সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

আজকের সংবাদপত্র... আগামীকাল কী...?

ড. মো. গোলাম রহমান, শিক্ষাবিদ ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার

আজকের সংবাদপত্র... আগামীকাল কী...?

সাংবাদিকতাকে ‘দ্রুততার সাহিত্য’ বলে অভিহিত করা হতো, তার পরও এ গতি অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছে না...

 

প্রতিদিন সকালে শুভাগত অতিথির মতো খবরের কাগজ এসে উপস্থিত হয় নাশতার টেবিলে। সম্প্রতি এ অভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনের পর্দায়  ই-পেপার কিংবা নিউজ অ্যালার্ট। বাস্তবতার এ পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে আমাদের জীবনাচরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নতুনত্ব মানুষের জীবনে খুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। এদিকে সৃষ্টি হয়েছে গণমাধ্যম পরিবেশনের নতুন চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে এ পরিবর্তন অতিদ্রুত ঘটে যাচ্ছে।

ইউনেস্কো প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ডস ইন ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন অ্যান্ড মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক ২০১৮-এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো ছাড়া বিশ্বের সব দেশে মুদ্রিত পত্র-পত্রিকার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে মুদ্রিত সংবাদপত্রের সার্কুলেশন উল্লেখযোগ্যভাবে না কমলেও খুব বেশি বাড়েনি। পাশাপাশি ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদপত্র কিংবা সংবাদ পাঠ করার প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। মুদ্রিত সংবাদপত্রের সনাতনী পাঠক কমে যাওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করে ইতিমধ্যে সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রকাশকরা তাদের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করে চলেছেন।

ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদপত্র এবং নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাবৎ সংবাদপত্রের কনটেন্ট বা আধেয় পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। নতুন কনটেন্টের খোঁজে প্রতিনিয়ত চুল ছিঁড়ছেন সাংবাদিক তথা সংশ্লিষ্টজনরা। একই সঙ্গে সংবাদপত্র, ভিডিও, ছবি সবকিছু আপলোড করা হচ্ছে। সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন আর আগের মতো নিজস্ব মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকছে না। ইদানীং রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র কিংবা কোনো ওয়েব পোর্টাল- সবাই সব ধরনের কনটেন্ট আপলোড করছে। কোনো মিডিয়ারই নিজস্ব ধারায় অনন্য থাকার অবস্থাটি আর থাকছে না। বিশ্বের সর্বত্র একই ট্রেন্ড।

চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ছবি কিংবা ভিডিও আপলোড করার ক্ষেত্রে গতিসম্পন্ন অ্যাপস এবং সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহার করা, কারণ টেক্সট খুব দ্রুত আপলোড হয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভিডিও কিংবা স্টিল ছবি আপলোড ডাউনলোড করা যাচ্ছে না। এদিকে আবার টিভি কিংবা রেডিও আগের মতো শুধু ভিডিও কিংবা অডিও সম্প্রচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে ওয়েবসাইটে ব্যবহার করে কাজটি করে চলেছে। এতে সবকিছু ইন্টারনেট কিংবা ওয়েববেইজড হয়ে যাচ্ছে। রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র কেউ তার নিজের ট্র্যাডিশনাল কনটেন্ট পরিবেশন করে সন্তুষ্ট নয়। দেখা যাচ্ছে, আগাম পরিবর্তন অনস্বীকার্য ধরে নিয়ে নতুন ধারায় এগোচ্ছে সবাই। সনাতনী গণমাধ্যমের অবয়ব পাল্টে যাচ্ছে, কারণ ট্র্যাডিশনাল টিভি, রেডিও, সংবাদপত্রের ব্যবহার এবং শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের আচার-আচরণও পাল্টে যাচ্ছে। স্মার্টফোনের সবকিছু একসঙ্গে ব্যবহারকারীর ইচ্ছামতো এসে হাজির হচ্ছে কিংবা ব্যবহারকারী তার পছন্দের মাত্রা অনুযায়ী সেভাবে কাস্টমাইজ করতে পারছে। সেই সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে কিংবা নিউমিডিয়ার ব্যবহারও নিশ্চিত হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমের যে শক্তিমত্তা ও আকর্ষণ করার ক্ষমতা এবং ব্যবহারকরীকে এনগেইজড রাখার যে কৌশল তা শুধু ব্যবহারীকে প্রলুব্ধ করার মধ্যেই সীমিত নয়, বরং ব্যবহারকারীর অগ্রাধিকার তার পছন্দ-অপছন্দ প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সুবিধা-অসুবিধার নানারকম বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে এলগরিদমের ভিত্তিতে সেবা দেওয়া হয়। এ সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ব্যবহার করা হচ্ছে।

