সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

নারীনীতি ও ক্ষমতায়ন

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নারীনীতি ও ক্ষমতায়ন

বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে কীভাবে নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে আইন প্রয়োগ করে নারীর ক্ষমতাবিধান নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা এখনো নেই...

 

নারীকে উন্নয়নের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ CEDAW (The Convention on the Elimination of all Forms of Discrimination against Women) -এর আলোকে ১৯৯৭ সালে প্রথম নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে। এ নীতির মাধ্যমে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের পাশাপাশি সম্পদ, উত্তরাধিকার ও ভূমির ওপর নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয় (ধারা ৭.২)। ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করে জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুুরুষ সমতা নিশ্চিত করা; নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; নারীকে শিক্ষিত, দক্ষ জনশক্তি ও মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা; নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসা; নারীর সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি জোট সরকার কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে ২০০৪ সালে নারীনীতি সংশোধন করে ৭.২ ধারা বাতিল করে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ’৯৭-এর পটভূমি থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়া ও বিএনপি সরকারের কর্মকা- যুক্ত করা হয়। পুরনো নীতির পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুর কথা উল্লেখ ছিল এভাবে- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সমর্থনে রচিত সংবিধানে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সত্তর দশকের প্রথম ভাগ থেকেই তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার নারী উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক বাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের ত্যাগকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় করে রাখার জন্য “বীরাঙ্গনা” উপাধিতে ভূষিত করেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের প্রচেষ্টায় ১০ জন বীরাঙ্গনা নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নারীর প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে নারীর অন্তর্ভুক্তি তথা উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারীকে সম্পৃক্ত করার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’ এসব তথ্য বাদ দিয়ে সংশোধিত নীতির পটভূমিতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নানাবিধ স্তুতি প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ’৯৭ নারীনীতিতে ফেরত আসতে চাইলে বায়তুল মোকাররম মসজিদে জুমার নামাজের পর তৎকালীন নারী উপদেষ্টাকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে নারীনীতি ’৯৭-এর আলোকে নারীনীতি তৈরির চেষ্টা চালায়। নারীনীতি ২০১১ প্রণীত হয়। কিন্তু সম্পদের উত্তরাধিকার বণ্টনে সমঅধিকার বাদ দেওয়া হয়। তাই একনাগাড়ে তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সমাজ ও সাংবিধানিক পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ কী কী প্রক্রিয়ায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইনসমূহের সংশোধনে পদক্ষেপ নেবে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আমরা এখনো পাইনি। তা ছাড়া বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে কীভাবে নারী-পুরুষের সমতা আনয়নে আইন প্রয়োগ করে নারীর ক্ষমতাবিধান নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা এখনো নেই। যদিও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন; কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোগত ব্যবস্থা নারীসমাজকে বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন করেছে। ইরাক, সোমালিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ার মতো মুসলিম দেশে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত। ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ যেমন প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও অভিবাসী নারী শ্রমিকদের প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত করেছে যা আগে ছিল না। বাংলাদেশ সরকার এখনো CEDAW -র দুটি ধারা যা নারীর বিবাহবিচ্ছেদ ও সম্পত্তিতে অধিকারসংক্রান্ত, তা প্রয়োগ করেনি। CEDAW -র অন্য ধারাগুলোও নারী উন্নয়নে নীতিনির্ধারণে বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন।

শ্রমবাজারে নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি সত্ত্বেও ঘরে ও বাইরে নারীর প্রতি বৈষম্য, অন্যায় ও সহিংসতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে ২০১৮-এর তুলনায় ৯৩ শতাংশ বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে; যা নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতাকে নির্দেশ করে।

নারী নির্যাতনের আরেকটি নতুন মাধ্যম ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, চ্যাটবক্স, ইমেইল, স্কাইপ) প্রাপ্তবয়স্ক এবং কন্যাশিশুরা মনস্তাত্ত্বিক ও দৈহিক লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে যে, ৭৮ শতাংশ নারী জাল পর্নোগ্রাফির শিকার। সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ৫২০টি কেসের মধ্যে ৯০টি নারীর কেস আছে। যদিও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সেকশন ৫৭ অনুযায়ী রাষ্ট্র কর্তৃক গ্রহণযোগ্য নয় এমন ও অশ্লীল বক্তব্য অপরাধের শামিল এবং ১০ বছর কারাদ-, যা অনাদায়ে ১ কোটি টাকা জরিমানা। লক্ষণীয় যে, এ আইনটি ব্লগারদের বিরুদ্ধে তাদের ব্লগে প্রকাশিত মতামতকে অশ্লীলতা বলে রুলস/রেগুলেশনস ছাড়া ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে নয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ডিজিটাল ক্রাইমের গতিপথ অনুসরণ করায় কোনো সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি, ফলে নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতা বাড়ছে।

এ-জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন। যদিও মূলধারার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, কদাচিৎ সংসদে সংরক্ষিত আসনের নারীরা নারীর সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কঠিন প্রশ্নের অবতারণা করেন। সংরক্ষিত আসনের নারীরা কেবলই স্থিতাবস্থা বজায় রাখেন। নারী প্রতিনিধিদের সীমিত অংশগ্রহণ রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হচ্ছে না। ১৯৭২ সালে নারীদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসন ছিল জাতীয় সংসদে। ১৯৯০ সালে সংরক্ষিত আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩০টি, ২০০৪-এ ৪৫ এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ৫০টি। সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের মূলধারার রাজনীতি ও ভোটার সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। বরং সংসদে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের নির্বাচিত করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৭২টিতে নারী সদস্য এসেছেন, যাদের ৫০ জন সংরক্ষিত আসনে ও মাত্র ২২ জন নির্বাচিত। এ ক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক সক্রিয়তা বাড়াতে জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ নির্বাচিত হওয়া প্রয়োজন।

এ ছাড়া ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম মৃত্যুর পর সংবিধান সংশোধন করে বাংলাদেশের নাগরিকদের ‘বাঙালি’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সংবিধানের চেতনা নস্যাৎ করা হয়। এই সাংবিধানিক পরিবর্তন নারীর সার্বিক প্রগতিশীল উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জেনারেল জিয়ার সেই ‘বাংলাদেশি’ নাগরিকত্বের ভিত্তিমূল ছিল উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ; যার ধারাবাহিকতায় জিয়ার শাসনামলে ’৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিসমূহ পরিবর্তন করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কাঠামো নারীর ক্ষমতায়নে সহায়ক। নায়লা কবীর (১৯৯১)-এর মতে, বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কাঠামো ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর আদলে নয়, বরং নারী উন্নয়নের সহায়ক।

বিভিন্ন সময়ের নারী আন্দোলনের প্রতিফলন হচ্ছে বর্তমানের জাতীয় নারীনীতি ও বিভিন্ন আইন। বিভিন্ন নারী সংগঠন ও আইনগত সহায়তা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির সমঅধিকার দাবি করে সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেছে। নারীর সত্যিকারের উন্নয়নের জন্য অসাম্প্রদায়িক উদ্যোগ প্রশংসনীয় হবে। ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে থেকে বাংলাদেশের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে নারীনীতি সংস্কার প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন সম্ভব হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর