নারীর প্রোফাইল বারংবার ভেসে আসছে। হঠাৎ অজানা নারীকে লিখে দিলেন, হাই। ব্যাস এই সূচনা। এভাবে অন্য আরও দশটা ক্ষেত্রে প্রথাগত চিন্তাভাবনা একদম বাতিল হচ্ছে।

আদালত কক্ষে বিচারকদের জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে সফটওয়্যার তৈরি হচ্ছে। কোনো একটি মামলার সব তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হবে, সফটওয়্যার থেকে একটা প্রাথমিক রায় বেরিয়ে আসবে। আপনি চোখের ডাক্তার দেখাতে গেলে দেখবেন। কিছুটা ডাক্তারি কর্তব্যরত সহকারীই সেরে ফেলছেন। মেশিন রিড করছে আপনার চোখ। চশমার পাওয়ার একটা যন্ত্রই বাতলে দিচ্ছে। এই যে প্রবণতা এর বাইরে থাকবে না ভবিষ্যতের সাংবাদিকতাও। সেখানে রোবট সাহেব বসে যাবে।

ভয়টা হলো ট্রানজিশন বা ক্রান্তিকালটা কেমন হবে। যারা সিসার হরফে শব্দ তৈরি করতেন, তারা কিন্তু কম্পিউটার আসার পর সোনালি করমর্দন পেয়েছেন। যারা নিজেদের বদলাতে পেরেছেন, তারাই টিকেছেন।

সংবাদপত্রের বড় বড় হাউসগুলো ইদানীং কাটছাঁটে যাচ্ছে। তারা একটা দীর্ঘকাল এমন দিন আসতে পারে, ভাবতে পারেনি। তবে ভরসা হলো সত্য ও সাহসী সাংবাদিকতা কোনো প্রযুক্তিই এসে হঠাতে পারবে না। বিশ্বের কোনো সভ্যতা আইন করে সাংবাদিকতার হাত-পা বাঁধতে পারেনি চিরকালের জন্য। এই অঞ্চলেও তা হবে না। এটা রোধে সর্বত্র উপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়ার তোড়জোড় চলছে।

সামনের যুগটা বেশি দক্ষতা, বেশি নৈপুণ্য, বেশি শিক্ষা অর্জনের। হিকির বেঙ্গল গেজেট ছাপা হওয়া এই অঞ্চলের উত্তর পুরুষদের জন্য আমি মনে করি আরও দায়িত্ব এবং আরও পাকাপোক্তভাবে সাংবাদিকতার চাহিদা বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ‘বাক স্বাধীনতা’ চলছে, সেটা বোধগম্যকারণেই একটা দীর্ঘসময় এলোমেলোভাবে চলবে। আর তখন পাঠকরা বিভ্রান্ত হবে। কোনটি ফেক নিউজ, কোনটি ফটোশপের কারবার, সেটা বুঝতে হলে পাঠকরা প্রিন্টের কাছে ফিরে আসবে। ফিরে তাদের আসতে হবেই। তবে হ্যাঁ সেজন্য যথেষ্ট যোগ্যতা অর্জন করতে হবে প্রিন্ট মাধ্যমকে।

প্রতি মুহূর্তে মানুষ যা ফেসবুকে, ভাইরালে, টিভিতে, ইউটিউবে দেখবে, ঠিক সেই জিনিসপত্রের বয়ান পরদিন তারা মুদ্রণে দেখতে চাইবেন না। এটা দেখাতে তাদের বাধ্য করা হলে সংবাদপত্র তারা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেবে।

ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনে একজন সাংবাদিক হবেন কিছুটা ইনক্রিডেবল হাল্ক খ্যাত সেই আমেরিকান রাজনীতিক আর্নল্ড শোয়ার্জনিগারের মতো। বাইরে পুরো দস্তুর, সুটেডবুটেড ভদ্রলোক। কিন্তু ভিতরে একটা রোবট রোবট ব্যাপার থাকবে। যন্ত্রকে পরাস্ত কিংবা তাকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেওয়ার মতো একটা মনোভঙ্গি।

প্রথাগত সেই চেনা সুরতের সাংবাদিকটি তিনি আর থাকবেন না। আরও একটি নতুন প্রতিযোগিতা সামনে। কথাটি কেউ খোলাখুলি বলেন না। সেটা হলো, একসময় স্বাধীন সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ছিল, দৈনিক বাংলা, দ্য টাইমস বা বিটিভির মতো গণমাধ্যম। তাদের বাজেটের চেয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিগ বাজেটে বিগ নিউজপেপার করতেন। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদ সংস্থাকে সহজে পাঠকরা চিনতেন।

সামনে রাষ্ট্র আরও শক্তি নিয়ে আসবে। তাদের ‘স্বাধীন মিডিয়া’ যদি ফেক নিউজ দেয়, তাহলেও পাঠকরা মুখ ঘুরাবে। কিন্তু তাতে ওইসব মিডিয়া হয়তো বিচলিত হবে না। কারণ তাদের ফান্ডিং নিশ্চিত। আপাতত হলেও সেটা আরও জটিল করে দিতে পারে প্রকৃত স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের পথচলা। এসবের জাঁতাকলে পড়ে পাঠকের সত্য জানার আগ্রহটা আরও চনমনে হবে। একটা সময় গেছে যখন বিবিসির খবর শুনতে মানুষ লাইন ধরত। সেই দিন নেই। এই কঠিন বাস্তবতার জন্য পাঠক-শ্রোতা সাময়িক মুখ ঘুরিয়েছে মাত্র। কিন্তু সত্য জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন। আর সেটা মেটাতে আসলে স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। তাই মনে হয় না, যে কখনো হারিয়ে যাবে প্রিন্ট বা সাংবাদিকতা।

প্রিন্টের সত্যনিষ্ঠ খবর মানুষ ই-পেপারে পড়তে চাইবে। সুতরাং সাংবাদিকতা রাখতে পারলে প্রিন্ট ও অনলাইন মুখোমুখি হবে না। হবে পরস্পরের পরিপূরক।

সর্বশেষ খবর