মানুষের মনোজাগতিক বিষয়ের সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে এলগরিদমের সাহায্যে অডিয়েন্সকে সেবা দেওয়ার প্রচেষ্টা। সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা মূলত অডিয়েন্সকে সন্তুষ্টি প্রদান করা এবং বিনিময়ে সেবার মূল্যমান আদায় করে ব্যবসা নিশ্চিত করা। বিভিন্ন বয়স, পেশা, নেশা, ভালোবাসা, মন্দলাগা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন ইত্যাদির প্রবণতা সমীক্ষা করে এলগরিদম কাজ করে। ব্যবহারকারীর মনের অভ্যন্তরীণ কোণে এসে আঘাত করে জাদুকরী সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় সেবা যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হিসেবে স্থান করে নেয় অডিয়েন্স ব্যবহারকারীর মনে। যে কারণে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর মনের গভীরে জায়গা করে নিতে পারে। ইতিপূর্বে মানুষের মনের কথা প্রকাশ কিংবা কারও সঙ্গে শেয়ার করার এত বড় সুযোগ ছিল না। গণমাধ্যমে নির্দিষ্টসংখ্যক সাংবাদিক বা লেখকের পরিবেশনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাংবাদিকরা যা ভালো মনে করেন শুধু তাই উপস্থাপন করেন, কালে-ভদ্রে দু-একজন দর্শক-শ্রোতা, পাঠক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিংবা তার মতামত জানায়। এ প্রচলিত পদ্ধতিতে ইন্টারনেট এবং আধুনিক প্রযুক্তি সব সীমারেখা পেরিয়ে ‘মাল্টিডিরেকশনাল’ বার্তা প্রেরণ ও গ্রহণ করে। যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে বিশ্বের অন্য যে কোনো প্রান্তে তার মনের কথা ব্যক্ত কিংবা মত প্রকাশ করে চলেছে। কখনো কখনো সেগুলো শুধু মতামত নয়, প্রেরণাদায়ক এবং সচেতনতামূলক কিংবা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণমূলক। কখনো আবার নিরেট বিনোদনধর্মী। বিনোদন কিংবা নির্মল আনন্দ প্রদানের জন্য সামাজিক মাধ্যম যথেষ্ট অবদান রাখছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও ব্যবহার নিশ্চিতভাবে মানুষকে সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ করে দিচ্ছে। শিক্ষামূলক ও গবেষণালব্ধ অনেক তথ্য খুব সহজে পাওয়া যাচ্ছে। এসবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ-প্রগতির ধারা যেমন অব্যাহত থাকে তেমন ব্যক্তিজীবনও অনেক কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়। এদিকে চ্যালেঞ্জ থেকে যায় যে, একজন ব্যক্তি ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহারে নিজেকে কীভাবে পরিচালনা করে। অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের অপব্যবহার, প্রযুক্তির এ সম্ভাবনাকে হালকা বিনোদন কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহারের কারণে তার মেধা-মনন-সময় এসব কিছুর অপব্যবহারই হয়। রাতজাগা থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনের অনিয়ম চূড়ান্ত অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। অসতর্ক এবং বিশৃঙ্খল জীবনাচার মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রণ কিংবা শৃঙ্খলাবোধ পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনধারাকে হুমকির মুখোমুখি করে তোলে।

গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র, রেডিও কিংবা টেলিভিশন যেভাবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করে এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে একটি আদর্শিক স্থান থেকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তার ফলে পাঠক-শ্রোতা-দর্শক এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে পারেন। বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যম হিসেবে তাদের জবাবদিহি আদায় করতে পারেন। ইদানীং সব সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ওয়েবসাইট রয়েছে, তারা নির্ভরযোগ্যতার সঙ্গেই আগের মতো প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করে চলেছে। কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অগণিত ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম। এসব ভুঁইফোঁড় ওয়েবসাইট সামাজিক মাধ্যম ব্যবহকারীদের প্রতারিত করে।

