সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ভারতীয় মিডিয়া যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে

গৌতম লাহিড়ী, সিনিয়র সাংবাদিক, দিল্লি, ভারত

ভারতীয় মিডিয়া যে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে

অধিকাংশ মিডিয়াকর্মী এখনো সত্য প্রতিবেদন প্রকাশ করার পক্ষে এবং আপাতনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন...

 

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনাই দেখা যেত না গণমাধ্যমে। একতরফা প্রচারে নেহরু নিজে এতই বিব্রত ছিলেন যে, নিজেই প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে ছদ্মনামে ‘সম্পাদক সমীপেষু’ কলামে চিঠি লিখতে শুরু করেন এবং প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেই পাঠকদের কাছে প্রশ্ন তুলতেন- ‘কী করছেন নেহরু? দেশকে রসাতলে নিয়ে যাবেন?’ ফলে দেশজুড়ে শুরু হতো বিতর্ক। এমনই এক বাতালাপের আবহ তৈরি করেছিলেন নেহরু। আজও প্রবীণ সাংবাদিকদের কাছে সেসব দিনের ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা শুনেছি। কিন্তু সত্তর বছর পর সেই গণমাধ্যমের হাল কী?’

যখন এ প্রতিবেদন তৈরি করছি, তখন রাজধানী দিল্লির উত্তর-পূর্ব ও সংলগ্ন লোকালয় নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত। সে ঘটনার সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়ে গণমাধ্যমের কর্মীরাই আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন। উভয় সম্প্রদায়ের দাঙ্গাবাজরা সাংবাদিকদের ধর্মীয় পরিচয় জানাতে বাধ্য করেছেন। এ ঘটনা সাম্প্রতিক ভারতে ঘটেছে কিনা সন্দেহ। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভারতে এই প্রথম মিডিয়ার মধ্যেও মেরুকরণ ঘটেছে। অধিকাংশ মিডিয়াকর্মী এখনো সত্য প্রতিবেদন প্রকাশ করার পক্ষে এবং আপাতনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মধ্যে আরও একটি মেরুকরণ ঘটে গিয়েছে। শাসক দলের পক্ষে ও বিপক্ষে। এমনকি শাসক দলের আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ্যে প্রকাশ করছে মিডিয়ার একাংশ। যারা তার বিরোধিতা করছেন বা বিরোধিতার রিপোর্ট করছেন, মন্ত্রী-আমলার আগে অনুগত মিডিয়াকর্মীই তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনছেন প্রাইম টাইম টিভি টক শোয়। সমালোচনাকেই বলা হচ্ছে, দেশবিরোধিতা। সাংবাদিকতার এ অধঃপতন আগে দেখা যায়নি।

২০১৪ সালে বিপুল মানুষের সমর্থন নিয়ে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন। সে সময় গণমাধ্যমের কর্মীরা অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অকপট কথনে। মোদি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি আমার সরকারের কাজের সমালোচনা হোক। সমালোচনা না হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয় না।’ সেই মোদি ফের ২০১৯ সালে আরও বেশি সমর্থন নিয়ে ফিরে এলেন দ্বিতীয়বারের জন্য। কিন্তু তত দিনে পরিবেশ বদলে গিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রধানমন্ত্রী মোদি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি একটিও সংবাদ সম্মেলন করেননি। বাছাই করা সাংবাদিকদের তিনি সাক্ষাৎকার দেন। ইদানীং সরকারের প্রধান দফতরগুলোয় সাংবাদিকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

শুনেছি, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কভারেজ নিয়ে মোদি দিল্লির সাংবাদিকদের ওপর বেজায় অসন্তুষ্ট। সে অসন্তোষ এখনো যায়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি বিদেশ সফর করলে বেসরকারি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যান না। যেটা ভারতের সব প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীরা করতেন। এখন তো রাষ্ট্রপতিও সাংবাদিকদের সফরসঙ্গী করেন না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী একবার ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘আগে বিদেশ সফরে বহু অপচয় হতো। অনেক সম্পাদক-মালিক সফরের সুযোগে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ পূরণে সে সফরগুলো ব্যবহার কবতেন।’ এটা একেবারে যে অসত্য তা নয়। আমি নিজে বহু প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি।

সম্পাদক-মালিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে সপরিবারেও ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু শিশুর রোগ প্রতিকারের জন্য বাথটাবটাও ফেলে দিতে হবে? আদতে সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরের সুযোগে কথা বলার সুযোগ পেতেন।

