বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বৈশ্বিক বাস্তবতা ও একবিংশ শতাব্দীতে মিডিয়ার ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী

বৈশ্বিক বাস্তবতা ও একবিংশ শতাব্দীতে মিডিয়ার ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ

বৈশ্বিক পরিসরে হোক বা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হোক সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা...

 

এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, সবকিছুর কেন্দ্রে ব্যক্তি মানুষ- ব্যক্তি নারী ও ব্যক্তি পুরুষ। নারী ও পুরুষের সম্মতিতে, বন্ধনে ও সম্মিলনে পরিবার। পরিবার থেকে সমাজ; সমাজ থেকে রাষ্ট্র। এ সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই সরকার; আর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো নিয়েই আন্তর্জাতিক পরিম-ল এবং বৈশ্বিক বিস্তৃতি ও বৈশ্বিক বাস্তবতা। আপাতত বর্তমান বিশ্ব করোনাভাইরাসের কারণে সতর্ক, উৎকণ্ঠিত ও প্রবলভাবে আতঙ্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী বলে ঘোষণা করেছে। এর আগে-পরে বিশ্ব যেসব সমস্যায় আক্রান্ত ও ভারাক্রান্ত ছিল ও আছে, সেগুলো হচ্ছে- সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনবাসীর নির্মম ও ধারাবাহিক নিগ্রহ, ধর্মীয় জঙ্গিবাদ, সৌদি কর্তৃক ইয়েমেন হামলা, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, বৈশ্বিক অভিবাসী সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ও আবহাওয়া পরিবর্তন, চীন-আমেরিকা ও ইরান-আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি।

এর বাইরে বিশ্বের দেশে দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলো স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে ও যথেচ্ছাচার করছে। এতে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ছে,  জনগণের মানবাধিকার সংকুচিত হচ্ছে এবং পশ্চিমের উদার গণতন্ত্রের মডেলটি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভারতের মোদি, তুরস্কের এরদোগান, ফিলিপাইনের দুতার্তে, ইরানের খামেনি, ব্রিটেনের জনসনসহ বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে মহাপরাক্রমশালী সরকার ও সরকারপ্রধানের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে উদার গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া ও ব্রিটেনে বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রী হওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে।

প্রতিবেশী দেশে মোদি-অমিত শাহদ্বয়ী ও তাদের সহযোগীরা যেভাবে মহাত্মা গান্ধী, নেহরু, সুভাষ বসু ও মওলানা আজাদদের হাতে গড়া বহুত্ববাদী ও উদার গণতন্ত্রের দেশ ভারতকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে তৎপর হয়েছেন; তাতে করে শুধু ভারতের অভ্যন্তরেই নয়, বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ চলছে। সম্প্রতি দিল্লির ‘মাস মার্ডার’ বা জনহত্যা রাষ্ট্রীয় মদদে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রাম্প-মোদি জুটি বিশ্বকে উগ্রতা, বর্ণবাদ ও রক্ষণশীলতার দিকে নিয়ে চলেছেন বলে অনেক বিশ্লেষক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ‘ব্রেক্সিট’ ও ইউরোপের দেশে দেশে অভিবাসী ও মুসলিমবিরোধী মনোভাব ও রক্ষণশীলদের উত্থান পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এ রকম এক বৈশ্বিক বাস্তবতায় কেমন চলছে সাংবাদিকতা? তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বশেষ খবর, কলাম ও বিশ্লেষণ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে হাজার হাজার অনলাইন নিউজ পোর্টাল। গণমাধ্যমের আদি ও প্রধান মাধ্যম ছাপা পত্রিকাসহ আজ যেসব মাধ্যমে খবর, খবরের ভিতরের খবর ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়, সে মাধ্যমগুলো হচ্ছে- রেডিও, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন ও ইন্টারনেট। তবে সাংবাদিকতা বলতে আমরা মূলত ছাপা কাগজের সাংবাদিকতাকেই বুঝতাম। এখন এর সঙ্গে ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকতাও যুক্ত হয়েছে; এবং সাংবাদিকতা যে কোনো মাধ্যমেই হোক, অর্থাৎ ছাপা কাগজ, টেলিভিশন বা অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকতা, তার প্রত্যেকটিতেই রয়েছে নানারকমের ঝুঁকি। এ ঝুঁকির ধরন, মাত্রা, বৈশিষ্ট্য ও ভয়াবহতা ভিন্ন। ব্যক্তি সাংবাদিকের ঝুঁকি এক ধরনের, সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাপা কাগজ, সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পেপারের ঝুঁকি ভিন্ন ধরনের। আবার সাধারণ ঝুঁকির বাইরে নারী সাংবাদিকের রয়েছে অতিরিক্ত কিছু ঝুঁকি।

 

দুই.

বৈশ্বিক পরিসরে হোক বা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হোক সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা। ছাপা কাগজ বা টেলিভিশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকেরা নানা ধরনের প্রতিবেদনের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেন, সংগৃহীত তথ্যটি যাচাই-বাছাই করেন, সম্পাদনার পর প্রতিবেদনটি ছাপা হয়ে পাঠকের কাছে যায় বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে সেটি অগণিত দর্শক দেখতে পান- এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা (দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা) না থাকলে, ওই প্রতিবেদনের অকাট্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সরকারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী সাংবাদিক ও সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের সততা, শুদ্ধাচার ও বস্তুনিষ্ঠতা।

বস্তুনিষ্ঠতা ও অকাট্যতা নিশ্চিত করে সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে সাংবাদিক এবং সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারেন। পরিবেশিত সংবাদের মধ্য দিয়ে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ অথবা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ ক্ষুণœ হলে বা কোনো সিন্ডিকেট বা মাফিয়া চক্রের অপরাধ উন্মোচিত হলে, ব্যক্তি সাংবাদিকের নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে, এমনকি তিনি প্রাণনাশের শিকার হতে পারেন। বৈশ্বিক মিডিয়া ওয়াচডগ দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৩ বছরে (১৯৯২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশে ২৭ জন সাংবাদিক ও ফ্রি-ল্যান্সারকে হত্যা করা হয়েছে।

সিপিজে এই ২৭ জন সাংবাদিককে হত্যার ‘মোটিভ’ কি ছিল সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে এবং জানার চেষ্টা করেছে যে, হত্যাকা-গুলো সাংবাদিকতা সংক্রান্ত কাজের জন্য হয়েছিল, নাকি ব্যক্তিগত বা অন্য কোনো কারণে হয়েছিল। দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানায় যে, হত্যার শিকার হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে ১৯ জনের হত্যার ‘মোটিভ’ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে, কিন্তু ৮ জনের হত্যার ‘মোটিভ’ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। উল্লেখ্য যে, এ হত্যাকান্ড গুলোর মধ্যে দু’ চারটি ছাড়া সব হত্যাকান্ডের বিচারও হয়নি, ফলে হত্যাকারী এবং এর মাস্টারমাইন্ডরা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তিন.

প্রত্যেকটি সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পলিসি আছে; আবার অনেক মিডিয়া কোনো দল, মতবাদ, ধর্ম বা গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করে। তবে সংবাদ, সংবাদের বিশ্লেষণ ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা, সততা ও দায়িত্বশীল হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা খবর প্রকাশ করা হয় বা কোনো সরকার বা বৈশ্বিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য মিডিয়া প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা, পাঠকের প্রতি দায়বদ্ধতা ও শুদ্ধাচার বা ‘ইন্টেগ্রিটি’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হোসেনের কাছে ‘উইপনস অব মাস ডেসট্রাকশন’ থাকা নিয়ে বিবিসি, সিএনএনসহ সমগ্র পশ্চিমা মিডিয়া দিনের পর দিন যে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছিল; সারা বিশ্বের মিডিয়া জগতের রোল মডেল বলে স্বীকৃত ইউরোপ আমেরিকার গণমাধ্যম বুশ-ব্লেয়ারের সহযোগী হিসেবে যে ন্যক্কারজনক প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল, সেটি ছিল সাংবাদিকতা ও বৈশ্বিক গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক ঘোর কৃষ্ণ অধ্যায়। এর ফলে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে পড়েছিল পশ্চিমা মিডিয়া। আর এতে একদিকে পশ্চিমা দুনিয়ার তেল-স্বার্থ রক্ষা পায়; অন্যদিকে ধ্বংসস্তূূপে পরিণত হয় কয়েক হাজার বছরের পুরনো ব্যাবিলন সভ্যতা। ইসলামী জঙ্গিবাদ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের ভূমিকা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার পলিসি ও পরিবেশিত সংবাদও একদেশদর্শী ও পক্ষপাতদুষ্ট।      

 

চার.

যেসব রাষ্ট্রে মিডিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত যেমন চীন, কিউবা ও উত্তর কোরিয়া, সেসব রাষ্ট্রে বস্তুনিষ্ঠ ও মুক্ত সাংবাদিকতার সুযোগ কম বা অনেক ক্ষেত্রে নাই বললেই চলে। আর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে সংবাদপত্র শিল্পের মধ্যে করপোরেট পুঁজি অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকতা ও খবর উৎপাদন একটি অর্থনৈতিক কর্মকা-ে রূপান্তরিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবাদপত্র এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলারের একটি শিল্প। এর অর্থ হচ্ছে সংবাদপত্রগুলো সেসব খবর পরিবেশন করতে আগ্রহী থাকে, যে খবরগুলো অধিক সংখ্যক পাঠক পড়তে চান; এবং যাতে মুনাফা বেশি। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বা জনগুরুত্বপূর্ণ অনেক সংবাদই সংবাদপত্রগুলো পরিবেশন করতে চায় না; কেননা, এসব সংবাদে পাঠক আগ্রহ কম, যদি না কোনো রোগ বা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে। উদাহরণ হিসেবে পশ্চিম আফ্রিকাতে ইবোলার বিস্তার ও এই মহামারীতে লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিয়ন ও গায়নাতে ১১ হাজার ৩১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ‘কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা’ করার প্রবণতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও ‘বিট স্পেশালাইজেশন’কে উৎসাহিত করা হচ্ছে না। কেননা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও ‘বিট স্পেশালাইজেশনে’র জন্য যে অর্থ, সময় ও দক্ষতা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন পাওয়া যায় না।

১৯৮০ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু করার পর থেকে সেন্ট্রাল নিউজ নেটওয়ার্ক বা সিএনএন ২৪-ঘণ্টার সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীতে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পাঠকের খবর পাওয়ার আগ্রহ বেড়ে যায় এবং বিভিন্ন শ্রেণির পাঠক প্রতি মুহূর্তে সর্বশেষ সংবাদের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। পাঠকের চাহিদা মেটাতে ‘ব্রেকিং নিউজ’ অভিধায় সর্বশেষ খবর পরিবেশন করতে গিয়ে টেলিভিশন ও শত শত অনলাইন পত্রিকার মধ্যে বিশ্বব্যাপী এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে।

এতে অনেক সময় প্রকৃত তথ্য, উপাত্ত ও ঘটনা পরিবেশনের চেয়ে খবর পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমাননির্ভর এবং অ-যাচাই বাছাইকৃত খবর পরিবেশন করছে, ফলে নেমে যাচ্ছে সাংবাদিকতার মান। বাংলাদেশে ‘ব্রেকিং নিউজ’ পরিবেশনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কোনো কোনো টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে ফেলছে! এ বিষয়ে বিল কোভাচ ও টম রোসেনস্টিয়েল তাদের Warp Speed: America in the Age of Mixed Media  শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, ’the press has moved toward sensationalism, entertainment, and opinion” and away from traditional values of verification, proportion, relevance, depth, and quality of interpretation

সর্বশেষ সংবাদ পরিবেশনের সূত্র ধরে গত দেড় দশকে নাগরিক সাংবাদিকতা বা ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ নামে নতুন ধরনের সাংবাদিকতার উদ্ভব হয়েছে। এটিকে ‘স্ট্রিট জার্নালিজম’ বা রাস্তার সাংবাদিকতা অথবা ‘পার্টিসিপেটরি জার্নালিজম’ বা অংশগ্রহণমূলক সাংবাদিকতা বলেও অভিহিত করা হয়। কোনো নাগরিক যখন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, খবর পরিবেশন ও তার বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তখন তাকে নাগরিক সাংবাদিকতা বলে অভিহিত করা হয়। নাগরিক সাংবাদিকতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে- ২০০৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুনামি, আরব বসন্ত ও ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পের খবর পরিবেশন। সর্বশেষ খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রথাগত সাংবাদিকতার চেয়ে নাগরিক সাংবাদিকতা অধিক কার্যকর হলেও, নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানারকম ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ।  

 

পাঁচ.

একদলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মিডিয়া সরকার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় মুক্ত সাংবাদিকতার সুযোগ সীমিত। ইউরোপ আমেরিকার উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সে জন্য রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেও স্বাধীন গণমাধ্যমকে অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু ইরাক, আফগানিস্তান, ইসলামী জঙ্গিবাদ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ নানা ক্ষেত্রে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার জন্য পশ্চিমা মিডিয়া যে পক্ষপাতযুক্ত ও একদেশদর্শী খবর পরিবেশন করে সেটি বস্তুনিষ্ঠতা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা ও সাংবাদিকতার বৈশ্বিক ‘স্ট্যান্ডার্ডে’র নির্লজ্জ ও ন্যক্কারজনক লঙ্ঘন। তথাপি, পশ্চিমা দেশগুলো কার্যকর গণতন্ত্রের স্বার্থে তাদের দেশের অভ্যন্তরে সাংবাদিকতার একটি মান গড়ে তুলেছে। করপোরেট পুঁজির দাপট, উগ্রবাদ ও রক্ষণশীলতার উত্থান সত্ত্বেও পশ্চিমা গণমাধ্যমকে বেশকিছু নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়; পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী খবর পরিবেশন করতে গিয়েও পশ্চিমা মিডিয়াকে পাঠকের রুচি, চাহিদা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা, খবরের বস্তুনিষ্ঠতা ও প্রামাণিক মূল্যের দিকে খেয়াল রাখতে হয়।      

দীর্ঘদিন ধরেই একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে মনে করা হয়। তবে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে গণমাধ্যম বলতে শুধু ছাপা কাগজ নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকেও বুঝায়। সিএনএন কর্তৃক ২৪ ঘণ্টাভিত্তিক খবর পরিবেশন শুরু এবং তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের খবর পাওয়ার স্পৃহা ও আগ্রহ বেড়েছে। মানুষ এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে দেশ-বিদেশের সর্বশেষ খবর জানতে চায়। ফলে ‘ট্র্যাডিশনাল সংবাদপত্র’ থেকে একবিংশ শতাব্দীর ‘এক্সটেন্ডেড মিডিয়া’র কর্মকান্ড আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেছে মিডিয়ার দায়িত্ব, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা।

রাজনীতি, শিক্ষা, আইন-আদালত, অর্থনীতি, খেলাধুলা, বিনোদন, পরিবেশ ইত্যাদির বস্তুনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য খবর পরিবেশন করে মিডিয়া যেমন অগণিত পাঠকের খবরের চাহিদা মিটিয়ে থাকে; তেমনি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, করপোরেট হাউস ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, অনিয়ম ও দুর্বৃত্তায়নের চিত্র উন্মোচন করে গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ রাখার ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রের কার্যকারিতাকে জারি রাখার জন্যই সাংবাদিকের নিরাপত্তা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ ও অকাট্য সংবাদ পরিবেশনকারী সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মুক্তভাবে কাজ করার পরিবেশ। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য।

ইন্টারন্যাশনাল ডে টু অ্যান্ড ইমপিউনিটি ফর ক্রাইমস এগেইনস্ট জার্নালিস্টস বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের দায়মুক্তি সমাপ্তির আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক ঘোষণায় বলেছে যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা বর্ধিত হারে ভয়ভীতি, হুমকি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ এক ঘোষণায় বলেন যে, ‘সাংবাদিকের ওপর হামলা শুধু ব্যক্তি সাংবাদিকের ওপর হামলা নয়, এটি মত প্রকাশের অধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও হামলা।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঘোষণায় আরও বলা হয় যে, ‘গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের আয়না, যদি তারা মুক্ত ও ‘ক্রিটিক্যাল’ বা সমালোচনামুখর হন, তাহলে আমরা অর্থাৎ বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র মুক্ত ও নিরাপদ।’ 

তথ্যসূত্র :

1. Bill Kovach and Tom Rosenstiel, Warp Speed: America in the Age of Mixed Media, The Century Foundation, 1999.
2. 21st century challenges and opportunities for risk communications, See http://www9.who.int/risk-communication/21st-century-challenges-opportunities-for-risk-comms.
3. 27 Bangladesh journalists killed since 1992, Prothom Alo English, Online Desk, 2 November, 2015
4. Jay Rosen, A Most Useful Definition of Citizen Journalism”. PressThink, 14 July, 2000. 

৫. আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজপেপার এডিটরস ও ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস, ব্রিটেন।

সর্বশেষ খবর