সংবাদপত্র খুব বেশিদিন এ ফরম্যাটে চালু থাকবে বলে মনে হয় না। সময়ের ধাবমান পরিবর্তনে ইন্টারনেট সবার জীবনকে প্রভাবিত করবে, তা অনুমান করা যায়। ইন্টারনেটভিত্তিক পরিবর্তিত সমাজে সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের ফরম্যাট ও কনটেন্ট পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সাংবাদিকতাকে ‘দ্রুততার সাহিত্য’ বলে অভিহিত করা হতো, তার পরও এ গতি অন্যান্য মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারছে না। অসম এ প্রতিযোগিতায় গণমাধ্যমের কনটেন্ট গতানুগতিক সংবাদ কিংবা বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যারা কনটেন্ট প্ল্যান তৈরি করবেন তাদের সুযোগ যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাও প্রয়োগ করতে হবে। অডিয়েন্সের রুচি ও চাহিদার জোগান দিতে প্রতিনিয়ত কনটেন্ট মেকারকে নতুনতর বিষয় এবং শৈলীর আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। ‘ইনোভেটিভ’ কনটেন্টের চাহিদা সংগত কারণেই সমাদৃত হবে। নেটভিত্তিক কর্মকা- প্রচলিত গণমাধ্যমের নতুনতর আঙ্গিকে পরিবেশিত হবে, একই সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য এবং জবাবদিহিমূলক সংবাদ ও তার যৌক্তিক বিশ্লেষণ পাঠক-শ্রোতা-দর্শক প্রত্যাশা করবে। তারা সঠিক, নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও বিশ্লেষণ পেতে চাইবে। সেসব যে শুধু বর্তমানে প্রচলিত মাধ্যমগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তেমন ভাবনা না থাকাই ভালো। সাম্প্রতিক জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমগুলো ঠিক একইভাবে আগামী দিনে না-ও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহজলভ্য আরও গতিশীল মাধ্যম এবং অ্যাপস চালু হবে। আরও প্রতিযোগিতামূলক সামাজিক মাধ্যম আত্মপ্রকাশ করবে। ওয়েবসাইট কিংবা ইন্টারনেটভিত্তিক জীবনাচার সমাজে ঘনীভূত হবে। অনেক বেশি মানুষ নেটভিত্তিক জীবন-জীবিকার ওপর নির্ভরশীল হবে। অনেক বেশি মানুষ কনটেন্ট তৈরি ও এসব জোগান দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকবে, এটাই অনুমেয়।

প্রাতিষ্ঠানিক গণমাধ্যমের সংখ্যা সীমিত হয়ে যাবে বলে মনে হয়, কিন্তু একই সঙ্গে বৃহৎ ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে সমাদৃত হতে পারে এবং অডিয়েন্স বা ভোক্তাদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা স্থায়ী হতে পারে। দায়িত্বশীল আচরণ না করলে কোনো মাধ্যমই স্থায়ী হবে না। সে ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমগুলোর কোনো কোনোটি হয়তো জনরোষের মুখোমুখি পড়বে। আর প্রাতিষ্ঠানিক অনলাইন মাধ্যমগুলো পোক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। ইন্টারনেটভিত্তিক সংস্কৃতির প্রসার সম্ভবত সামাজিক জীবনকে সমন্বয় করার নতুন প্রয়াস পাবে। মানুষের ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক জীবনকে নতুন মাত্রায় সাজানোর কাজেও নতুন কনটেন্ট তৈরির প্রতিযোগিতা হবে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন চাহিদার বিভাজন নতুন দিকনির্দেশ করবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশ-কাল-পাত্রের বিভেদ ঘুচে যাবে। সবর্জনীনতা ও বহুত্ববাদ স্ব স্ব স্থানে বিস্তৃতি লাভ করবে। দেখা যাক, সময় কোন দিকে ধাবিত করে আমাদের জীবন...

সর্বশেষ খবর