সচিব আমলাদের সঙ্গে বাতালাপ করে বহু বিষয় সম্পর্কে সঠিক তথ্য পেতেন। তাতে সরকারেরই লাভ হতো। যেমন ইদানীং প্রধানমন্ত্রী মোদি নাগরিক আইন নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের ভূমিকায় নাকি অসন্তুষ্ট। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আজ পর্যন্ত কোনো দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করেছেন কি কেন এই আইনের ভারতে প্রয়োজনীয়তা ছিল? একতরফা ঘোষণা করবেন তাঁরা আর সবাই চোখ বুঝে সমর্থন করবে এটা হয় কি গণতন্ত্রে? আমার জীবনে প্রথম বিদেশ সফর প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তদানীন্তন বর্মায়। কনিষ্ঠতম সাংবাদিক হিসেবে আদব-কায়দা কিছুই জানতাম না। ফরমাল পোশাক প্রয়োজন হয় সরকারি অনুষ্ঠানে। সিনিয়ররা সবাই সুটেড-বুটেড। রাজীব গান্ধী প্রত্যেকের সঙ্গে বিমানে মিলিত হতেন। লক্ষ্য করেছিলেন আমার মতো গেঁয়ো পত্রকারকে। সফরসঙ্গী মন্ত্রী মণিশংকর আয়ারকে দিয়ে বার্তা পাঠিয়েছিলেন আমি যেন রেঙ্গুনের বাজার থেকে বর্মার জাতীয় পোশাক কিনে নি। লুঙ্গি-কুর্তা। সেই পরে হাজির হয়েছিলাম মেইনরিসেপসানে। পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন পরে। অটল বিহারি বাজপেয়ি নিজে ভোজনরসিক। তাই বিদেশে গেলে সাংবাদিকদের নিয়ে সেখানকার রেস্টুরেন্টে চলে যেতেন খেতে। লালকৃষ্ণ আদভানি অবশ্য ততটা উদার ছিলেন না, তিনি পছন্দের সাংবাদিক না হলে সফরসঙ্গী করতেন না। আজ মোদিই আদভানির পথে চলছেন। কিন্তু আদভানি কোণঠাসা। স্বল্পবাক বলে পরিচিত মনমোহন সিং নিয়ে সাংবাদিকরা যত সমালোচনা করেছেন সবই বিদেশ সফরের সময়ে। এক সাংবাদিক তো প্রশ্ন করে বসল- আপনি কেন রাহুল গান্ধীর জন্য প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ছেন না। পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উপরে আকাশে বিমানের মধ্যে দেওয়া মনমোহনের জবাব সেদিন সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল : রাহুলের জন্য মনমোহন প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে রাজি। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন শহরে প্রায় ২০০ সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৪০ জন। এটা কেবল যে একমাত্র বর্তমান মোদি রাজ্যেই হচ্ছে তা নয়। আগেও হয়েছে। ২০১০ সালের আগে যে ৩০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, তার মধ্যে দোষীদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনা মাত্র তিন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে জরুরি অবস্থার কাহিনী সবারই জানা। সংবাদমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। কিন্তু পরে ইন্দিরা গান্ধী ভুল স্বীকার করেছিলেন। এখন নিষেধাজ্ঞার প্রয়োজন হয়নি। কেননা, গণমাধ্যম নিজেরাই নিজেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কয়েক দিন আগে এক প্রথম সারির টেলিভিশনের সরকার ভক্ত সাংবাদিকের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনা হচ্ছিল। অকপটে তিনি স্বীকার করলেন, চাকরি বজায় রাখতেই তাকে সরকারের গুণগান করতে হচ্ছে। নইলে তিনিও জানেন, যা হচ্ছে সব ঠিক নয়। এ তো গেল গণমাধ্যমের কর্মীদের সুখ-দুঃখের বারোমাস্যা। ভারতের আর্থিক প্রবৃদ্ধি যেমন যেমন কমছে তেমন তেমন সংকটে গণমাধ্যম। গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে তিন হাজার সাংবাদিক কর্মচ্যুত হয়েছেন। গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। সংবাদপত্র-টেলিভিশন সবারই হাল এক। হাতেগোনা সংবাদমাধ্যম ছাড়া সবারই রাজস্ব হ্রাস হয়েছে। আর্থিক বিকাশ কমার অর্থ বিজ্ঞাপন কমেছে। অনেক গণমাধ্যম ডিজিটাল মিডিয়াকে ভবিষ্যৎ মিডিয়া ধরে নিয়ে তাতে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। তাতে ভিড় এত বেড়েছে যে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এককথায় নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা এবং আর্থিক মন্দায় জর্জরিত ভারতীয় গণমাধ্যম। তাই যারা রাজস্ব দেবেন তাদের হয়ে জো-হুজুরি প্রতিবেদন লিখেই সাংবাদিক পরিচয় বজায় রাখছে গণমাধ্যম। বিশ্বের গণমাধ্যমের সূচকে ভারতীয় গণমাধ্যমের স্থান অনেক নেমে গেছে। এমনকি বাংলাদেশও ভারতের উপরে স্থান পেয়েছে।  ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সময়ের সাংবাদিকরা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের উত্তরসূরিদের হাল দেখে যারপরনাই দুঃখিত হতেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সর্বশেষ খবর